গুপ্তযুগ ও গুপ্ত পরবর্তী যুগ:
গুপ্তযুগে সংস্কৃত সাহিত্যের বিকাশ চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হয়। বিগত কয়েক শতক ধরে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের বিবর্তন এবং রাজাদের আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতা লাভের কারণে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের ধ্রুপদী (classical) পর্যায়ে উত্তরণ ঘটে গুপ্ত আমলে। কোশাম্বির মতে, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের এই উন্নতির মূলে ছিল তৎকালীন ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থা ও ব্রাক্ষ্মণ শ্রেণীর সামাজিক অবস্থান। সেকালে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিশীলতা বৃদ্ধির কারণে শূদ্রদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল। এরা উচ্চতর শ্রেণী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের মতই সামাজিক অধিকার পেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সমাজের উচ্চতর শ্রেণী নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য সংস্কৃত ভাষা ব্যবহারে জোর দেন। এই সূত্রে গুপ্তযুগে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় নতুন জোয়ার আসে। গুপ্তযুগের সংস্কৃত সাহিত্যকে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ, এই দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। ধর্মীয় সাহিত্যের মধ্যে পুরাণগুলিই গুরুত্বপূর্ণ। তবে শেষ পর্বের স্মৃতিশাস্ত্রগুলিও এই পর্বে লেখা হয়েছিল। আবার রামায়ণ ও মহাভারত গুপ্তযুগে পুনর্লিখিত হয়ে তাদের বর্তমান আকার লাভ করেছে।
অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মার্কণ্ডেয়, ব্রষ্মাণ্ড, বিষু, ভাগবত ও মৎস্যপুরাণ গুপ্তযুগে সংকলিত হয়। আদি পুরাণের রচনাকার ছিলের চারণ কবির দল। দেখা গেছে প্রতিটি পুরাণেরই কাহিনীকার সূত লোমহর্ষণ কিংবা তাঁর পুত্র উগ্রশ্রবা । কিন্তু গুপ্তযুগে চারণ কবিদের রচনাগুলি এসে পড়ে ব্রাক্ষ্মণ সংকলকদের হাতে। এঁরা সমকালীন সমাজব্যবস্থা ও ধর্মভাবনার পরিবর্তনের ভিত্তিতে পুরাণগুলিতে নতুন নতুন বিষয় যোগ করেন এবং নতুন নতুন দেবতার আমদানি করেন। গুপ্তযুগে হিন্দুধর্মের মধ্যে নতুন সম্প্রদায় হিসেবে বৈষুব ও শৈবদের উদ্ভব ঘটেছিল। এখন এই সম্প্রদায়গুলিকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে যুক্ত করে রাখার বৈষুব ও শৈব আচার-অনুষ্ঠানের সাথে প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠানের সমন্বয়ের ভিত্তিতে নতুন ধর্মীয় সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়োজন অনুভূত হয়। এইভাবে ‘স্মার্ত-বৈষুব’ ও ‘স্মার্ত-শৈব নামে নতুন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। এঁরাই আধুনিক হিন্দুধর্মের সূচনা করেছিলেন। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতক থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে পুরাণগুলির পরিবর্তন ও নতুন পুরাণের সংকলন হয়েছিল। এই পরিবর্তনের ফলে দান, ব্রত, পূজা ইত্যাদি পুরাণগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বায়ুপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ ও ভাগবতপুরাণে গুপ্ত রাজাদের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই বলা চলে যে, এগুলির সম্পাদনা খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের আগে অন্তত হয়নি।
