পরস্পর-বিরোধী শ্রেণী-স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণীসংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী: শ্রেণী-বিভক্ত সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী থাকে। সমাজে এই সমস্ত শ্রেণীর স্থান ও স্বার্থ পরস্পর বিরোধী। সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় কোন একটি শ্রেণীর অবস্থান ও ভূমিকা সংশ্লিষ্ট শ্রেণীর স্বার্থ নির্দিষ্ট করে দেয়। প্রত্যেক শ্রেণী তার স্বার্থ সুরক্ষিত করার ব্যাপারে অটল থাকে। ভিন্নমুখী স্বার্থের মধ্যে মীমাংসা বা সমঝোতা সম্ভব হয় না। তখন সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শনের মূলকথা (The Fundamentals of Marxist Leninst Philosophy) গ্রন্থে বলা হয়েছে: “The class-struggle is evoked by the diametrically opposed social positions and contradictory interest of different classes.” শ্রেণীবিভক্ত যে কোন সমাজে যাবতীয় সম্পদ ও মুনাফা কুক্ষিগত করে উৎপাদন-উপাদানের মালিক শ্রেণী। এই শ্রেণীর মুনাফার পরিমাণ দ্রুতহারে স্ফীত হতে থাকে। তার ফলে শ্রেণীবৈষম্য বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় পরস্পর-বিরোধী স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পত্তিবান শোষক শ্রেণী সম্পর্কে সম্পত্তিহীন শোষিত শ্রেণীর মনে বৈরী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। এই মনোভাব প্রকট ও প্রবল হয়ে উঠে। তখন এই দুটি শ্রেণীর মধ্যে সংগ্রাম আর এড়ান যায় না।
উৎপাদন-উপাদানের মালিকানার পরিবর্তনের জন্য শ্রেণী-সংগ্রাম অপরিহার্য: যে উৎপাদন-ব্যবস্থা সমাজকে শ্রেণীবিভক্ত করে তাই আবার শ্রেণী-সংঘর্ষেরও সৃষ্টি করে। উৎপাদন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে পরস্পর বিরোধী দুটি শ্রেণীর অবস্থান শ্রেণী দুটির স্বার্থের ভিতরে সংঘাতকে অনিবার্য করে তোলে। মিলিবাও বলেছেন: “Domination and conflict are inherent in class societies, and are based on specific, concrete features of their mode of production. They are rooted in the process of extraction and appropriation of what is produced by human labour.” শ্রেণী-বিভক্ত সকল সমাজেই মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে উৎপাদন-উপাদানের মালিকানা ন্যস্ত থাকে। এই শ্রেণী হল সমাজে সংখ্যালঘিষ্ট। উৎপাদন শক্তির মালিকানা এদের হাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। তার ফলে উৎপাদিত সম্পদ এবং মুনাফার অধিকারী হয় এই শ্রেণী। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বা উৎপাদন উপাদানের মালিকানাহীন শ্রেণীর উৎপাদিত সম্পদে তাদের যে ন্যায্য অংশ থাকে, তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। এরা হল প্রলেতারিয়েত। উৎপাদিত সম্পদের এই অন্যায্য বণ্টনের শিকার হয় তারা। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তাদের দিন কাটাতে হয়। এই অবস্থায় এই শ্রেণী উৎপাদন-উপাদানের মালিকানার পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে বাধ্য হয়। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর এই মূল উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন সম্ভব হবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসানের মাধ্যমে। সুতরাং সম্পত্তিহীন শ্রেণীর স্বার্থ পুঁজিবাদের অবসানের মধ্যেই নিহিত আছে। আবার এই শ্রেণী স্বার্থ ও শ্রেণী সচেতনতা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই শ্রেণী-সচেতনতা ব্যতিরেকে শ্রেণী-সংগ্রাম হতে পারে না।
শ্রেণী-স্বার্থের বিরোধ মীমাংসার অতীত: বৈষম্যমূলক যে-কোন সমাজের দুটি মুখ্য শ্রেণী থাকে। এই দুটি শ্রেণীর স্বার্থ হল পুরোপুরি পরস্পরের বিরোধী। মুখ্য দুটি শ্রেণীর স্বার্থের এই বিরোধিতা মীমাংসার অতীত। এই কারণে শ্রেণী-সংগ্রামে অবশ্যম্ভাবী। সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থ শোষণের উপর নির্ভরশীল। তাদের অস্তিত্বই শোষণ ছাড়া অসম্ভব। আবার এই লাগামছাড়া শোষণ সম্পত্তিহীনদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে। এই শোষণের বিরোধিতা তাদের করতেই হয়। কারণ তা না হলে তাদের টিকে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় প্রলেতারিয়েত শ্রেণী তাদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং শোষণের অবসানের জন্য সংগ্রামের সামিল হয়।
শ্ৰেণী-সংগ্রাম অনিবার্য: মার্কস-এঙ্গেলস-এর মতানুসারে প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান আবশ্যক। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল থাকাকালীন সময়ে মেহনতী মানুষের অবস্থার উন্নতি অসম্ভব। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিকশিত হতে থাকলে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে বৈষম্য ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। তার ফলে সমকালীন দুটি মুখ্য শ্রেণীর মধ্যে বৈরিতাও বাড়তে থাকে। আবার শোষণ ছাড়া পুঁজিপতিরা তাদের অস্তিত্ব ও মর্যাদা বজায় রাখতে পারে না। সুতরাং শোষণকে অব্যাহত রাখতে এবং এমনকি বৃদ্ধি করতে বুর্জোয়ারা বদ্ধপরিকর। এই অবস্থায় শ্রেণী দুটির মধ্যে বৈরিতা হ্রাসের কোন রকম সম্ভাবনা থাকে না। সুতরাং শ্রেণী-সংগ্রাম এড়ানো অসম্ভব।
