ভারতীয় উপমহাদেশে আদিকাল থেকেই শিল্পচর্চার রেওয়াজ ছিল, তার কিছু নিদর্শন আমরা পাই। প্রায়-ইতিহাস পর্যায়ে হরপ্পা সভ্যতার বিস্তীর্ণ এলাকা খননের ফলে শিল্পকর্মের নানা অবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে হরপ্পার পতনের পরবর্তীকালে এবং মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত কোন শিল্প নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়নি। সম্ভবত ক্ষয়শীল বস্তু যেমন কাঠ, মাটি, হাতির দাঁত, দানাপাথর ইত্যাদি শিল্পের উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের ফলে সেগুলি কালের গ্রাসে হারিয়ে গেছে। অতঃপর মৌর্য সম্রাটদের উদ্যোগে ভারতীয় শিল্পের স্থায়ী পুনরুজ্জীবন ঘটে। মৌর্যদের নেতৃত্বে ভারতে প্রথম সাম্রাজ্যিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বভাবতই একটা স্বতন্ত্র্য এবং দৃঢ় ভিতের উপর দাঁড়িয়ে মৌর্যরা শিল্পচর্চা করেছিলেন। পশ্চিম এশিয়ার সাথে পরিচয়ের সূত্রে ভারতের শিল্পচর্চা আদিম ও উপজাতীয় সংকীর্ণ ধ্যান ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে ভাবনা, চিন্তা ও কর্মে প্রসারতা পেয়েছিল। আফগানিস্তান পর্যন্ত মৌর্য সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ এবং মৌর্য রাজাদের গ্রীক সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ পশ্চিম এশিয়া ও ভারতের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক সংযোগ স্থাপন করে, মৌর্য শিল্পচর্চায় তার প্রতিফলন দেখা যায়। গ্রীক বীর আলেকজান্ডার কর্তৃক পার্সিপোলিস নগরী ধ্বংস হলে বহু শিল্পী মৌর্য সাম্রাজ্যে নতুন আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে মৌর্য স্থাপত্যকর্মে এর প্রভাব পড়েছিল। পার্সিপোলিসের শতস্তম্ভযুক্ত হলঘরের সাথে মৌর্যদের স্তম্ভযুক্ত হলঘরের সাদৃশ্য খুঁজে নেওয়া অবাস্তব নয়। অশোকের লেখমালার উপর পারসিক লেখর প্রভাব খুব স্পষ্ট। তবে কেবল বিদেশী প্রেরণা মৌর্য শিল্পকলার ভিত্তি ছিল, তা নয়। বহিরাগত ও ভারতীয় শিল্পীরা প্রাচীন ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্যের উপর ভর করেই শিল্প-স্থাপত্যে নতুনত্ব আনার চেষ্টায় ব্রতী ছিলেন।
মৌর্য যুগের শিল্প-স্থাপত্য বলতে প্রধানত বোঝায় পাটলিপুত্রের রাজপ্রাসাদ, সারনাথের একশিলা বেষ্টনী, বুদ্ধগয়ার বোধিমণ্ড, গয়া জেলার বারাবার ও নাগার্জুনি পাহাড়ের গুহাবাসগুলি। এছাড়া আছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা লেখযুক্ত বা লেখহীন স্তম্ভগুলি। তবে স্তম্ভগুলিকে স্থাপত্যের অংশ না বলে ভাস্কর্য নিদর্শন মনে করাই যুক্তিযুক্ত। স্তম্ভশীর্ষে জীবজন্তুর ভাস্কর্য এদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। গ্রীক পর্যটক মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে পাটলিপুত্রের প্রাসাদগুলির আদি-সৌন্দর্যের আভাস পাওয়া যায়। নির্মাণের কয়েকশো বছর পরে অশোকের আমলে নির্মিত পাটলি-প্রাসাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আর এক চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন লিখেছেন যে, বিচিত্র সুন্দর ভাস্কর্যে মণ্ডিত প্রস্তরখণ্ডগুলির বিন্যাসে নির্মিত এইসব প্রাসাদের প্রকার ও তোরণ দেখলে মনে হয়, এই সব কাজ কোনও মানুষের দ্বারা সম্ভব ছিল না, সবই দানবের কীর্তি। তবে সেই সব প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষও অবশিষ্ট নেই। সাম্প্রতিককালে পাটনার কাছে শত স্তম্ভযুক্ত একটি দরবার কক্ষের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মৌর্য স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। মৌর্য যুগের শিল্প নিদর্শনগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য এদের বিশালত্ব, সৌন্দর্য এবং সুশৃঙ্খলভাবে রূপায়ণ । পাটলি পুত্র ছাড়া অন্যান্য নির্মাণের উপাদান হিসেবে বৃহদাকার কঠিন ধূসর বর্ণের শিলাখণ্ড ব্যবহার করা হয়েছিল। শিলাখণ্ডগুলিতে সূক্ষ্ম কারুকার্য শিল্পীদের দক্ষতার পরিচয় দেয়।
বৌদ্ধধর্মের সাথে সম্পর্কিত অন্যতম স্থাপত্য কর্ম ছিল স্তূপ নির্মাণ। প্রথম দিকের স্তূপগুলির গঠন প্রণালী ছিল জটিলতা বর্জিত। ভূমিতে তৈরি একটি ‘বেদিকা’, তার উপরে ক্ষুদ্রতর ‘বেদিকা’ বা মেধা এবং তার উপরে ছিল অর্ধগোলাকার, গম্বুজাকার অংশ বা ‘অন্ড’। অন্ডের উপরে থাকত রেলিং দিয়ে ঘেরা সমতল অংশ। ঐতিহ্য অনুসারে সম্রাট অশোক ৮৪.০০০ স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। প্রায় নয়শত বছর পরে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ ভারতে এসে ভারত ও আফগানিস্তানে অশোক নির্মিত চারশো স্তূপের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন। বর্তমানে নেপালের স্তূপটি ছাড়া ঐ যুগের কোন স্তূপই মূলরূপে পাওয়া যায়নি। মুলত বৌদ্ধধর্মের সাথে যুক্ত কোন বিখ্যাত ঘটনা বা সাধু সন্তদের দেহাবশেষ সংরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে ইট বা পাথর দিয়ে বৌদ্ধ বা জৈনরা স্তূপ নির্মাণ করতেন। অশোক নির্মিত স্তুপগুলির মধ্যে সাঁচীর স্তুপটি উল্লেখযোগ্য। এটি প্রাচীনতম স্তূপ। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে এটিকে পুননির্মিত করা হয়। সংস্কারের পর আয়তন প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। ভূপালের নিকট নির্মিত এই স্তূপের আকৃতি অর্ধচন্দ্রাকৃতি ও গম্বুজ সদৃশ। বর্তমান আয়তন প্রায় ১২১.৫ ফুট ও উচ্চতা ৭৭.৫ ফুট। স্তূপের চতুস্পর্শ ১১ ফুট উঁচু রেলিং দিয়ে ঘেরা। এছাড়া আছে চারটি তোরণ। অশোকের আর একটি স্তূপ পাওয়া গেছে সারনাথে। সম্ভবত অশোকের আমলে নির্মিত স্তূপগুলির বেশির ভাগকেই পরবর্তীকালে সংস্কার দ্বারা পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত করা হয়েছিল।
এই স্তূপগুলিকে কেন্দ্র করে যে উপাসনালয় গড়ে উঠত তাকে বলা হত ‘চৈত্য’। সাঁচী ও সারনাথের চৈত্যগুলি স্বাভাবিক ভাবেই অশোকের আমলে নির্মিত হয়েছিল। অধিকাংশ চৈত্য নিৰ্মাণ করা হয়েছিল পাহাড় কেটে। গয়ার উত্তরে বরাবার পাহাড় কেটে মৌর্যযুগের চৈত্য গৃহ নির্মিত হয়েছিল। বিহার বা সঙ্ঘারাম ছিল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বাসস্থান। তাই এদের আকৃতি ছিল সাধারণ বাসগৃহের মত। বরাবার ও নাগার্জুনী পর্বতে এমন গুহাবাস আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সংঘারামগুলি আজিবিক সন্ন্যাসীদের উৎসর্গ করা হয়েছিল। অশোকের আমলে বরাবার পর্বতগুলি খোদাই করা হয়েছিল। নাগর্জুনী পর্বতের গুহা বাসগুলি তৈরি হয়েছিল অশোকের পৌত্র রাজা দশরথের রাজত্বকালে।
মৌর্য যুগের ভাস্কর্য শিল্পের নিদর্শন হিসেবে অশোকের আমলে নির্মিত অ-খণ্ড পাথরের স্তম্ভসমূহ এবং তার শিরোদেশে স্থাপিত পশু মূর্তিগুলির উল্লেখ করা যায়। নিদর্শন হল অশোকের স্তম্ভগুলি। এগুলির কোন কোনটিতে অশোকের লেখ খোদিত রয়েছে। ভারতের নানান স্থানে ত্রিশ বা তার অধিক সংখ্যক স্তম্ভ পাওয়া গেছে। এগুলির প্রাপ্তিস্থান হল বৈশালীর নিকটবর্তী বাখিরা, বিহারের চম্পারণের রামপূর্বা ও লৌড়িয়া নন্দনগড়, দিল্লী, তোপরা, এলাহাবাদ, কপিলাবস্তুর রুম্মিনীদেই, সারনাথ, সাঁচী ইত্যাদি স্থান। এর মধ্যে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে কেবলমাত্র লৌড়িয়া নন্দনগড় ও কোলহুয়ার স্তম্ভ দুটি। স্তম্ভগুলি একটিমাত্র শিলা দিয়ে তৈরি হত।
স্তম্ভগুলি গঠন সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে লৌড়িয়া নন্দনগড়ে প্রাপ্ত স্তম্ভটিকে আদর্শ স্থানীয় বলে মনে করা যেতে পারে। স্তম্ভের দুটি অংশ থাকত, তা হল দণ্ড, যা নীচে থেকে উপরে ক্রমশ সরু হয়ে গেছে। বেলে পাথরে তৈরি প্রতিটি স্তম্ভদণ্ডই সুনিপুণভাবে পালিশ করা হত। দণ্ডের উপরে থাকত স্তম্ভের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ বোধিকা। বোধিকারও তিনটি অংশ হত। সর্বনিম্নে থাকত ঘণ্টা, এর আকৃতি হত অনেকটা ওল্টানো পদ্মফুলের মত। এর উপর থাকত পশুপাখি বা লতাপাতার নক্সা খোদিত মঞ্জু। তারও উপরে থাকত পশুমূর্তি। সমগ্র বোধিকাটি একটি তামার খিল দিয়ে দণ্ডের সাথে জোড়া থাকত। লোহার খিল ব্যবহার করলে পাথরে চিড় ধরার সম্ভাবনা থেকে যাবে—এ কথা সে যুগেও অজ্ঞাত ছিল না। তাই তামা ব্যবহার করে সাবধানতা অবলম্বন করা হত। বোধিকাগুলিও স্তম্ভের মত একক শিলায় গঠিত হত।
স্তম্ভের শীর্ষের পশুমূর্তিগুলি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে আলোচনার যোগ্য। স্তম্ভশীর্ষে নানাপ্রকার পশুর মূর্তি দেখা যায়। যেমন—সিংহ, হস্তী, বৃষ, অশ্ব ইত্যাদি। এছাড়া রাজহংস ও গরুঢ় মূর্তিও দেখা গেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পশু চারটির সঙ্গে বুদ্ধের জীবনের বিশেষ কতকগুলি ঘটনা সংযুক্ত। যেমন বুদ্ধের জন্মের আগে মায়াদেবী শ্বেতহস্তীর স্বপ্ন দেখেন। অশ্বের সাথে তাঁর গৃহত্যাগের ঘটনার যোগ রয়েছে। বৃষমূর্তি উৎকীর্ণ করা হয়েছে বুদ্ধদেবের বৃষরাশিতে জন্মকে সূচিত করতে। সিংহটি সম্ভবত তাঁর ধর্মপ্রচারের বিষয়টির সঙ্গে জড়িত। আবার অনেকে মনে করেন, গরুঢ় যেমন বৈষুবধর্মের প্রতীক, তেমনি অশ্ব সূর্যের ও বৃষ ইন্দ্রের প্রতীক হিসেবে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। যাইহোক, লৌড়িয়া নন্দনগড়ে রয়েছে আহাররত রাজহংস ; রামপূর্বা বৈশালী, সারনাথে রয়েছে সিংহমূর্তি ; রামপূর্বার অপর স্তম্ভে রয়েছে বৃষ ; লৌড়িয়া আরারাজে রয়েছে গরুঢ় মূর্তি। হিউয়েন-সাঙ-এর বিবরণ অনুযায়ী লুম্বিনী স্তম্ভশীর্ষে ছিল অশ্বমূর্তি। সারনাথে প্রাপ্ত শিলাস্তম্ভটি মৌর্য স্থাপত্য গৌরবের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন। এটির উচ্চতা সাত ফুট। মাথাটি উল্টানো পদ্মের মত। এর উপরে মঞ্চে হাতি, ঘোড়া, ষাড় ও সিংহ এই চারটি পশুর আকৃতি উৎকীর্ণ। প্রতিটি পশুর পাশে আছে একটি করে চক্র। এই স্তম্ভে ২৪টি করে শিক আছে। মঞ্চের উপরিভাগে রয়েছে ৪টি সিংহমূর্তি, চারটির মুখ চারদিকে ঘোরানো। সিংহগুলির পিঠে ৩২টি শিকবিশিষ্ট একটি চক্র খোদিত। এটি হল ধর্মচক্র। ভারত সরকার সিংহস্তম্ভটি জাতীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মার্শালের মতে, পশুমূর্তির নিখুঁত গঠন প্রমাণ করে যে, মৌর্য শিল্পকলা কত উন্নত স্তরে পৌঁছেছিল। ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, “মৌর্য পশু-ভাস্কর্যের সমতুল্য শিল্প-নিদর্শন প্রাচীন বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার।” (“It is difficult to find in any country an example of ancient animal sculpture superior or even equal to this beautiful work of art”)