মহাভারত গুপ্তযুগে পরিবর্ধিত হয়। ব্যাস-রচিত মহাভারতে আদিতে শ্লোকসংখ্যা ছিল ২৪,০০०| এখন শ্লোক সংখ্যা বেড়ে হয় এক লক্ষ। মহাকাব্য ও স্মৃতিগ্রন্থগুলির বর্ণিত বিষয়ে কিছু মিল দেখা যায়। যেমন মনুর কিছু অনুশাসন মহাভারতের শান্তিপর্বে প্রায় একই আকারে দেখা যায়। এথেকে অনুমান করা যায় যে, মনুস্মৃতি গুপ্তযুগে সংকলিত বা পরিবর্ধিত হয়েছিল। বিষ্ণু, যাজ্ঞবল্ক, নারদ, বৃহস্পতি ও কাত্যায়ন স্মৃতি সম্ভবত গুপ্তযুগে রচিত হয়েছিল। এ যুগের ধর্মশাস্ত্রকারদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন কাত্যায়ন। তবে তাঁর মূল গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। দেবলস্মৃতিও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কাত্যায়ন ও দেবল সমসাময়িক ছিলেন বলেই অনুমান। ব্যাসের স্মৃতিগ্রন্থের সাথে নারদ, কাত্যায়ন ও বৃহস্পতির রচনার বহু মিল পাওয়া যায়। পরাশর স্মৃতি খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে রচিত হয়েছিল। এখানে মনুর বহু শ্লোকের উল্লেখ আছে। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে পুলস্ত্য, পিতামহ ও হারিতের স্মৃতিগ্রন্থগুলি রচিত হয়েছিল। তবে এঁদের মূল গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। অন্যত্র মতামতের উল্লেখ পাওয়া যায়।
গুপ্তযুগের ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের মধ্যে প্রথমেই নাটকের উল্লেখ করা যায়। আবার কবি ও নাট্যকারদের মধ্যে সর্বযুগের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকার কালিদাসের নাম উল্লেখ্য। অবশ্য কালিদাস গুপ্তযুগের অথবা তার আগের সময়ের মানুষ, তাই নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। তবে অধিকাংশের মতেই কালিদাস সমুদ্রগুপ্ত বা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সমসাময়িক। কালিদাসের বাল্যজীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। তবে কাব্যপাঠ করে বোঝা যায় যে, তিনি ছিলেন সুরুচিসম্পন্ন ও সংবেদনশীল ব্যক্তি। তাঁর কাব্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যথা—ফুল, পাখি, নিসর্গ ইত্যাদি যেমন স্থান পেয়েছে তেমনি স্থান পেয়েছে আড়ম্বরপূর্ণ রসসম্ভার ঘটনাবলীও। কালীদাসের কাব্যসমূহের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হল মেঘদূতম্। এ কাব্যের বিষয়বস্তু হল একজন নির্বাসিত যক্ষ কর্তৃক তার প্রিয়ার কাছে মেঘের মাধ্যমে প্রেরিত বিরহবাণী। যক্ষের বিরহবেদনা পাঠকের মনকে যেভাবে স্পর্শ করে, প্রাচীন তথা আধুনিক কোন কাব্যই সে কাজে এতদূর সফল হয়নি। কালিদাসের নাটকগুলির মধ্যে ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’,বিক্রমোর্বশীয়ম্ এবং ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ উল্লেখযোগ্য। কালিদাস ছাড়াও ভারবি, বিশাখদত্ত প্রমুখ লেখকদের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ভারবির কাব্যটির নাম কিরাতার্জুনীয়। কাহিনীটির মূল উপজীব্য বিষয় হল অর্জুনের সঙ্গে কিরাতের ছদ্মবেশী শিবের সংঘর্ষের ঘটনা। অষ্টাদশ সর্গে রচিত এই কাব্যটির ভাষা বলিষ্ঠ ও প্রকাশভঙ্গী প্রাঞ্জল। বিশাকদত্তের নাটক মুদ্রারাক্ষস ও দেবীচন্দ্রগুপ্তমের মধ্যে মুদ্রারাক্ষস নাটকের কাহিনীবিন্যাস জটিল। দেবীচন্দ্রগুপ্তম্ ঐতিহাসিক উপাদানে সমৃদ্ধ। গুপ্তযুগে অলংকৃত গদ্যরীতিরও বিকাশ ঘটেছিল। এক্ষেত্রে দণ্ডিণ ও সুবন্ধুর নামোল্লেখ করা যায়। দণ্ডিণ রচনা করেছিলেন দশকুমার রচিত ও কাব্যাদর্শ। দশকুমার চরিত গ্রন্থে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের কথা যত বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে তা দুর্লভ। সুবন্ধু রচিত গ্রন্থটির নাম বাসবদত্তা। গুপ্তযুগেই চরিত হয়েছিল পঞ্চতন্ত্রের কাহিনী। এর রচয়িতা ছিলেন বিষ্ণুশর্মা। এছাড়া গুণাঢ্য রচনা করেছিলেন বৃহৎকথা। এই মূল গ্রন্থটি পাওয়া যায়নি। তবে পরবর্তীকালে ক্ষেমেন্দ্র রচিত বৃহৎকথামঞ্জরীতে ও সোমদেবের কথাসরিৎসাগরে ঐ গ্রন্থের মূল বিষয়গুলি সংযোজিত হয়েছে।
এ যুগে রচিত হয় বিখ্যাত অভিধান ‘অমরকোষ’। গ্রন্থটি ছন্দাকারে রচিত। অনেকের মতে, এর রচয়িতা অমরসিংহ নবরত্ন সভার অন্যতম সদস্য ছিলেন। এই সময় সংস্কৃত ব্যাকরণের চান্দ্র ও জৈনেন্দ্ৰ—এই দুই বিখ্যাত ধারার প্রবর্তন হয়েছিল। চান্দ্র ধারার প্রবর্তক ছিলেন চন্দ্রগোমিন। তিনি বৌদ্ধ ছিলেন ও তাঁর ব্যাকরণ কাশ্মীর, তিব্বত, সিংহল এবং নেপালে খুবই জনপ্রিয় ছিল। ভর্তৃহরির বাক্যপদিয় থেকে শুরু করে মল্লিনাথ রচিত মেঘদূতের টীকা পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে ব্যাকরণের এই ধারা অনুসৃত হয়েছিল। জৈনেন্দ্র ব্যাকরণের প্রবর্তক ছিলেন জিনেন্দ্র। অবশ্য অনেকের মতে, ঐ ব্যাকরণের প্রকৃত প্রণেতা পূজ্যপাদ। গুপ্তযুগে ব্যাকরণের বিভিন্ন টীকাও লিখিত হয়েছিল। ভহরি রচনা করেন মহাভাষ্যের টীকা ও ব্যাকরণ দর্শনের উপরে ছন্দোবদ্ধ গ্রন্থ বাক্যপাদীয়। এছাড়া জয়াদিত্য ও বামনও মহাভাষ্যের টীকা রচনা করেন।
দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রেও গুপ্তযুগের উন্নতি লক্ষণীয়। ছয়টি দার্শনিক মতবাদ এই সময়ে স্পষ্টরূপ লাভ করেছিল। এই ছয়টি দর্শন হল—ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা বেদান্ত। সাংখ্যদর্শনের উপর সাংখ্যকারিক নামে টীকা রচনা করেন ঈশ্বরকৃয়। যোগ ও ন্যায়ের প্রাচীন টীকাকার ছিলেন যথাক্রমে ব্যাস ও পক্ষিলস্বামীন বাৎস্যায়ন। বৈশেষিক সূত্রের ভাষ্য ‘পদার্থধর্ম সংগ্রহ’ রচনা করেন প্রশস্তপদ। দিঙনাগ রচনা করেন ‘প্রমাণ-সমুচ্চয়’ নামক দার্শনিক গ্রন্থ। অসঙ্গ রচিত নাগাচার শাস্ত্র ও বসুবন্ধু রচিত পরমার্থ সপ্ততি-র নামও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। বেদান্ত লেখকদের মধ্যে গৌড়পাদ ছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত। স্মৃতি শাস্ত্রগুলির মধ্যে বৃহস্পতি নারদ, দেবল ও পরাশর স্মৃতি গুপ্তযুগে রচিত হয়। কয়েকটি পুরাণও এ যুগে পুনর্লিখিত হয়।
গুপ্তযুগে চিকিৎসাশাস্ত্র অবহেলিত ছিল না। চরক ও শুশ্রুতের পর এ যুগের বিখ্যাত চিকিৎসা গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন ভাগভট। সম্ভবত এই নামে দুজন লেখক ছিলেন। এঁদের দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ আমরা পেয়েছি, সে দুটি হল অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ এবং অষ্টাঙ্গ হৃদয় সংহিতা। প্রথমটি মূলত গদ্যে রচিত, যদিও মাঝে মাঝে পদ্যের অংশ রয়েছে। দ্বিতীয়টি সম্পূর্ণই পদ্যে রচিত। এদের রচয়িতা যথাক্রমে বৃদ্ধ ভাগভট ও ভাগভট। পশুচিকিৎসার জন্যও বহু গ্রন্থ এ যুগে রচিত হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হস্ত্যায়ুর্বেদ। গ্রন্থটি অঙ্গের রাজা রোমপাদ ও ঋষি পালকাপ্যর মধ্যে কথোপকথনের মত করে রচিত। এই গ্রন্থে হাতিদের নানাপ্রকার রোগ সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। এটি সম্ভবত খ্রিষ্টীয় পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকে রচিত। শালিহোত্র রচিত অশ্বশাস্ত্র গ্রন্থটির নামও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন চিকিৎসকগণের কাছে অস্ত্র চিকিৎসা অজানা ছিল না। এছাড়া ভেষজবিদ্যাও যথেষ্ট উন্নত ছিল। এ প্রসঙ্গে গ্রীক পণ্ডিত থিওফ্রাসস্টস্ রচিত উদ্ভিদের ইতিহাস গ্রন্থটি উল্লেখ্য। এতে ভারতে প্রাপ্ত বহু উদ্ভিদের গুণাগুণ বর্ণিত হয়েছে।