মৌর্য যুগের শিল্পকলা চর্চার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মৌর্যসম্রাটগণ। স্বভাবতই মৌর্য শিল্পে রাজকীয় আড়ম্বর ও গাম্ভীর্যের প্রকাশ দেখা যায়। বিশেষ করে স্তম্ভগুলির উচ্চশির, ঋজু দণ্ডায়মান অবস্থার মধ্যে রাজকীয় আভিজাত্য ও গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। তবে অধিকাংশ মৌর্য শিল্পকলার উদ্যোক্তা ছিলেন সম্রাট অশোক। তাই এগুলিতে বৌদ্ধধর্মের সহজাত নম্রভাবও প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে মৌর্য শিল্প ভাবনার উপর বৈদেশিক প্রেরণার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, গ্রীক ও পারসিক প্রভাব মৌর্য শিল্পসৃষ্টির অন্যতম প্রেরণা ছিল। স্তম্ভগুলির নির্মাণ শৈলীতে বিদেশী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন, খাঁজকাট বোধিকা গ্রীক এ্যাপোলোমন্দিরের কথা মনে করিয়ে দেয়। বোধিকার দড়ির বক্রনক্সা লতাপাতার নক্সা ইত্যাদি পারসিক ও গ্রীক প্রভাবের দিকে নির্দেশ করে। মৌর্য যুগের স্তম্ভগুলির উপর পারস্যের আকামেনীয় শিল্পের যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়। উজ্জ্বল পালিস ও মসৃণ বহিরঙ্গ, উল্টানো পদ্ম, মঞ্চের চারপাশের অলংকরণ, মঞ্চের উপর স্থাপিত পশুমূর্তি ইত্যাদি পারসিক প্রভাবের আভাস দেয়। বস্তুত পারসিক প্রভাব থাকলেও মৌর্য যুগের স্তম্ভগুলি সম্পূর্ণ রূপে পারসিক শৈলীর অনুকরণ ছিল না। পারসিক স্তম্ভগুলি খাঁজ কাটা এবং ভিত্তিমূলের উপর স্থাপিত ছিল। কিন্তু মৌর্য যুগের স্তম্ভ সাদামাটা এবং সোজা মাটি থেকে উঠে এসেছিল। কোন পৃথক ভিত্তি ছিল না। পারসিক স্তম্ভগুলি ছিল একাধিক শিলাখণ্ডের সমাহার, কিন্তু অশোকের স্তম্ভ ছিল এক শিলাবিশিষ্ট। অনুরূপভাবে অশোকের আমলের স্তম্ভশীর্ষের প্রাণী ভাস্কর্যে যথেষ্ট গ্রীক প্রভাব ছিল বলে মনে করা হয়। এঁদের মতে, গ্রীস ও পশ্চিম এশিয়ার পশুদের অনুকরণে মৌর্য ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছিল। পশুমূর্তির সুডৌল গড়ন, লতাপাতার অলংকরণ গ্রীক ভাস্কর্যের প্রভাব নির্দেশ করে। সম্ভবত অশোক কর্তৃক আমন্ত্রিত ব্যাকট্রিয় গ্রীক শিল্পীরাই মৌর্য ভাস্কর্যের রূপকার ছিলেন। এঁরা গ্রীক ও পারসিক শিল্পশৈলীর সাথে পরিচিত ছিলেন। ফলে মৌর্য ভাস্কর্যে তার প্রতিফলন দেখা যায়। সম্ভবত আলেকজান্ডারের প্রাচ্যদেশ অভিযানের সূত্রে গ্রীক-পারসিক শিল্পের সমন্বয় শুরু হয়েছিল। সেই সমন্বিত শিল্পশৈলী পশ্চিম এশিয়া থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারত হয়ে ক্রমে পূর্ব ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। তবে মৌর্য যুগের শিল্প স্থাপত্যে বৈদেশিক প্রভাব থাকলেও, তার বিষয়বস্তু ছিল একান্তভাবেই ভারতীয় এবং মৌর্য রাজাদের, বিশেষত সম্রাট অশোকের উদার ও সমন্বয়বাদী মানসিকতা শিল্পকর্মে প্রভাব ফেলেছিল।
শিল্প সমালোচকদের মতে, ভারতীয় শিল্প-ঐতিহ্যের বিচারে মৌর্য যুগের স্থাপত্য-ভাস্কর্যের গুরুত্ব নামমাত্র। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, দরবারী ঐতিহ্য সত্ত্বেও ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে মৌর্য যুগের শিল্পকে, নাটকের দুই অঙ্কের মধ্যবর্তী একটি গর্ভনাটিকার অধিক সম্মান দেওয়া যায় না। ক্ষয়শীল বস্তুর পরিবর্তে মৌর্য দরবারী শিল্পের উপকরণ হিসেবে পাথরকে ব্যবহার করার রীতি নিঃসন্দেহে একটি অগ্রণী পদক্ষেপ ছিল। তবে বৃহত্তর স্থাপত্য কর্মের অংশ হিসেবে এই স্তম্ভ শিল্পকে গ্রহণ করা যায় না। তাছাড়া শিল্পকর্মে সম্রাটের ব্যক্তিগত রুচি ও আদর্শই ছিল চূড়ান্ত। সমষ্টির ইচ্ছা, ঐতিহ্য বা পরম্পরা এক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়নি। সমাজের সাধারণ মানুষ বা তাদের জীবন ধারার সাথে এই শিল্পের কোন যোগ ছিল না। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, মৌর্য স্তম্ভগুলির মত মৌর্য শিল্পও নিঃসঙ্গ ও স্বতন্ত্র। ড. সরসীকুমার সরস্বতী এ বিষয়ে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন, পারসিক ও প্রাচ্যদেশীয় গ্রীক শিল্পের ঐতিহ্য মৌর্য শিল্পকলাকে আদিম শিল্পধারার সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্ত করে আভিজাত্য ও রুচিশীলতায় মণ্ডিত করেছিল। মৌর্য যুগের পশু-ভাস্কর্য পরবর্তীকালে ভারতীয় ভাস্কর্যের অন্যতম মৌলিক সম্পদ হিসেবে চর্চিত হয়েছে।
মৌর্য যুগে শুঙ্গ-কান্বযুগের শিল্পকলা :
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতীয় রাজনীতিতে একটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। এই পর্বে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিলিত হয়ে একটি মিশ্র কিন্তু অখণ্ড সমাজ কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন। সংস্কৃতির দিক থেকে এই পর্যায়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুঙ্গ-কাম্বদের উদ্যোগে এই সময় অশোকের আমলের মতই পর্বত-গুহায় বিহার ও চৈত্য গৃহ নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু শিল্পভাবনা, গঠন শৈলী ইত্যাদির বিচারে শুঙ্গ-কান্বদের শিল্পধারা ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং মৌর্য শিল্পের প্রায় বিপরীত। শুঙ্গ-কান্বদের শিল্পকর্মে ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও আদর্শের যথেষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়। ড. নীহাররঞ্জন রায় এই শিল্পকলাকে সমসাময়িক ভারতীয় জীবনের একটি উজ্জ্বল ভাষ্য বলে উল্লেখ করেছেন। শুঙ্গ-কান্বদের শিল্প একদিকে প্রাচীন ভারতীয় শিল্পের ঐতিহ্যকে রক্ষা করেছিল, অন্যদিকে বিভিন্ন বৈদেশিক জাতির শিল্প-ভাবনা দ্বারা নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিল। বিদেশী ভাবধারার প্রেরণা থাকলেও শুঙ্গ-কান্বদের শিল্পকর্ম ভারতের আপন বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে সক্ষম ছিল। অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ দর্শন জনমনে গভীর আলোড়ন তুলেছিল। তথাগত ও তাঁর ধর্মমতের প্রতি মানুষের অনুরক্তি প্রকাশ নানা ধারায়। তেমনই একটি মাধ্যম ছিল শিল্প। বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও বৌদ্ধধর্মকে আরো জনপ্রিয় করার জন্য এই সময় দেশের নানা অংশে বৌদ্ধধর্ম ভিত্তিক আঞ্চলিক শিল্পের অভূতপূর্ব বিকাশ লক্ষ্য করা যায়।
মৌর্য-পরবর্তী যুগে প্রধানত তিনটি স্থানকে কেন্দ্র করে ভাস্কর্য-শিল্প বিকশিত হয়েছিল। এই স্থান তিনটি হল ভারহূত, বোধগয়া ও সাঁচী। বৌদ্ধধর্মের অসাধারণ জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে এ সময়ে কয়েক ধরনের বিশিষ্ট স্থাপত্যরীতিও গড়ে উঠেছিল। এগুলি হল স্তূপ, চৈত্য ও বিহার। আলোচ্য তিন স্থানের ভাস্কর্য প্রধানত এখানকার স্তূপগুলির বেষ্টনী ও তোরণের গাত্রেই উৎকীর্ণ হয়েছিল। স্বভাবতই এ সকল স্থানের ভাস্কর্যের প্রধান উপজীব্য ছিল বৌদ্ধধর্ম-সংক্রান্ত বিষয়, যার মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে বুদ্ধ কথা ও জাতকের কাহিনীগুলি। এই যুগের বৌদ্ধধর্ম-সংক্রান্ত শিল্পগুলি আবশ্যিকভাবে বর্ণনাত্মক ৷ জনমানসে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য প্রস্তরগাত্রে সুসংবদ্ধভাবে বুদ্ধের জীবনী খোদাই করার প্রবণতা এ যুগে দেখা গিয়েছিল।
তিনটি স্থানের মধ্যে ভারহূতের ভাস্কর্যগুলি প্রাচীনতম। ভারহূতের মূর্তিগুলি তুলনামূলক বিচারে অপরিণত। তাই এগুলিকে প্রথম পর্বের, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের, সৃষ্টি মনে করা হয়। সাঁচির তোরণের মূর্তিগুলি সবচেয়ে পরিণত। তাই এগুলিকে শেষ পর্বের অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব কালের শেষ দিকের কাজ বলে মনে করা হয়। বুদ্ধগয়ার মূর্তিগুলি হয়তো এই দুই প্রান্তের মাঝামাঝি কালের সৃষ্টি। এখানকার অধুনালুপ্ত স্তূপটি নির্মিত হয়েছিল খ্রিঃ পূঃ দ্বিতীয় শতকে। স্তূপের বেষ্টনী ও তোরণগুলি সূক্ষ্ম কারুকার্যে পূর্ণ। এইসব তোরণের স্তম্ভ থেকে আরম্ভ করে উপরের দিকে সমান্তরালভাবে স্থাপিত প্রস্তর ফলকের সর্বত্র বড় বড় আলংকারিক পদ্ম, জাতককাহিনী, লতাপাতার নক্সা, হাতী, ঘোড়া ও মানুষ মূর্তিতে পূর্ণ। এছাড়া বৃক্ষপূজা, নাগপূজা, গজলক্ষ্মী পূজা ইত্যাদির দৃশ্যও এখানে দেখা যায়। পদ্ম ও তার মৃণালের ছন্দায়িত তরঙ্গের সাহায্যে একাধিক ভাস্কর্যচিত্রকে একসাথে সংযুক্ত করা হত। এখানে বৌদ্ধধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়, এমন নানা মূর্তিও দেখা যায়, যেমন—বিভিন্ন যক্ষ ও যক্ষিণীর মূর্তি, গ্রাম্য দেবতার মূর্তি ইত্যাদি। ভারহূতের শিল্পী মনুষ্য মূর্তিগুলিকে নিখুঁতভাবে উৎকীর্ণ করতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের চেষ্টা সম্পূর্ণ সাফল্য পায়নি। এই সাফল্য এসেছিল বোধগয়ায়। এখানকার রিলিফগুলি বাহুল্যবর্জিত। ভাস্কর্যগুলিতে পূর্বের আড়ষ্টতার পরিবর্তে সাবলীল ভাব স্পষ্ট। ভারহূত ও বোধগয়া, উভয় স্থানের ভাস্কর্যের পরিপূর্ণ বিকাশ আমরা দেখি সাঁচীতে। সাঁচীর প্রধান স্তূপের বেষ্টনী অলংকারবর্জিত হলেও এর তোরণ চারটি অসংখ্য মূর্তি ও রিলিফে পরিপূর্ণ। রিলিফগুলিতে বুদ্ধের জীবনী ছাড়াও সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাসমূহও উপস্থাপিত। সাঁচীর শিল্পে মানুষের পার্থিব জীবনের সাথে জড়িত সকল কিছুই অত্যন্ত উচ্ছ্বাস ও আনন্দের সাথে উপস্থাপিত। নরনারী, হাতি, হরিণ, মৃগ, মৃণালসহ পদ্ম, অশ্বত্থ বৃক্ষ, লতাপাতা ইত্যাদি সবকিছুই অত্যন্ত স্বাভাবিক ও প্রাণবন্তভাবে উৎকীর্ণ। সাঁচীর মানব মূর্তিগুলি বন্ধনমুক্ত, যক্ষিণীরা হাস্যমুখর, হাতি-ঘোড়ায় ও রথারূঢ় মানুষ শোভাযাত্রায় সামিল, স্ত্রীপুরুষ মন্দিরে পূজানিবেদনে রত। এইভাবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যায়িত চিত্র সাঁচীর শিল্পীরা উপস্থিত করেছেন।