গুপ্তযুগে অঙ্কশাস্ত্রে ও গ্রহনক্ষত্র বিষয়ক বিজ্ঞানে ভারতীয় মনীষা যথেষ্ট উচ্চস্থান পরিগ্রহ করেছিল। এ প্রসঙ্গে বরাহমিহিরের নাম উল্লেখযোগ্য। ইনি ছিলেন পঞ্চসিদ্ধান্তিকার রচয়িতা। এই সময়ে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করা হত এইরকম পাঁচটি গ্রন্থের বা পাঁচটি সিদ্ধান্তের কথা বরাহমিহির তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এই পাঁচটি সিদ্ধান্তের নাম হল পৈতামহ, রোমক, পৌলিস, বাশিষ্ঠ এবং সূর্য-সিদ্ধান্ত। এগুলির মধ্যে প্রথমটি ঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক নয়, কিন্তু বাকি চারটির ক্ষেত্রে সেকথা বলা চলে না। এগুলির উপরে, বিশেষত দ্বিতীয় ও তৃতীয়টির উপর গ্রীক প্রভাব ছিল। রোমক পৌলিস ইত্যাদি নামগুলি থেকেই গ্রীক প্রভাবের বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়। সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থটি রোমকের অসুরমায়ার কাছে স্বয়ং সূর্য ব্যক্ত করেছিলেন বলে বলা হয়। এই সিদ্ধান্তগুলি ৩০০-৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লিখিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। বরাহমিহির যেসব সমকালীন জ্যোতির্বিদদের নামোল্লেখ করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন লাত, সিংহ, প্রদুম্ন্য বিজয়নন্দিন ও স্বনামধন্য আর্যভট্ট। আর্যভট্ট রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আর্যভট্টীয়, দশগীতিকা সূত্র, আর্যষ্টিশত ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে প্রথম গ্রন্থটি সবচেয়ে বিখ্যাত। আর্যভট্টই প্রথম গণিতকে বিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে নির্দিষ্ট করেন। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন যে, পৃথিবী আপন কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়লে চন্দ্রগ্রহণ হয় — এই সত্যও তিনিই উপলব্ধি করেন। দশমিক পদ্ধতির প্রবর্তকও ছিলেন এই আর্যভট্টই। তবে তাঁর আবিষ্কৃত পৃথিবীর আবর্তন ও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কিত তথ্য পরবর্তীকালীন জ্যোতির্বিদ যথা বরাহমিহির বা ব্রহ্মগুপ্তর দ্বারা সমালোচিত হয়েছে। আর্যভট্টের পর বরাহমিহিরের নামোল্লেখ করা যায়। তিনি তাঁর লেখায় ৪২৭ শকাব্দের উল্লেখ করেছেন। এ থেকে মনে হয় যে, তিনি খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকের শেষার্ধের লোক ছিলেন। তাঁর অন্তত ছটি গ্রন্থ আমরা পেয়েছি । তিনি গ্রহনক্ষত্র বিষয়ক বিজ্ঞানকে তন্ত্র (জ্যোতিঃশাস্ত্র ও অঙ্ক), হোরা (কোষ্ঠিচর্চা) ও সংহিতা (জ্যোতির্বিদ্যা) এই তিনভাগে ভাগ করেন। জ্যোতির্বিদ্যার উপরে তাঁর লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল পূর্বে উল্লেখিত পঞ্চসিদ্ধান্তিকা। জ্যোতিষশাস্ত্র বিষয়ে তিনি যে গ্রন্থটি রচনা করেন, সেটির নাম হল বৃহৎ-সংহিতা। এই গ্রন্থে ভূগোল, স্থাপত্য, মূর্তি নির্মাণ, পুষ্করিণী খনন, উদ্যানবিদ্যা, রত্নবিদ্যা, বিবাহ ইত্যাদি বহু বিচিত্র বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার তাই এই গ্রন্থকে এনসাইক্লোপিডিয়া বলে উল্লেখ করেছেন (His work on astrology, Brihat-Samhita, is an encyclopaedia of useful information in various branches of knowledge — The classical age, page 323) এই গ্রন্থগুলি ছাড়াও বরাহমিহির ‘বৃহদবিবাহপটল’ ও ‘স্বল্পবিবাহপটল’ নামে বিবাহের সঠিক সময় সম্পর্কে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। বরাহমিহিরের পর ব্রহ্মগুপ্তের নাম করা যায়, যিনি ব্রহ্মসিদ্ধান্ত ও খণ্ডখাদ্য নামক গ্রন্থদ্বয়ের রচয়িতা ছিলেন।