ভারহূত-বোধগয়া-সাঁচীর ভাস্কর্যকে একই প্রক্রিয়ার ক্রম-পরিবর্তিত ও উন্নততর প্রয়াস বলা যায়। ভারহূতের শিল্পীরা দেহের বিভিন্ন অংশকে স্পষ্ট রূপে দেখালেও, দেহের অখণ্ডতা ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। বোধগয়ায় শরীরের অখণ্ডতা অনেক বেশি স্পষ্ট ভাবে দেখানো সম্ভব হয়েছে। প্রায়োগিক বিচারেও বোধগয়ার ভাস্কর্য ভারহূতের চেয়ে এগিয়ে। এখানকার রিলিফগুলিতে জটিলতা কম। কিছু মূর্তি গুরুভার হলেও, তাদের গতিময়তা, সজীবতা ক্ষুণ্ন হয়নি। এই ধারার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা যায় সাঁচীর ভাস্কর্যে। এখানে শিল্পীরা মানুষের পার্থিব জীবনের ছবি তুলে ধরতে প্রয়াসী ছিলেন। মানবদেহকে এখানে সামগ্রিক একটা সত্ত্বা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ. এল. ব্যাসামের মতে, সাঁচীর শিল্পে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। শিল্পীরা স্বাধীনভাবে মানব জীবনের নানাদিক তাঁদের ভাস্কর্যে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। কোন ধর্মীয় নির্দেশ নয়, জীবনের হাসি-কান্না, আনন্দ আবেগ, পশু, পাখি, গাছ-গাছালি, লতা-পাতা সব কিছুই সাঁচীর ভাস্কর্যে স্থান পেয়েছে এবং যথার্থই উজ্জ্বল ও জীবন্ত রূপে তাঁদের কাজগুলি পূর্ণতা পেয়েছে।
শক-কুষাণ যুগে শিল্প :
মৌর্য শাসনের পরবর্তীকালে শক-কুষাণদের আমলেও ভারতে শিল্পকলার চর্চা অব্যাহত ছিল। তবে মৌর্য আমলে শিল্পচর্চার যে ব্যাপকতা ছিল শক-কুষাণদের আমলে তা ছিল না। এই সময় নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে শিল্পচর্চার ধারা প্রত্যক্ষ করা যায়। এদের অন্যতম ছিল গন্ধার, মথুরা এবং অমরাবতী।
মৌর্য যুগে গন্ধার শিল্প :
ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের দিক থেকে গন্ধার অর্থাৎ পেশোয়ার ও তার সন্নিহিত আফগানিস্তানের জালালাবাদ, হাদ্দা ও বামিয়ান, সোয়াট উপত্যকা, তক্ষশীলা, ইউসুফজাই উপত্যকা, সোয়াট উপত্যকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গন্ধার শিল্পকলার চর্চা ছিল। দীর্ঘকাল ধরে উত্তর-পশ্চিম ভারতে গ্রীক, পারসিক, রোমান, শক, পহ্লব ও কুষাণদের বসতি স্থাপিত ছিল। তার ফলে ভারতীয় ও বৈদেশিক ভাবধারার সমন্বয়ে এখানে একটি মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। সেই মিশ্র সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে গন্ধার শিল্পকলায়। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, ঐ এলাকায় গ্রীকদেশ শাসনকালে এই মিশ্র শিল্পশৈলীর উদ্ভব হয়নি। গন্ধার শিল্পকলার মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মধ্য এশীয় জাতিগোষ্ঠী শক ও কুষাণরা। তবে গন্ধার শিল্পকে ভারতীয় শিল্প-ঐতিহ্যের উত্তরসূরী বলা যায় না। ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্যের মূল ধারার সাথে এর মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে বিকশিত এক শিল্পশৈলী এবং এর বিষয়বস্তু ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম হওয়ার কারণে গন্ধার শিল্পকেও ভারতীয় শিল্পচর্চার ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বলা যায়, বিদেশী শিল্প-সংস্কৃতির ভারতীয়করণের একটি পর্ব হল ‘গন্ধার শিল্প’।
গন্ধার শিল্পের সূচনা ও পরিণত পর্যায়ের সময়কাল সম্পর্কে কিছু মতভেদ আছে। তক্ষশিলা ও অন্যান্য স্থানে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলি থেকে অনুমান করা হয় যে, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষ দিকে এর সূচনা হয়েছিল। সম্ভবত গ্রীক শাসনের অবসানের পর এবং কুষাণদের ক্ষমতা দখলের আগে গন্ধার শিল্পের সূচনা হয়েছিল। তবে গন্ধার শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল কুষাণদের আমলে এবং নির্দিষ্টভাবে প্রথম কণিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতায়। জন মার্শাল, কুমারস্বামী, এস. কে. সরস্বতী প্রমুখ এই মত পোষণ করেন। জন. ভোগেল পেশোয়ায় প্রাপ্ত কিছু নিদর্শনের ভিত্তিতে বলেছেন যে, প্রথম কনিষ্কের আমলে গন্ধার শিল্পের অবনমন শুরু হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ গবেষক এই মত বর্জন করেছেন। খ্রিষ্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতক পর্যন্ত গন্ধার শিল্পের সৃষ্টিশীলতা অব্যাহত ছিল।
গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মকে কেন্দ্র করে গন্ধার শিল্প গড়ে উঠেছিল। ইতিপূর্বে বুদ্ধের প্রতীক ব্যবহার করে শিল্পসৃষ্টির রেওয়াজ ছিল। তাতে বুদ্ধমূর্তির কোন স্থান ছিল না। গন্ধারেই সর্বপ্রথম বুদ্ধের মূর্তিরূপ শিল্পের বিষয় হয়ে ওঠে। মহাযানবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বুদ্ধমূর্তির উপাসনা। তাই গন্ধার শিল্পের অনুপ্রেরণা হিসেবে মহাযানবাদের অবদান স্মরণ করা যায়। গন্ধার শিল্পের বুদ্ধমূর্তি বহিরঙ্গে গ্রীক-রোমান শিল্পধারা প্রভাবিত ছিল। রোমান ‘টোগা’র মত ভারী পোষাক পরিহিত দীর্ঘকায় পুরুষ, কোঁকড়ানো চুল, কখনো কখনো পুরু গোঁফ, শিরস্ত্রান প্রভৃতি এবং দৈহিক গঠন ও অঙ্গভঙ্গির সাথে ভারতীয় ধ্যান-ধারণার সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় না। গন্ধারের বুদ্ধমূর্তির সাথে গ্রিক দেবতা এ্যাপোলোর বেশি মিল ছিল। গন্ধারের প্রায় সমকালীন মথুরার বুদ্ধমূর্তির সাথে গন্ধারের বুদ্ধমূর্তির প্রকাশভঙ্গীর পার্থক্যটি লক্ষণীয়। এমনকি ভারহূত, বোধগয়া ও সাঁচীর রিলিফগুলিতে যে স্বতঃস্ফুর্ততা ও আধ্যাত্মিক ভাব ছিল, গন্ধারে তা ছিল না। অবশ্য মথুরার বুদ্ধেও আধ্যাত্মিক ভাবের প্রকাশ দেখা যায় না। তবে সেখানে মনস্তত্ব ও সংস্কৃতির বিচারে ভারতীয় আদর্শের রূপায়ণ ঘটেছিল।
পার্সি ব্রাউন গন্ধার শিল্পকে ‘গ্রীক-বৌদ্ধ’ শিল্প বলেছেন। তাঁর মতে, গন্ধার শিল্পের প্রকাশভঙ্গী গ্রীক হলেও, এর বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয়। কুমারস্বামী একে ভারতীয় বিষয়বস্তুতে প্রযুক্ত গ্রীক শিল্পরীতির স্থানীয় প্রকাশ (‘follows indian tradition in every essential of its iconography’) বলে অভিহিত করেছেন। রোল্যান্ড, বুকথল প্রমুখ গন্ধার শিল্পকে রোমান শিল্পের অন্ধ অনুকরণ বলে মনে করেন। কিন্তু এই মত একপেশে। অধ্যাপক সরস্বতীর মূল্যায়নটি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে এই শিল্পের প্রকরণ রীতি গ্রীকদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল, তবে পরিবর্তিত রূপে। শক ও কুষাণরা ভারতে বসবাসের সূত্রে বৌদ্ধধর্ম ও ভাগবত ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁরা ক্রমে ভারতীয় হয়ে উঠেছিলেন। গন্ধার শিল্পকর্মে স্বাভাবিক কারণেই গ্রীক ও ভারতীয় শিল্পের মিশ্র চেতনা প্রকাশ পেয়েছিল। স্টেলা ক্র্যামরিশ বলেছেন, হেলেনীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে গন্ধার শিল্প হল প্রাচ্যে হেলেনীয় শিল্পের প্রসার, আবার ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে হেলেনীয়রা কীভাবে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল, তারই প্রতিফলন দেখা যায় গন্ধার শিল্পে (“…if it is Indian and colonial from a Hellenistic point of view, it is Hellenistic and colonial when viewed from India”)। বস্তুত গন্ধার শিল্পকে গ্রীক শিল্প ভাবনার ভারতীয়করণ বলা যায়। টার্ন-এর মতে, গ্রীকরা স্বেচ্ছায় তাঁদের শিল্প প্রতিভাকে একটি বিদেশী ধর্মের সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন। এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। তাই অনেকে বলেন যে, গন্ধার শিল্পে নিযুক্ত ভাস্করদের হৃদয় ছিল ভারতীয়, কিন্তু তাঁদের হাতগুলি ছিল গ্রীক।
সামগ্রিক বিচারে ভারতীয় শিল্পের ধারায় গন্ধার শিল্প ছিল একটি ঢেউ, যার স্থায়িত্ব ছিল সাময়িক। নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে গন্ধার শিল্পে ভারহূত ও সাঁচীর স্বতঃস্ফুর্ততা ছিল না, আবার গুপ্ত অথবা পল্লব শিল্পের আধ্যাত্মিকতা ও আবেগ প্রবণতাও সেখানে ছিল না। তাই ভারতীয় শিল্পশৈলীর পূর্বাপর ক্রমবিকাশের সাথে গন্ধার শিল্পের যোগ প্রায় ছিলই না। তথাপি ভারতীয় শিল্পধারার একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় হিসেবে গন্ধার শিল্প স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মৌর্য যুগে মথুরা শিল্প :
বাণিজ্যিক কারণে প্রাচীনকাল থেকেই মথুরা অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ ছিল। ধর্ম ও শিল্পচর্চার কেন্দ্র হিসেবেও মথুরা সুনামের অধিকারী ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব কালের শেষ দিকে মথুরায় শিল্পচর্চার সূচনা হয়েছিল। শক ও কুষাণদের শাসনকালে মথুরা শিল্প পরিণত রূপ লাভ করে। মথুরায় প্রাপ্ত ভাস্কর্য নিদর্শনের সংখ্যা প্রায় ১৪০টি। এগুলি কুষাণ শাসনের প্রথম একশো বছরে নির্মিত হয়েছিল। মথুরা শিল্পের প্রধান বিষয়বস্তু বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণ। ভাস্কর্যের প্রধান উপাদান সিক্রি থেকে আনা লাল ছোপযুক্ত বেলে পাথর। ভারতের বাইরেও মথুরার শিল্প নিদর্শন পাওয়া গেছে। যেমন সূরজ কোটাল (আফগানিস্তান), আয়ারটোম (সোভিয়েত অধীন মধ্য এশিয়া) ইত্যাদি।
মথুরার ভাস্কর্যের বুদ্ধমূর্তি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। মথুরার শিল্পকর্মের সাথে মধ্যদেশের ভারহূত ও সাঁচীর সাথে ঘনিষ্ট যোগ ছিল। তবে মথুরার ভাস্কররা পূর্ববর্তী মূর্তি শিল্পের ঘরানায় পরিবর্তন আনেন। এখানে মনুষ্যবেশে বুদ্ধমূর্তি নির্মাণের বলে পূর্ববর্তী বর্ণনামূলক শিল্পশৈলী পরিত্যক্ত হয়েছিল। মথুরায় যে মূর্তি শিল্প গড়ে ওঠে, তার মূল প্রোথিত ছিল প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে। প্রাক্ আর্য বা অনার্যদের সংস্কৃতিতে মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল। হরপ্পা সংস্কৃতিতে তার প্রমাণ স্পষ্ট। সেই ধারাকে অনুসরণ করে মথুরাতে আরো প্রাণবন্ত মূর্তি তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। তবে ভগবান বুদ্ধের সাথে যক্ষ্ম ও দ্বারপাল মূর্তির শৈল্পিক ব্যবধান ছিল না। এই মূর্তিগুলি সাঁচীর যক্ষ্ম ও দ্বারপালের মূর্তির মতই আকারে বিশাল এবং অতিমাত্রায় পার্থিব। এগুলিতে আধ্যাত্মিকতার যথেষ্ট অভাব লক্ষ্য করা যায়। এগুলির আকার বৃহৎ। এ প্রসঙ্গে সারনাথ যাদুঘরে রক্ষিত বুদ্ধমূর্তিটি বিশেষভাবে আলোচ্য। মূর্তিটি কণিষ্কের রাজত্বকালের প্রথম দিকে, তাঁর তৃতীয় রাজ্যবর্ষে নির্মিত হয়েছিল। মূর্তিটি দশ ফুট উঁচু ও তিন ফুট চওড়া। এটি দণ্ডায়মান ও পা-দুটি দৃঢ়সংবদ্ধ। দুই পায়ের মধ্যে রয়েছে একটি সিংহমূর্তি। অনেকে মনে করেন, এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, মূর্তিটি শাক্য সিংহের। এই মূর্তিতে বুদ্ধদেবের ডান হাত অভয় মুদ্রায় উত্থিত করেছেন। নিতম্বের উপর রক্ষিত বাম হাত দিয়ে পোশাকটি ধরে আছেন। ডান কাঁধ আবরণহীন। ঠিক একই প্রকারের আর একটি মূর্তি দেখা যায় কৌশাম্বীতে। উভয় মূর্তির তফাৎ একটাই, কৌশাম্বীর মূর্তির দু-পায়ের মাঝখানে সিংহ নেই, রয়েছে পাঁচটি পদ্মের কুঁড়ি ও একটি ফুটন্ত পদ্ম। মথুরার বুদ্ধ-মূর্তিগুলি যেন বেশি মাত্রায় পার্থিব। এখানকার মূর্তিগুলি উন্নত বক্ষ, বৃষস্কন্ধ, মুণ্ডিত মস্তক, উন্মীলিত চক্ষু, স্মিতহাস্যে পূর্ণ মুখাবয়ব যেন কোন শক্তিশালী রাজার প্রতিমূর্তিকে স্মরণ করায়। মূর্তির অবয়ব ও বলিষ্ঠ প্রকাশভঙ্গী থেকে অনুমান করা হয় যে, বোধিসত্ত্বদের কথা স্মরণ করে এগুলি তৈরি করা হয়েছিল। তৎকালীন লেখগুলিতে এগুলিকে বোধিসত্ত্বমূর্তি বলা হয়েছে। সম্ভবত তখনও সরাসরি বুদ্ধকে মনুষ্যরূপে উপস্থাপন করার ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। প্রথম কণিষ্কের আমলে বোধিসত্ত্ব মূর্তি নির্মাণের যে রীতি চালু হয়েছিল ক্রমে তা পরিশীলিত ও উন্নত হয়েছিল। হুবিষক ও বাসুদেবের রাজত্বকালে নির্মিত কয়েকটি মূর্তিতে উন্নতির ছাপ দেখা যায়। তবে এই মূর্তিগুলিতেও আধ্যাত্মিকতা অপার্থিবতার কোন আদর্শ প্রকাশ দেখা যায় না। আগের তুলনায় এগুলি শিথিল ও নমনীয়, কিন্তু একান্তভাবেই পার্থিব জগতের প্রতীক।
মথুরার কিছু সংখ্যক বোধিসত্ত্বমূর্তিতে গন্ধার শিল্পরীতির প্রভাব দেখা যায়। এই মূর্তিগুলির মস্তক মুণ্ডিত নয়, কুঞ্চিত কেশদামে সুসজ্জিত। দেহে লম্বা পোশাক। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত আচ্ছাদিত। এসবই গন্ধার শিল্পের লক্ষণ। তবে এগুলি মথুরার শিল্পকর্মের শেষ পর্বের সৃষ্টি। এমন মূর্তির সংখ্যাও খুবই নগণ্য। কিছুদিনের মধ্যেই গন্ধারের প্রভাব থেকে মথুরার মুক্তি ঘটে এবং ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্য প্রকটিত হয়।
মথুরা শিল্পে জৈন ধর্মের প্রভাবও ছিল। জৈনধর্ম প্রভাবিত ভাস্কর্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘নিবেদন-ফলক’গুলি। এগুলি জৈন মন্দিরে জৈন অর্হৎদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে উৎকীর্ণ ‘আমোহিনী নিবেদন-ফলক’টি শিল্পগুণের বিচারে অগ্রগণ্য। কঙ্কালীটিলা থেকে উদ্ধার করা ফলকগুলিতে উপবিষ্ট জিনমূর্তি এবং তাঁর চতুস্পর্শে জৈনধর্মের নানারকম প্রতীকের সমাবেশ দেখা যায়। মথুরাতে ধর্মনিরপেক্ষ ভাস্কর্য চর্চাও জনপ্রিয় ছিল। রাজা, দেবস্থান কিংবা ধর্মের পৃষ্ঠপোষকদের প্রতিকৃতি এক্ষেত্রে শিল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। এমন ভাস্কর্য হিসেবে প্রথম কনিষ্ক, দ্বিতীয় কদফিসেস্ এবং চস্টনের মূর্তির কথা বলা যায়। কনিষ্কের মূর্তিটি বেদীর উপর দৃঢ়ভঙ্গীতে মুখোমুখি দণ্ডায়মান। একটি কঠিন আবরণে তাঁর দেহ আবৃত, পায়ে ভারী বুট জুতো, তবে মুণ্ডুহীন। ব্যাসামের মতে এই মূর্তি প্রাচীন মিশরের পুরোহিত শ্রেণীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে কনিষ্কের কর্তৃত্ব ও রাজকীয় দম্ভ প্রকাশ পেয়েছে। ড. সরস্বতী মনে করেন যে, কনিষ্কের এই মূর্তি ভারতীয় শিল্পধারার ঐতিহ্যবাহী নম্রতা, আধ্যাত্মিকভাব ইত্যাদির সাথে আদৌ সম্পর্কিত নয়। সিংহাসনে উপবিষ্ট দ্বিতীয় কদফিসের মূর্তিটিও একই রকম কর্তৃত্বব্যঞ্জক। এই মূর্তির উপর পার্থিয় যুগের ইরানীয় ভাস্কর্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই প্রতিকৃতিতে মধ্য এশীয় অথবা শক্ শিল্পশৈলীর প্রভাব থাকা অসম্ভব নয়।
মথুরা ও সন্নিহিত অঞ্চলে কিছু স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়েছে যেখানে নানারকম মূর্তি উৎকীর্ণ আছে। এগুলিতে বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব, কিছু পুরুষ মূর্তি, যক্ষ্মিণী, অপ্সরা, সুসজ্জিতা নারীর প্রতিকৃতি অঙ্কিত আছে। এখানে অধিকাংশ মূর্তি নগ্ন বা অর্ধনগ্ন। অনুমিত হয় মথুরা শিল্পচর্চার শেষ দিকে আনুমানিক খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে এই স্তম্ভ-ভাস্কর্য খোদিত হয়েছিল। নারী মূর্তিগুলিতে ইন্দ্রিয়পরায়ণতার ছাপ স্পষ্ট। ক্ষীণ কটিদেশ এবং গুরু নিতম্ব নারী মূর্তিগুলির অঙ্কনে হরপ্পার নর্তকী মূর্তির প্রভাব দেখা যায়। যক্ষিণী মূর্তিগুলির সাথে ভারহূত, বোধগয়া বা সাঁচীর যক্ষিণী মূর্তির মিল আছে। তবে এগুলির যৌন আবেদনে স্বতঃস্ফুর্ততার প্রকাশ নেই। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, ভারহৃত-সাঁচীর নারীমূর্তির স্বতঃস্ফুর্ততা মথুরার মূর্তিতে অনুপস্থিত। এখানে সচেতন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে কামকলা প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এই ভাস্কর্য-কল্পনায় একটি স্বতন্ত্র বিষয় তুলে ধরার প্রয়াস আছে। কামনা-বাসনার প্রলোভনে যে বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বদের চিত্ত বৈকল্য ঘটেনি—এই স্তম্ভ-ভাস্কর্যে তা প্রতীয়মান হয়েছে।
বস্তুত মথুরা শিল্প বিদেশী শিল্প শৈলীকে গ্রহণ করলেও, কখনোই নিজস্ব শিল্প ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। মথুরার শিল্পধারাই পরবর্তীকালের ভারতীয় শিল্পভাবনায় উন্নত ও গতিশীল রূপে প্রতিভাত হয়েছে।
অমরাবতী (বেঙ্গী)র শিল্প :
দক্ষিণ ভারতে কৃয়া-গোদাবরী নদীর ব-দ্বীপ অঞ্চলে বেঙ্গিকে কেন্দ্র করে একটি পৃথক শিল্পশৈলী আত্মপ্রকাশ করেছিল। এটি ‘বেঙ্গি শিল্প’ নামে অভিহিত হয়। তবে এই শিল্পচর্চার প্রধান ক্ষেত্র ছিল অমরাবতী। তাই এটি ‘অমরাবতীর শিল্প’ নামেই বেশি পরিচিত। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতক থেকে চতুর্থ শতক পর্যন্ত অমরাবতীর শিল্পকলা গতিশীল ছিল। এই শিল্পশৈলীর নিদর্শন জগগজ্যপেত, নাগার্জুর্নিকোণ্ড, গোলি প্রভৃতি স্থানেও পাওয়া গেছে। জগগজ্যপেতে প্রাপ্ত ভাস্কর্যের নিদর্শনগুলি বিচার করে এগুলিকে সবথেকে প্রাচীন বলে মনে করা হয়। সাঁচীর ভাস্কর্যের সাথে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। তবে সাঁচীর তুলনায় এখানকার মূর্তি নির্মাণ রীতি অধিক উন্নত ও বাস্তব।
বেঙ্গি বা অমরাবতীর শিল্পচর্চার ব্যাপকতার কারণ ছিল এই অঞ্চলের আর্থিক স্বচ্ছলতা। ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে দক্ষিণের উপকূল বন্দরের সাথে রোমের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। এই বন্দরগুলি চীন-রোম বাণিজ্যে মধ্যবর্তীর ভূমিকা পালন করে বিপুল বাণিজ্য শুল্ক সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল। এই আর্থিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় রাজন্যদের পৃষ্ঠপোষকতা শিল্পচর্চার কাজে নতুন উৎসাহ জুগিয়েছিল। সাতবাহন বংশীয় রাজা বাশিষ্ঠপুত্র পুলমারি, যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী প্রভৃতি শাসক অমরাবতীর শিল্পচর্চার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তাছাড়া দক্ষিণ ভারতে বিদেশী আক্রমণের সম্ভাবনা না থাকায় এখানে শিল্পীরা নিশ্চিন্ত মনে ও নিরাপদে শিল্পসৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করতে পেরেছিলেন। ড. সরস্বতীর মতে, দার্শনিক নাগার্জুনের অবদানও স্মরণ করতে হয়। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে নাগার্জুন বৌদ্ধধর্মকে নতুন রূপে উপস্থাপিত ও জনপ্রিয় করেছিলেন। অমরাবতীর শিল্পে বৌদ্ধধর্ম ও বুদ্ধমূর্তি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এই কৃতিত্ব নাগার্জুনের প্রাপ্য।
উত্তর ভারতের ভারহৃত, সাঁচী বা মথুরার শিল্পধারা থেকে দক্ষিণ ভারতে বেঙ্গী বা অমরাবতীর শিল্প শৈলীকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা যায় না। উভয় ক্ষেত্রেই শিল্পের উপাদান বা বিষয়বস্তু অভিন্ন। তবে অমরাবতীর শিল্পে স্থানীয় বৈশিষ্ট্যগুলি শক্তিশালী রূপে প্রকাশ পেয়েছিল। অমরাবতীর দণ্ডায়মান বা উপবিষ্ট বুদ্ধ মূর্তির দৈহিক গড়ন ও পোষাক-পরিচ্ছদ মথুরার বুদ্ধমূর্তিগুলির অনুরূপ। তবে মথুরার বুদ্ধমূর্তির কাঠিন্য অমরাবতীতে বর্জন করা হয়েছে। এখানকার বুদ্ধমূর্তি অনেক বেশি পেলব ও কোমল। মথুরার বুদ্ধমূর্তির মুখাবয়ব গোলাকার, কিন্তু অমরাবতীর বুদ্ধের মুখ ডিম্বাকৃতি। তবে বেঙ্গীর শিল্পকে একান্তভাবে বৌদ্ধশিল্প বা ধর্মীয় শিল্প কলা বলা যায় না। কারণ এখানের মূর্তি কল্পনায় বৌদ্ধ ধর্মের মৌলিক আদর্শ অর্থাৎ ত্যাগ, সংযম এবং নির্বাণ ইত্যাদির প্রকাশ দেখা যায় না। এই শিল্পে মানবদেহ, বিশেষ করে, নারীদেহের রহস্য ভেদের গভীর প্রয়াস আছে। মনুষ্যমূর্তিগুলি দণ্ডায়মান, উপবিষ্ট, হন্টনরত, নৃত্যরত ইত্যাদি নানারূপে সৃষ্টি করা হয়েছে। জীবনের আনন্দ, গতিশীলতা ও যৌবনের উচ্ছলতা প্রতিটি মূর্তির বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে নারী মূর্তিগুলিতে ইন্দ্রিয় পরায়ণতা, কামকলা ইত্যাদি গুরুত্ব পেয়েছে। এদের উন্নত বক্ষ, গুরু নিতম্ব, দাঁড়ানোর ভঙ্গী সব কিছুতেই ইন্দ্রিয় পরায়ণতার প্রকাশ দেখা যায়। ড. নীহাররঞ্জন রায় অমরাবতী শিল্পের ইন্দ্রিয় পরায়ণতাকে সার্বিক মনে করেন না। তাঁর মতে, মথুরা শিল্পের নির্লজ্জ স্থূলতা অমরাবতীতে দেখা যায় না। এদের নির্মাণ রীতি খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের মথুরা শিল্পের চেয়ে উন্নত। অমরাবতীর শিল্পীরা গ্রীক শৈলীর অনুকরণে শরীরের বিভিন্ন অংশের ভারসাম্য রক্ষা করে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন।
ড. রায় লিখেছেন যে, বেঙ্গীর শিল্পে জীবন সম্পর্কে যে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গী দেখা যায়, তা তৎকালীন আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম পরিণতি ছিল। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের শিল্পের উন্নত মান পরবর্তী শতকে অনেকটাই ম্লান হয়েছিল। এই পরিবর্তনের বিশেষ কারণ হল জীবন ধারা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা এবং দাক্ষিণাত্যের সামাজিক সংগঠন ও জীবনধারা ছিল গ্রামীণ ও কৃষিভিত্তিক। এই পর্বে অমরাবতীর শিল্পচর্চায় গ্রামীণ সারল্য ও মূল্যবোধ বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। শিল্পীরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তাঁদের শিল্পকর্মে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের দ্বিতীয় ভাগে দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি বন্দর ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের সাথে জড়িয়ে পড়ে। উত্তর ভারতেও এই পরিবর্তন দেখা দেয়। কৃষি সমাজের পরিবর্তে এক নতুন বণিক শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। ফলে সামাজিক রুচি ও জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন অনিবার্য হয়। মথুরার শিল্পে এই পরিবর্তন মৃদু আকারে শুরু হয়েছিল। কিন্তু দক্ষিণ ভারত উপসাগরীয় বাণিজ্যের অংশীদার হিসেবে আর্থিক, সামাজিক ও মানসিকভাবে বিদেশী সংস্কৃতির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। সেই মানসিক পরিবর্তনের প্রকাশ দেখা যায় অমরাবতীর শিল্পচর্চার শেষ পর্বে। এতদ্সত্বেও, ড. সরসীকুমার সরস্বতী মনে করেন যে, অমরাবতী শিল্পের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী ও গভীর। দেশের মধ্যে গুপ্ত ও চালুক্যদের শিল্পধারা যেমন অমরাবতীর শিল্পচেতনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, তেমনি দেশের বাইরে সিংহল এবং ইন্দোচীনেও অমরাবতীর শিল্পরীতি প্রভাব ফেলেছিল।
গুপ্তযুগের শিল্প :
প্রাচীন ভারতের স্থাপত্যের ইতিহাসে গুপ্তযুগের বিশেষ অবদান আছে। গুপ্তযুগেই স্থায়ী উপাদান সহযোগে মন্দির স্থাপত্যের সূচনা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। গুপ্ত-পূর্ব যুগে ভারতে মন্দির স্থাপত্যের বিশেষ নিদর্শন নেই। জয়পুরের কাছে বৈরাটে একটি ছোট্ট গোলাকার গৃহের সন্ধান পাওয়া গেছে। বর্তমানে এর ভিতটুকু অবশিষ্ট আছে। তক্ষশিলার জান্দিয়ালে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এটিতে গ্রীক শৈলীর প্রভাব দেখা যায়। শক্-কুষাণ যুগে অর্ধবৃত্তাকার এক ধরনের মন্দিরের নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে প্রাক্-গুপ্তযুগের মন্দির স্থাপত্যে কোন ধারাবাহিকতা ছিল না। বিক্ষিপ্তভাবে মন্দিরের অনুরূপ কিছু কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়াস দেখা যায় মাত্র। গুপ্তযুগে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে মন্দির স্থাপত্যের কাজ সম্পাদিত হয়েছিল। ইট, পাথরের মত স্থায়ী উপকরণ দিয়ে এযুগের স্থপতিরা দেবমন্দির নির্মাণে প্রয়াসী ছিলেন। এযুগে নির্মিত মন্দিরগুলির মধ্যে অল্পসংখ্যক মন্দিরই আজ পর্যন্ত টিকে রয়েছে। কিন্তু সমসাময়িক লেখ ও সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, সেই সময়ের নগরগুলি উচ্চ মন্দির দ্বারা সজ্জিত ছিল।
গুপ্তযুগের স্থপতিরা মন্দির নির্মাণে একটি বিশেষ শৈলী অনুসরণ করতেন। এ যুগের মন্দিরগুলির তিনটি অংশ থাকত, যথা—(১) প্রধান দরজা ও তার পরবর্তী অঙ্গন, (২) নাটমন্দির, (৩) গর্ভগৃহ, সেখানে বিগ্রহ স্থাপন করা হত। মন্দিরের চারিদিকে থাকত প্রশস্ত উঠান ও প্রাচীর। অধ্যাপক সরস্বতী এ যুগের মন্দিরগুলিকে গঠনশৈলী অনুযায়ী পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন, যথা—(১) সমতল ছাদযুক্ত বর্গক্ষেত্রাকার মন্দির, এ ধরনের মন্দিরের সামনে হালকা ধরনের মণ্ডপ থাকত। (২) সামনে মণ্ডপযুক্ত সমতল ছাদের বর্গক্ষেত্রকার মন্দির। তবে এখানে গর্ভগৃহের চারিদিকে পরিক্রমার জন্য ঢাকা জায়গা থাকত। (৩) মাথার উপর নিচু শিখর বা ধ্বজাযুক্ত বর্গক্ষেত্রাকার মন্দির। (৪) ধনুকাকৃতি ছাদের আয়তাকার মন্দির, যার পিছনের দিকের আকৃতি অর্ধ-বৃত্তাকার। (৫) বৃত্তাকার মন্দির, যার চারটি কোণায় কিছু অংশ বেরিয়ে থাকত।
প্রথম তিনটি বিভাগের মন্দিরগুলি ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। এর মধ্যে প্রথম বিভাগের মন্দিরগুলিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগের ভিত্তি বলা চলে। প্রথম শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য হল বর্গাকৃতি ভিত্তি নক্সা, সমতল ছাদ ও সম্মুখে একটি বারান্দা। এই শ্রেণীর মন্দিরগুলির প্রতিনিধি স্থানীয় ছিল সাঁচীর ১৭ নম্বর মন্দিরটি। এটির গঠন-প্রণালী অত্যন্ত সরল। একটি চতুষ্কোণ গর্ভগৃহ ও সামনে পিলারযুক্ত বারান্দা নিয়ে মন্দিরটি গঠিত। এই পর্বের অন্যান্য মন্দিরগুলি হল তিগয়া ও এরাণের মন্দির। এছাড়া এই পর্বের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের অসংখ্য নিদর্শন নাচনা কুঠারা, বিলসদ ইত্যাদি স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে এগুলি সম্ভবত ইটের তৈরি হওয়ায় এদের পূর্ণাঙ্গ রূপ বর্তমান নেই। সুতরাং সাঁচী, তিগয়া ও এরাণের মন্দিরগুলিকেই এই বিভাগের উৎকৃষ্ট নিদর্শন বলা চলে।
দ্বিতীয় শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য প্রথম শ্রেণীর অনুরূপ তবে বর্গাকৃতি গর্ভগৃহের চারিদিকে একটি প্রদক্ষিণ পথের সংযোজন ঘটেছিল। দ্বিতীয় বিভাগের উদাহরণ হিসেবে নাচনা কুঠারার পার্বতী মন্দির, ভূমারার শিবমন্দির, আইহোলের মেগুটি মন্দির ইত্যাদি। বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার ইস্টকনির্মিত বেগ্রামের গোবিন্দস্বামীর মন্দিরটিও সম্ভবত একই প্রকার পরিকল্পনা অনুযায়ী একই সময়ে স্থাপিত হয়েছিল। নাচনা কুঠারার পার্বতী মন্দির পরিকল্পনা ও অলংকরণ অত্যন্ত সাদাসিধা। এ থেকে মনে হয় যে, এই মন্দিরটি এই বিভাগের প্রথমদিকে নির্মিত। এই মন্দিরের ভিত্তিনক্সা আয়তাকার। এর গর্ভগৃহের চারদিকে একটি আচ্ছাদিত প্রদক্ষিণ পথ আছে। ফলে মন্দিরের গঠনটি একটি বর্গাকৃতি পরিবেষ্টনীর মধ্যে অপর একটি ক্ষুদ্র বর্গাকৃতি অংশের ন্যায় মনে হয়। আচ্ছাদিত দরদালানের বাইরে একটি আয়তাকার বারান্দা বা মণ্ডপ আছে, যেখানে স্তম্ভও রয়েছে। আচ্ছাদিত দরদালানটিকে আলোকিত করার জন্য তিনদিকের দেওয়ালে তিনটি কুলুঙ্গী থাকত। আবার গর্ভগৃহটিকে আলোকিত করার ব্যবস্থা ছিল দেওয়াল সংলগ্ন দুটি কুলুঙ্গী দ্বারা। মন্দিরের বাইরের দিকের একসারি সোপান বেয়ে মণ্ডপে পৌঁছানো যেত। এই মন্দিরের গর্ভগৃহটি ছিল দ্বিতল। এটি ভারতীয় স্থাপত্যের এক বিবর্তনের সূচনা করে। ভূমারার শিবমন্দিরটিও সুন্দরভাবে অলংকৃত। এই মন্দিরটির চারকোণে চারটি ছোট ছোট মন্দির আছে। এই সামগ্রিক আকৃতিটিকে পঞ্চায়তন মন্দির রূপে বর্ণনা করা হয়ে থাকে।
তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত মন্দিরের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য শিখর বা চূড়াযুক্ত গর্ভগৃহ। প্রাক্-ষষ্ঠ শতকের কোন মন্দিরে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসী জেলার অন্তর্গত দেওগড়ের দশাবতার মন্দিরটি হল এই শ্রেণীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া নাচনা কুঠারার মহাদেব মন্দির, ভিটারগাঁওয়ের মন্দির, হিউয়েন-সাঙ বর্ণিত বোধগয়ার মন্দিরটি এই শ্রেণীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দশাবতার মন্দির থেকে আমরা এই শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে জানতে পারি। এই মন্দিরের ভিত্তিনক্সা চতুষ্কোণ। মন্দিরটি একটি উচ্চ ও প্রশস্ত মঞ্চের উপর স্থাপিত। মঞ্চে পৌঁছানোর জন্য প্রতি পার্শ্বের মধ্যস্থল থেকে সোপানশ্রেণী রয়েছে। ভিত্তিবেদীটি অসংখ্য ভাস্কর্যমণ্ডিত কুলুঙ্গী দ্বারা সুন্দরভাবে অলংকৃত। দেওয়ালের উপরদিকে কার্নিসের মধ্যবর্তী স্থানে ক্ষুদ্রাকার চিত্রিত কুলুঙ্গী রয়েছে। এর উপরেই প্রস্তর নির্মিত পিরামিডাকৃতি শিখর স্থাপিত। ইস্টক নির্মিত ভিতরগাঁওয়ের মন্দিরটির ভিত্তিনক্সা বর্গাকৃতি। অন্তর্বর্তী পথ ও বহির্ভাগের প্রবেশপথটি অর্ধবৃত্তাকৃতি খিলানযুক্ত ছাদ দ্বারা আবৃত। গর্ভগৃহ ও ক্ষুদ্রাকৃতি প্রকোষ্ঠটি গম্বুজাকৃতি ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত।
চতুর্থ পর্যায়ভুক্ত মন্দির হল সোলাপুরের তের মন্দির ও কৃয়া জেলার কপোতেশ্বর মন্দির, রাজগৃহের মনিয়ার মঠ বা মণিনাগের মন্দির হল পঞ্চম পর্যায়ের মন্দিরের নিদর্শন। এই পর্বের মন্দিরগুলি সম্ভবত পূর্বের চৈত্যগৃহের সংস্কৃত রূপ। এদের আকার, আয়তন বা শিল্প-সৌন্দর্য কোনটাই উল্লেখযোগ্য নয়৷
গুপ্তযুগের ভাষ্কর্য :
মথুরা ও অমরাবতীর ভাস্কর্যের সমন্বিত এবং উন্নত রূপ ছিল গুপ্তযুগের ভাস্কর্য। গুপ্তযুগে শিল্পের মৌলিক সৌন্দর্য ও ধ্রুপদী নন্দন তত্ত্বকে রূপদানের আন্তরিক প্রয়াস শিল্পকর্মকে একটি উন্নীত করেছিল। এই শিল্পধারায় ভারতীয়, এশীয়, পারসিক ও গ্রীক শিল্পশৈলীর অভূতপূর্ব সমন্বয় নতুন স্তরে দেখা যায়। আনন্দ কুমারস্বামীর মতে, গুপ্তযুগের ভাস্কর্যে মথুরা শিল্পের আদিমতা মার্জিত হয়েছিল এবং গন্ধার শিল্পের গ্রীক-রোমার শৈলীর প্রভাব আত্মস্থ করে এক স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভারতীয় শিল্পশৈলীর জন্ম দিয়েছিল। ড. নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন যে, গুপ্তযুগের ভাস্কর্যে মথুরার পার্থিবতা এবং অমরাবতীর যথেচ্ছাচার দুটিই পরিশোধিত হয়েছে। গুপ্তযুগের ভাস্করদের উচ্চ-আদর্শবাদ ও জাতীয়তাবোধ তাদের সৃষ্টিকে ইন্দ্রিয়াতীত বোধ ও বুদ্ধির অন্তর্গত করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের ভাস্কর্যে মনুষ্য মূর্তির যে অতীন্দ্রিয় রূপ ফুটে উঠে, তা তাঁদের সৃষ্টিকে অদৃশ্য স্বর্গীয় চেতনার অচঞ্চল প্রকাশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। শিল্পীরা প্রাচীন ভারতীয় ভাস্কর্যের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেন নি, বরং অতীত আদর্শবোধের সাথে বর্তমানের আধ্যাত্মিকতা, সৌন্দর্যবোধ ও বাস্তবতার সমন্বয়সাধন করেছিলেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষায়, “Indeed the Gupta sculpture may be regarded as typically Indian and classic in every sense of the term”. গুপ্ত ভাস্কর্যে পার্থিবতাকেও সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়নি। তবে তাতে শারীরিক ও মানসিক ছন্দের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছিল। অন্তরের উদ্দীপনায় ভরপুর এ যুগের মূর্তিগুলিতে তাই পোষাক ও অলংকারের বাহূল্য বর্জিত হয়েছিল।
গুপ্তযুগের মূর্তিগুলির আসন ও মুদ্রা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আসন ছিল তিন প্রকার—দণ্ডায়মান (স্থানক), উপবিষ্ট (আসীন) এবং ঈষৎ হেলানো (শায়ন)। দণ্ডায়মান আসন বিশিষ্ট মূর্তিগুলির মধ্যে বৈচিত্র্য ছিল। এদের কোনটি একেবারে সোজা (সমভঙ্গ), কোনটি সামান্য বাঁকা (আভঙ্গ), আবার কোনটি দ্বি-ভঙ্গ বা ত্রিভঙ্গ। উপবিষ্ট মূর্তির আসনও তিন ধরনের ছিল। যেমন—সমভঙ্গ, পদ্মাসন এবং ললিতাসন। শাসন বা ঈষৎ হেলানো মূর্তির দৃষ্টান্ত মাত্র দুটি –একটি বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের মহূর্ত এবং অন্যটি শেষ শয্যায় বিষু। মুদ্রা হল হাত ও আঙ্গুলের গঠনশৈলী। গুপ্তযুগের মূর্তিতে নানা ধরনের মুদ্রার ব্যবহার দেখা যায়, যেমন অভয়মুদ্রা, ধ্যানমুদ্রা, ভূমিস্পর্শ মুদ্রা, বরদা মুদ্রা, ধর্মাক্রপ্রবর্তন মুদ্রা ইত্যাদি। মহাযান ও বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের মূর্তি নির্মাণে এই পঞ্চমুদ্রার দ্বারা পাঁচজন ধ্যানী বুদ্ধকে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এছাড়া আত্মার সংকেত হিসেবে গুপ্তযুগের ভাস্কর্যে বিতর্ক মুদ্রা, অঞ্চলি মুদ্রা ও নমস্কার মুদ্রার ব্যবহার দেখা যায়।
মথুরা ও সারনাথকে গুপ্তযুগের ভাস্কর্যের দুটি প্রধান ভাণ্ডার বলা যায়। মথুরাতে সিরি ছোপযুক্ত লাল বেলে পাথরে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। গুপ্তযুগে নির্মিত মথুরার বুদ্ধমূর্তিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জামালপুরে প্রাপ্ত দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকের এই মূর্তি বর্তমানে মথুরা সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। এছাড়া কাটরায় প্রাপ্ত মূর্তি (৫৪৯-‘৫০ খ্রিঃ), কুশীনগরে পরিনির্বাণ মন্দিরে শয়ান বুদ্ধমূর্তি (পঞ্চমশতক), এলাহাবাদে প্রাপ্ত মুণ্ডিত মস্তক উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি (পঞ্চমশতক), বোধগয়ার আসীন বুদ্ধমূর্তি (৩৮৩ খ্রিঃ), সাঁচীর বুদ্ধমূর্তি ইত্যাদি গুপ্তযুগের মথুরা ভাস্কর্যের অন্যতম নিদর্শন। ভাস্কর শৈলীর বিচারে এই বুদ্ধমূর্তিগুলি শক-কুষাণ যুগের ধারা বহন করে চলেছে। তবে কুষাণ যুগের দেহগঠনের স্থূলতা ও বিশালতা গুপ্তযুগে অনেক সংযত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। গুপ্তযুগে নির্মিত প্রথম বোধিসত্ত্ব মূর্তি বোধগয়ায় পাওয়া গেছে। তবে এর উপাদান হিসেবে হলুদ বর্ণের চুনাপাথরের ব্যবহার থেকে স্পষ্ট যে এটি মথুরায় তৈরি হয়েছিল। এই মূর্তিতে কুষাণ ভাস্কর্যের অনড় গাম্ভীর্যের সাথে গুপ্ত ভাস্কর্যের অর্ন্তনিহিত সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মভাবের সফল সমন্বয় দেখা যায়।
মথুরার তুলনায় সারনাথের ভাস্কর্য অধিক মৌলিক ও সূক্ষ্ম। চুনারের বেলে পাথরে তৈরি সারনাথ বুদ্ধমূর্তিতে বৈদেশিক শিল্পশৈলীর প্রভাব অনুপস্থিত। ড. নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন যে মথুরার বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব ভাস্কর্যগুলিতে অন্তর্গত জয়ের চিহ্ন নেই। অর্থাৎ মোহমুক্ত এবং চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে গিয়ে জীবনের পরমানন্দ উপভোগ করার মনোভাব মূর্তিগুলিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু সারনাথের মূর্তিগুলি প্রধান সম্পদ হল আধ্যাত্ম চেতনার প্রকাশ। সারনাথেই সর্বপ্রথম বুদ্ধ তাঁর বোধিজ্ঞান প্রচার করেছিলেন যা, ‘ধর্মচক্রপ্রবর্তন’ নামে খ্যাত। এই ঘটনাটি উপবিষ্ট বুদ্ধ ও তাঁর প্রথম পাঁচজন শিষ্যের মূর্তি নির্মাণ দ্বারা স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে। পবিত্র আদর্শ ও মহান সৌন্দর্যের সহযোগে এই বুদ্ধমূর্তিতে আত্মার প্রকাশ ঘটানোর প্রয়াস আছে। রেনি গ্রাউসেটের মতে, ‘an art so inspired by intellectualism as to be direct expression of soul through the purely ideal beauty of form’. উল্লেখ্য যে, সারনাথে বুদ্ধমূর্তির পাশাপাশি বুদ্ধের জীবনের নানা ঘটনা পাথরের তৈরি পৃষ্ঠভূমিতে চিত্রে উৎকীর্ণ করা হয়েছে।
গুপ্তযুগের ভাস্কর্যের মূল বিষয়বস্তু বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বদের মূর্তি হলেও, একমাত্র বিষয় ছিল না। এই সময় হিন্দু ধর্মকেন্দ্রিক ভাস্কর্যও সৃষ্টি হয়েছিল। দেওগড়ের মন্দিরের উপর হিন্দুদের দেবীর মূর্তিগুলি গুপ্ত ভাস্কর্যের নিদর্শন। গোয়ালিয়রের সূর্যমূর্তি ও সেকালের সৃষ্টি। সূর্যদেব এখানে বলিষ্ঠ ও আনন্দঘন রূপে উপস্থাপিত। তাঁর ডান হাতে অভয় মুদ্রা। গোয়ালিয়রের নিকটবর্তী পাওরিয়ার সপার্ষদ নর্তকী মূর্তিটিও গুপ্তযুগের অবদান। ভিলসার নিকটে উদয়গিরি (মালব) গুহার প্রবেশ পথের পাশে প্রাপ্ত বরাহবতার মূর্তিটিও দর্শনীয়। এ. এল. ব্যাসাম বলেছেন যে, মহাপ্রলয় থেকে ধরিত্রীকে রক্ষা করার সময় বিষু যে বরাহ রূপ ধারণ করেছিলেন, এই রিলিফে সেটিই তুলে ধরা হয়েছে। এই মূর্তির দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখমণ্ডলী ও বলিষ্ঠ দেহসৌষ্ঠব মানবজাতির কাছে আশা, শক্তি ও অশ্বাসের বাণী বহন করে এনেছে। এলিফ্যান্টা গুহায় খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের যেসব ভাস্কর্য আছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মহাদেব, তাণ্ডব নৃত্যরত শিব এবং শিব-পার্বতীর বিবাহ। আইহোলিতে পর্বত গুহায় খোদাই করা দুর্গা মন্দির ও তার পাশে শিব-বৈশ্রবণের মূর্তি উৎকীর্ণ হয়েছিল। বস্তুত পূর্ব ভারত ও পশ্চিম ভারতের ভাস্কর্যকর্মের মধ্যে কিছু স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। পূর্ব ভারতের শিল্প নিদর্শনগুলি নমনীয়তা, পেলবতা ও অঙ্গসৌষ্ঠবের মাধুর্য দ্বারা মণ্ডিত। কিন্তু পশ্চিম ভারতের মূর্তিগুলি অনমনীয় বা কঠোর এবং গুরুভার দেহবিশিষ্ট। পূর্ব ভারতের ভাস্কর্য কর্মে সারনাথের প্রভাব বেশি, কিন্তু পশ্চিমের ভাস্কর্যে সারনাথের তুলনায় মথুরা শৈলীর প্রভাব বেশি।
পল্লব যুগে শিল্প :
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য চর্চার ক্ষেত্রে পল্লব রাজাদের কীর্তি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য দ্বারা শ্রীমণ্ডিত। ধারাবাহিকতার বিচারে পল্লব শিল্পের রীতি ও প্রকরণ ছিল স্বতন্ত্র। চোল শিল্পের বিরাটত্ব পল্লব শিল্পে ছিল না। কিন্তু সৌন্দর্য ও সুষমার দিক থেকে তা ছিল দৃষ্টিনন্দন। এ যুগের শিল্পভাবনা ছিল মূলত ধর্মকেন্দ্রিক। পল্লব শিল্পের বৈশিষ্ট্য, হল একটি গোটা পাহাড় কেটে রথ বা মন্দিরের আকৃতি দেওয়া এবং সূক্ষ্ম ভাস্কর্যের কাজ দ্বারা সেই সথাপত্যকে দৃষ্টিনন্দন করে তোলা। পল্লব শিল্পীরা সম্ভবত পরম্পরাগত ঐতিহ্য দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। প্রথম পর্বে শিল্পীদের উপকরণ ছিল কাঠ জাতীয় ক্ষয়শীল বস্তু । তাই সেগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে পাহাড়কাটা মন্দিরগুলিকে আকস্মিক বলা যায় না। এগুলিতে গুপ্তযুগের ‘তল বিশিষ্ট’ মন্দিরের অভিযোজন পাওয়া যায়। এই অভিযোজনের সময় পল্লব শিল্পীরা অনিবার্যভাবে কিছু কিছু স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের সংযোজন করেছিলেন। প্রথম পর্বে পল্লব শিল্পকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। (১) মহেন্দ্র বর্মনের আমলে নির্মিত সাধারণ স্তম্ভযুক্ত মণ্ডপ। (২) প্রথম নরসিংহবর্মন ও তাঁর অব্যবহিত পরবর্তী শাসকদের আমলে নির্মিত একশিলা মন্দির। মহেন্দ্রশৈলীর বৈশিষ্ট্য হল পাহাড় খোদাই করে মন্দির নির্মাণ। এগুলি বৃত্তাকার এবং ঘন ক্ষেত্রকার স্তম্ভযুক্ত। একাম্বরনাথ মন্দিরের স্তম্ভগুলিতে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। মহেন্দ্রবর্মনের রাজত্বের প্রথম দিকে মন্দির ছিল অনাড়ম্বর, সরল। কিন্তু পরবর্তীকালে মন্দিরগুলি কিছুটা বৌদ্ধবিহারের অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল। যেমন—উন্ড্রবল্লীর ‘অনন্ত শায়ন’ মন্দির বা উত্তর আর্কট জেলার ভৈরব কুণ্ডের মন্দির। এই মন্দিরের অলংকরণ ছিল লক্ষ্যণীয়। এখানে নিম্নে ও শীর্ষে সর্বপ্রথম সিংহ যোগ করা হয়।
দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত মন্দিরের নিদর্শন মহাবলীপুরমে পাওয়া যায়। মহামল্ল গোষ্ঠীর রাজাদের আমলে এগুলি নির্মিত হয়েছিল বলে এই রীতিকে মহামল্ল রীতি বলা হয়। এখানে ছিল ১০টি মণ্ডপ ও ৭টি রথ। এই রথগুলিকে একত্রে সপ্তপ্যাগোডা বলা হয়। প্রতিটি রথ একটি বৃহদাকার প্রস্তরখণ্ড খোদাই করে নির্মাণ করা হয়েছে। রথের শিল্পরীতি অনেকটা মণ্ডপের মতই। তবে এতে দারুশিল্পের বিশেষ প্রভাব দেখা যায়। রথগুলির অভ্যন্তর ভাগ অসম্পূর্ণ। সম্ভবত এগুলি ব্যবহৃত হত না। রথগুলি সম্ভবত শৈব ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। ৭টি রথ ছিল পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদী ও গণেশের নামে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রতম ছিল দ্রৌপদী রথ। এটি ছিল চতুষ্কোণ মন্দির। যার ছাদটি চতুষ্কোণ বক্ররেখা দ্বারা বেষ্টিত। অন্য রথগুলি পিরামিডাকৃতি। তাদের প্রতিটি তল কার্নিশযুক্ত এবং চৈত্যের মত খিলান দ্বারা শোভিত। ভীম ও গণেশের রথের পরিকল্পনা আয়তাকার। দুটির শীর্ষদেশ নলাকৃতি খিলান বিশিষ্ট। অন্যদিকে চতুষ্কোণযুক্ত অর্জুন ও ধর্মরাজ রথের শীর্ষদেশ গম্বুজ আকৃতি স্তুপিকা দ্বারা শোভিত।
স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে নির্মিত মন্দিরগুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণীর মন্দিরের সংখ্যা ছয়। এগুলি নির্মিত হয়েছিল রাজসিংহ গোষ্ঠীর আমলে। এদের মধ্যে তীর মন্দির, ঈশ্বর মন্দির ও মুকুন্দ মন্দির মহাবলী পুরমে অবস্থিত। একটি আছে পনমলইতে এবং শেষ দুটি হল কাঞ্ঝীর কৈলাস মন্দির ও বৈকুণ্ঠের পেরুমল মন্দির। দ্বিতীয় সারির মন্দিরগুলি নির্মিত হয়েছিল নন্দীবর্মন গোষ্ঠীর আমলে—এগুলি আয়তনে ছোট ও অনুন্নত।
পেরুমল মন্দিরকে শিল্পভাবনার পরিণত রূপ বলা হয়। এখানে দ্রাবিড় শিল্পীরা অকারণ বাহুল্য বর্জন করেছেন। মহাবলীপুরমের মন্দিরটি প্রাচীনতম। সমুদ্রের তীরে অবস্থিত হওয়ায় একে তীর মন্দির বলা হয়। এখানে পাশাপাশি দুটি মন্দির অসামঞ্জস্য ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি মন্দিরে পিরামিডের মতো একটি বিমান আছে। ড. সরসীকুমার সরস্বতী বলেছেন ‘এখানে শিল্পীরা এক নতুন আকাঙ্ক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন।’ কাঞ্চীপুরমের কৈলাসনাথ মন্দিরকে সুষমা মণ্ডিত রূপকল্পনার সার্থক দৃষ্টান্ত বলা যায়। আপাতভাবে বৌদ্ধ স্তূপ মনে হলেও অধ্যাপক সরস্বতী এগুলিকে দ্রাবিড় শিল্পরীতির নিদর্শন বলে মনে করেন। দ্রাবিড় শিল্পরীতি পরবর্তীকালের চোল রাজাদের যেমন প্রভাবিত করেছিল তেমন ইন্দোনেশিয়া ও ইন্দোচীনে স্থাপিত উপনিবেশগুলি গড়ে ওঠায় স্থাপত্যকেও প্রভাবিত করেছিল। নন্দীবর্মন গোষ্ঠীর আমলে দুটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল মুক্তেশ্বর ও মাতঙ্গেশ্বর মন্দির।
দক্ষিণ ভারতে ভাস্কর্য শিল্পের সূচনা ঘটেছিল পল্লব আমলে। ভাস্কর্য শিল্পের পথিকৃৎ ছিলেন মহেন্দ্রবর্মন, তাঁর উদ্যোগে গুহামন্দিরগুলি উৎকীর্ণ হয়েছিল। নরসিংহ বর্মন মহাবলীপুরমের রথমন্দির, গুলি ভাস্কর্যমণ্ডিত করেছিলেন। মহামল্লযুগের বরাহ গুহামন্দিরে বরাহ অবতার, গজলক্ষ্মী, দুর্গা প্রমুখের মূর্তি উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে মহাবলীপুরমের রথমন্দিরগুলি দেবতা ও মানব দেহের ভাস্কর্য দ্বারা সুশোভিত। এখানে পল্লবরাজ সিংহবিয়ু, প্রথম মহেন্দ্রবর্মন, নরসিংহবর্মন প্রমুখের প্রতিকৃতি দেখা যায়। প্রথম দুই রাজার সাথে রাণীদের প্রতিকৃতিও দেওয়া হয়েছে। এই পর্বের শেষ দিকের কাজে বেঙ্গীর ভাস্কর্যরীতির প্রভাব দেখা যায়। অধ্যাপক সরস্বতী লিখেছেন, “বেঙ্গীর মূর্তিগুলির ভাবাবেগ পল্লব মূর্তিগুলিতে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। বেঙ্গীর তুলনায় পল্লব মূর্তিগুলি অনেক সংযত। তবে এখানে কোন কোন ক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতীয় ভাস্কর্যে অনুসৃত গুরুভার দেহের আভাস পাওয়া যায়।
মহাবলীপুরমে ‘গঙ্গাবতরণ’ শীর্ষক প্যানেলটি বিশেষভাবে ছবিটি আকর্ষণ করে। এই ভাস্কর্যের প্রশংসা করে চিত্রসমালোচক গ্লাইসেট বলেছেন, ‘a regular fresco in stone, a masterpiece of classic-art.” ভাস্কর্যটিকে শিল্পরসিকেরা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কীর্তি মনে করেন। এখানে কোন, কৃত্রিমতা নেই। মানুষ, দেবতা, অর্ধ-দেবতা, জীব-জন্তু, সন্ন্যাসী প্রভৃতির একটি সম্পূর্ণ জগৎ এই ভাস্কর্যে পরিপূর্ণরূপে উপস্থিত। ‘তাই অনেকে এটিকে প্রস্তর নির্মিত প্রাচীর চিত্র” বলেছেন। পরিপূর্ণ সংযমবোধ মূর্তিগুলিকে মহিমান্বিত করেছেন। গোটা রিলিফ (relief) টিকে ক্রমানুসারে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন মনে হয় বাঁচার আনন্দ ও উচ্ছাসে ভরা মূর্তিগুলি পাহাড়ের গা বেয়ে অবিরাম উঠে আসছে। গভীর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব জিজ্ঞাসার পরিবর্তে এই মূর্তিগুলিতে উদার প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবনের উচ্ছ্বাস ও আনন্দ বিধৃত হয়ে আছে। পশুমূর্তিগুলিতেও শিল্পীদের মমত্ববোধ প্রতিফলিত। পল্লব শিল্পীদের গভীর রসবোধের অনন্য দৃষ্টান্ত হল ‘তপস্বী বিড়াল’ মূর্তিটি।
মহাবলীপুরমের অনুরূপ নিদর্শন গুহামন্দিরের কয়েকটি রিলিফে দেখা যায়। এগুলির মধ্যে কৃষ্ণমণ্ডপে পশু পালকের জীবন সংক্রান্ত দৃশ্যটি স্মরণীয়। ‘মহিষমর্দিনী মণ্ডপে’ যুদ্ধ ও শান্তি অবলম্বনে দুটি বিপরীতধর্মী প্যানেল আছে। একটিতে দেখা যায় তেজদীপ্তি কর্মপ্রেরণার প্রকাশ ও অন্যটিতে আছে গভীর প্রশান্তি। বরাহ মণ্ডপের রিলিফ দুটিতে অপূর্বভাবে তেজ ও গতিবেগের সাথে ধৈর্য ও প্রশান্তির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।
শিল্পরসিকেরা মনে করেন বেঙ্গীর ভাস্কর্যকর্মে একধরনের শিথীল অবসাদ গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু পল্লব আমলের মূর্তিগুলি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। বেঙ্গীতে ইন্দ্রিয় পরায়ণতা গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু পল্লব ভাস্কর্যে তার অনুপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। তবে পল্লবযুগে নারীমূর্তিগুলিতে পুরুষ নির্ভরতার দিকটি গুরুত্ব পেয়েছে। সমকালীন ইলোরার মূর্তিতে আলোছায়ার যে খেলা দেখা যায় পল্লব ভাস্কর্যে তা অনুপস্থিত। সব মিলিয়ে পল্লব মূর্তিগুলি অনেক বেশি স্পষ্ট ও জীবন্ত।
পল্লব শাসকদের শিল্পভাবনা ও শিল্পানুরাগের সাথে স্থানীয় শিল্পীদের শিল্পচেতনার সমন্বয়ের ফলেই পল্লবযুগে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে নবযুগের প্রকাশ ঘটেছিল। দ্রাবিড় শিল্পরীতি যথেষ্ট পরিশীলিত রূপে দেখা যায় পল্লব শিল্পীদের কাজে। কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও সীমিত অর্থে দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পকলা ও বৃহত্তর অর্থে ভারতের শিল্পজগৎ পল্লবযুগের শিল্পকর্ম দ্বারা পরিপুষ্ট ও অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
প্রাচীন ভারতে চিত্রশিল্প :
প্রাচীন ভারতে চিত্রশিল্পের চর্চা থাকলেও, আভিজাত্যের বিচারে চিত্রকলার স্থান স্থাপত্য ভাস্কর্যের তুলনায় ছিল নগণ্য। প্রাচীন ভারতীয় চিত্রাঙ্কনের নমুনা বিশেষ পাওয়া যায় না, তবে প্রাচীন সাহিত্যে চিত্র শিল্পের বহু উল্লেখ আছে। খ্রিষ্টপূর্ব কালের ব্রাষ্মণ সাহিত্য ও বৌদ্ধ সাহিত্যে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারত মহাকাব্যে রাজকুমারী ঊষার সখী চিত্রলেখাকে একজন নিপুণা চিত্রশিল্প বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেকালের চিত্রাঙ্কনে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ উভয় বিষয়বস্তুকেই গুরুত্ব দেওয়া হত। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের মাঝামাঝি সময়ে সুরজগড় জেলার রামগড় পাহাড়ে মূর্তি চিত্রের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গেছে। রামগড়ের যোগিমারা গুহায় যে মনুষ্য চিত্রগুলি পাওয়া গেছে, তাদের সাথে সাঁচীর রিলিফের মিল দেখা যায়।
গুপ্তযুগে ভারতে চিত্রকলা চর্চা উন্নতমানে পৌঁছেছিল। চিত্রশিল্পের মর্যাদা এযুগে বৃদ্ধি পায়। বাৎসায়ন তাঁর ‘কামসূত্রে’ চিত্রশিল্পকে চৌষট্টি কলার অন্যতম বলেছেন। কালিদাস তাঁর ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নাটকে চিত্রশালার উল্লেখ করেছেন। অবশ্য তখন চিত্রশালা সংগীত শালার একটি অংশরূপ বিবেচিত হত। নৃত্য, গীত ও নাটকের অনুশীলন কেন্দ্রের দেওয়ালে নানা ধরনের চিত্র সাজিয়ে রেখে পরিবেশকে শিল্পচর্চার উপযোগী করা হত। বিশাখদত্ত ‘ভিত্তিচিত্র কে সাহিত্যিক অলঙ্কার হিসেবে প্রয়োগ করেছেন। দক্ষিণ ভারতের কানহেরি, ঔরঙ্গাবাদ, পিতল খেরার গুহাগুলিতে চিত্রাঙ্কনের ছাপ অস্পষ্টভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে চিত্রশিল্পের প্রকৃত নিদর্শন পাওয়া গেছে বাঘ, অজন্তা এবং বাদামির গুহাগুলিতে। এদের মধ্যে চিত্রশিল্পের আদর্শ দৃষ্টান্ত দেখা যায় অজন্তার গুহা চিত্রে।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে কয়েকজন বৌদ্ধভিক্ষু লোকালয় থেকে দূরে শান্তিতে ধর্মচর্চার জন্য অজন্তা স্থানটিকে বেছেছিলেন। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতক থেকে সপ্তম শতক পর্যন্ত অজন্তায় মোট চারটি চৈত্য বা সমবেত উপাসনাস্থল ও সন্ন্যাসীদের থাকার জন্য পঁচিশটি বিহার তৈরি করা হয়। এখানে একটি বৌদ্ধ-বিশ্ব-বিদ্যালয়ও ছিল। সেখানে ধর্ম, দর্শন, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদির চর্চা হত। কালক্রমে অজন্তা পরিত্যক্ত হয় এবং ঝোপ-জঙ্গলে আবৃত হয়ে পড়ে। চামচিকা, বাদুড়, পেঁচা জাতীয় প্রাণীর বাসস্থান হয়ে ওঠে এই পরিত্যক্ত গুহাগুলি। দীর্ঘকাল পরে উনিশ শতকে একজন অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ কর্মচারী শিকার করতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে অজন্তার সম্পদ আবিষ্কার করেন। প্রায় হাজার বছর অনাদর, অবহেলায় পড়ে থাকা এবং চামচিকে, বাদুড়ের উপদ্রবে অজন্তার বহু সুন্দর সৃষ্টি শ্রীহীন হয়ে যায়। পর্যটকদের উচ্ছৃঙ্খল ক্রিয়াকলাপের ফলে অবশিষ্ট বহু নিদর্শন নষ্ট হয়ে যায়। প্রাথমিক পর্বে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের আগে অজন্তার ৯নং ও ১০নং গুহায় চিত্র শিল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের নিদর্শন পাওয়া যায়। এই পর্বের চিত্রে রঙের প্রয়োগ দেখা যায়। তবে চিত্রিত মানুষদের মানসিক ভাবের কোন প্রকাশ এই দুটি গুহাচিত্রে দেখা যায়নি। গুপ্তযুগের চিত্রশিল্প প্রসঙ্গে অজন্তার পাঁচটি গুহা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি হল ১৬ নং, ১৭ নং, ১৯ নং, ১ নং এবং ২ নং গুহা। পার্সি ব্রাউনের মতে, ৯ নং এবং ১০ নং গুহার কাজ হয়েছিল আনুমানিক ১০০ খ্রিস্টাব্দে। ১৬ নং ও ১৭ নং গুহাচিত্রের সময়কাল আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টাব্দ। ১ নং ও ২ নং গুহাচিত্রের কাজ হয়েছিল আনুমানিক ৬২৬-৬২৮ খ্রিস্টাব্দে। অজন্তার ত্রিশটি গুহার দেওয়ালই চিত্রিত ছিল। তবে অবশিষ্টগুলির অধিকাংশ চিত্র নষ্ট হয়ে গেছে।
অজন্তার চিত্রাবলীতে বুদ্ধ ও বুদ্ধের জীবনকাহিনী অর্থাৎ জাতকের বিবরণ বিষয়বস্তু হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রাসাদ দৃশ্য, যুদ্ধযাত্রা, দরবারের দৃশ্য, সাধারণ মানুষের মুখের বিভিন্ন অভিব্যক্তি, ফল, ফুল, পাখি, পশু ইত্যাদিও চিত্রাঙ্কনে স্থান পেয়েছে। ১৬ নং গুহার চিত্রাবলী বৌদ্ধ ভারতের গুহামন্দিরগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। এই গুহার ছাদের নিম্নপৃষ্ঠ বিচিত্র সুন্দর সব চিত্রে সুশোভিত। তবে এদের অধিকাংশ কালের প্রকোপে নষ্ট হয়ে গেছে। গুহার হলের বামদিকের প্রাচীর গাত্রে এক মরণ পথযাত্রী রাজকুমারীর চিত্র অঙ্কিত আছে। শিল্প-সমালোচক মুকুল দের মতে, জগতের শিল্পকলার ইতিহাসে এর চেয়ে মনোরম চিত্র আছে কিনা সন্দেহ। এছাড়া রাজগৃহের পথে মগধের রাজা ও বুদ্ধ চিত্রটিও অতি মনোরম। ১৭ নং গুহার হল-এর ডানদিকের প্রাচীর গাত্রে বিজয়সিংহের লঙ্কায় অবতরণ এবং লঙ্কা বিজয়ের এক বিশাল চিত্রকল্প আছে। গৌতম ‘বুদ্ধত্ব’ প্রাপ্তির পর যখন তাঁর স্ত্রী ও পুত্রের নিকট যান, সে সময়কার একটি মনোরম চিত্র এই গুহায় আছে। এই চিত্রকলা প্রসঙ্গে মুকুল দে বলেছেন, ‘প্রগাঢ় প্রেম ও গভীর ধর্মানুরাগের নিদর্শন এই চিত্রটি মহিমায় ও স্নিগ্ধতায় পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ভারতীয় শিল্পকলাকে কতটা উন্নতি করেছিল এটি সেই সত্য উদ্ঘাটিত করবে।’ ১ নং গুহার বাইরের অংশ অতি মনোরম নানা কারুকার্য সমন্বিত এবং অপরূপ চিত্রে শোভিত। এই সকল চিত্র ভারতবর্ষে বৌদ্ধ শিল্পকলার উচ্চ আদর্শের দৃষ্টান্ত। ২ নং গুহার চিত্রাবলী অন্য চারটি গুহার তুলনায় রঙের প্রয়োগ ও নির্মাণ রীতির দিক থেকে শ্রেষ্ঠ।
অজন্তার গুহায় বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর পদ্মপানির চিত্রকল্পটি খুবই মনোরম। এখানে পদ্মপানি ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান। মাথায় মনিমুক্তাখচিত মুকুট, ডান হাতে একটি শ্বেতপদ্ম। তাঁর মুখশ্রী শান্ত কিন্তু বেদনার ছাপ স্পষ্ট। করুণাঘন দৃষ্টি অবনত, যেন বহু দূরে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাঁর কোমল ওষ্ঠে অসংখ্য মানুষের জন্য সান্ত্বনার বাণী উচ্চারিত হচ্ছে। শিল্প সমালোচকদের মন্তব্য থেকে অজন্তার গুহা চিত্রাবলীর মহত্ত্ব, অভিনবত্ব ও শিল্পশৈলীর উন্নতমান সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। হিউয়েন সাঙ অজন্তা পরিদর্শন করে বলেছিলেন, ‘যা কিছু মহৎ এবং যা কিছু ক্ষুদ্র’ সবই অজন্তার গুহা প্রাচীরে চিত্রিত হয়েছিল। লেডি হেরিংহাম লিখেছেন, ‘মোটের উপর (অজন্তার) অঙ্কন মধ্যযুগের ইতালীয় অঙ্কনের মত। ভাবভঙ্গী প্রকাশের ক্ষমতা শিল্পীদের পূর্ণ মাত্রতেই ছিল। তাঁদের আদর্শ ও অবস্থা, ভাবভঙ্গী ও সৌন্দর্যের জ্ঞান অতি আশ্চর্যজনক। কতকগুলি রং ফলানোর পরিকল্পনা খুবই অপূর্ব ও চিত্তাকর্ষক’। অধ্যাপক ফিশার লিখেছেন যে, ‘এক একটি চিত্রে চোখের হাসি থেকে শুরু করে অঙ্গুলীর অগ্রভাগের গতিবিধির মধ্য দিয়ে এমন সুষ্ঠুতা ও সজীবতা ব্যক্ত হয়ে উঠেছে যে শিল্পকলার দিক থেকে লিওনার্দোর চিত্রই তাদের সাথে তুলনার যোগ্য।
অজন্তা ছাড়া গোয়ালিয়র রাজ্যের অন্তর্গত বাগ গুহার চিত্রগুলিও গুপ্তযুগের। ৩ নং ও ৪ নং গুহা দুটির চিত্র এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। বাগ গুহাচিত্রের বিষয়বস্তু অজন্তার মতই বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম। বাগের তিনটি গুহাচিত্র উল্লেখযোগ্য। একটিতে আছে অনেকগুলি হাতির সারিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল শোভাযাত্রার দৃশ্য। দ্বিতীয়টি হল নর্তকী ও গায়িকাদের জীবনদৃশ্য এবং তৃতীয়টি জনৈকা চৌরি বহনকারী নারী। অঙ্কনশৈলীর বিচারে অজন্তা চিত্রের সাথে বাগ গুহাচিত্রের সাদৃশ্য আছে। তবে মূর্তিগুলির প্রকাশভঙ্গী বা অভিব্যাক্তি হূবহু এক নয়। অজন্তার চিত্রাবলী ধর্মনিরপেক্ষ হলেও, পার্থিবতার পাশাপাশি একটা অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মভাব বজায় ছিল। মূর্তিগুলির চক্ষুদ্বয় ও মুখমণ্ডলে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও নিরাসক্তির প্রকাশ দেখা যায়। কিন্তু বাগের চিত্রগুলি অনেক বেশি পার্থিব। বোধিসত্ত্বের মূর্তিগুলি কোন প্রকার অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা উদ্ভাসিত নয়। তুলনামূলকভাবে মানবিক ও আভিজাত্যমণ্ডিত। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে উৎকীর্ণ বাগগুহার চিত্রাবলী অলংকরণ ও পরিকল্পনার বিচারে অজন্তার সমপর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল বলেই শিল্প সমালোচকরা মনে করেন।
অজন্তা ও বাগ-এর গুহাচিত্র অঙ্গনের আঙ্গিক প্রায় অনুরূপ। প্রথমে গুহার ভেতরের দেওয়ালে কাদামাটি, গোবর ও লালমাটির মিশ্রণ করে একটা ‘বজ্রলেপ’ দেওয়া হত। এটিকে পুরু করার জন্য মাঝে মাঝে তুঁষ মেশানো হত। এই বজ্রলেপের উপর পাতলা করে চুনের একটা আস্তরণ দেওয়া হত। চুনের আস্তরণ ভিজে থাকা অবস্থায় তার উপর বিভিন্ন রঙের প্রলেপ দেওয়া হত। প্রথমে একটা হাল্কা নক্সা এঁকে নেওয়া হত। নানা রঙের ব্যবহার দিয়ে উঁচু-নিচু অংশ বোঝানো হত। সেকালে ব্যবহৃত রংগুলির মধ্যে প্রধান ছিল গাঢ় লাল, গেরুয়া-লাল, গেরুয়া-হলুদ, কালো, সবুজ, নীল ইত্যাদি। রঙের বিচক্ষণ প্রয়োগ দ্বারা চিত্রগুলিকে ত্রিমাত্রিকতা গুণ বিশিষ্ট করার দক্ষতা শিল্পীরা দেখিয়েছেন। ডা. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ তাঁর ‘প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস’ (১৩৫৫ বং) গ্রন্থে লিখেছেন, ‘কে জানে যুগ যুগ ধরে কত ভারতীয় মিকেল এঞ্জেলো, রাফায়েল, লিওনার্দো, বাত্তিচেলি সমাহিত চিত্তে অজন্তা, বাগ প্রভৃতি স্থানে অনুপম সৃষ্টি করেছিলেন। ভারতবর্ষ আজ সে শিল্পীদের নামও জানে না।’