শ্রেণী-সংগ্রামের ভূমিকা ইতিবাচক: মার্কস-এঙ্গেলস-এর অভিমত অনুসারে শ্রেণী-সংগ্রাম সমাজ বিকাশের পথে বাধার সৃষ্টি করে না। বরং সমাজ-বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান চালিকা শক্তি হিসাবে শ্রেণী সংগ্রামের ভূমিকা ইতিবাচক। পুরাতন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অবসান এবং নতুন ও অগ্রবর্তী একটি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শ্রেণী-সংগ্রাম একান্তভাবে অপরিহার্য। তবে এ ক্ষেত্রে সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। শ্রেণী-সংগ্রাম উৎপাদন শক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি, শ্রম-সময় হ্রাস এবং সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি সম্ভব হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে ও বিস্তারের মাধ্যমে। আবার প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রেও শ্রেণী-সংগ্রাম সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে। শ্রেণী সংগ্রামের প্রভাবে উৎপাদন শক্তি বিকশিত হয়। এবং বিকশিত উৎপাদন শক্তির প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি হিসাবে পুরাতন উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন সাধিত হয়। সুতরাং সমাজ-বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণী-সংগ্রামের ভূমিকা নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক।
মার্কসবাদী চিন্তাবিদরা শ্রেণী-সংগ্রামের প্রকারভেদ সম্পর্কেও আলোচনা করে থাকেন। সাধারণভাবে তাঁরা তিনভাগে শ্রেণী-সংগ্রামকে বিভক্ত করার পক্ষপাতী। এই তিনটি ভাগ হল : অর্থনীতিক শ্রেণী সংগ্রাম, রাজনৈতিক শ্রেণী-সংগ্রাম ও মতাদর্শগত শ্রেণী-সংগ্রাম।
আর্থনীতিক শ্রেণী-সংগ্রাম: সর্বপ্রথম আর্থনীতিক দাবি দাওয়া আদায় করার জন্য মেহনতী নামুষেরা সংগ্রামের সামিল হয়। শ্রমজীবী সম্প্রদায় আর্থনীতিক দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতেই সংগ্রাম শুরু করে। এই শ্রমিক শ্রেণীর আর্থনীতিক দাবি-দাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মজুরী বৃদ্ধি দাবি, শ্রম-সময় হ্রাসের দাবি, কাজের পরিবেশ ও তাদের উন্নতি সাধনের দাবি প্রভৃতি। এই সমস্ত দাবির ভিত্তিতে সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামই হল আর্থনীতিক সংগ্রাম। আর্থনীতিক সংগ্রামের সাৎল্যের স্বার্থে শ্রমজীবী মানুষ শ্রমিক সংগঠন, সাহায্য তহবিল প্রভৃতি গড়ে তোলে। শ্রমিকদের সংঘ-সংগঠন মালিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর আর্থনীতিক সংগ্রামকে পরিচাহিত করে। শ্রেণী-সংগ্রামের উপরি-উক্ত ত্রিবিধ প্রকাশের মধ্যে আর্থনীতিক শ্রেণী-সংগ্রামই হল সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ। বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয়েছে এই আর্থনীতিক শ্রেণী-সংগ্রামের। আর্থনীতিক দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য এই সংগ্রামের সামিল হয়ে শ্রমিক শ্রেণী তার শ্রেণী-চেতনাকে সমৃদ্ধ করে। ব্যাপকভাবে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহরের ফলে আর্থনীতিক সংগ্রাম প্রবল ও ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই আর্থনীতিক সংগ্রামের প্রবল চাপে মালিক শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীর ন্যায্য দাবি-দাওয়ার অনেক কিছুই মেনে নিতে কার্যত বাধ্য হয়। তার ফলে শ্রমিক শ্রেণীর বৈষয়িক অবস্থার উন্নতি ঘটে।
রাজনৈতিক শ্রেণী-সংগ্রাম: শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম চূড়ান্ত বিচারে আর্থনীতিক দাবি-দাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। আর্থনীতিক দাবি-দাওয়া আদায় করার জন্য শ্রমিক শ্রেণী সংগ্রাম শুরু করে। এ কথা ঠিক। কিন্তু আর্থনীতিক দাবি-দাওয়া আদায় করাই শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। আর্থনীতিক সংগ্রামের অংশীদার হিসাবে শ্রমিকশ্রেণীর সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। তারা বুঝতে পারে যে শোষণের হাত থেকে স্থায়ী মুক্তির জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা দরকার। এই উদ্দেশ্যে শ্রমিক শ্রেণী সামগ্রিকভাবে পুঁজিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম সংগঠিত করে। এই সংগ্রামকে বলা হয় রাজনৈতিক শ্রেণীসংগ্রাম। শ্রমজীবী মানুষ তাৎক্ষণিক বিভিন্ন বৈষয়িক দাবি-দাওয়া আদায় করার জন্য আর্থনীতিক শ্রেণী-সংগ্রামের সামিল হয়। কিন্তু রাজনৈতিক শ্রেণী-সংগ্রামের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য আলাদা। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করাই হল রাজনৈতিক শ্রেণী-সংগ্রামের আসল উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল না করা পর্যন্ত রাজনৈতিক শ্রেণী-সংগ্রাম চলতে থাকে। সুতরাং পর্যায়গত বিচারে রাজনৈতিক শ্রেণী-সংগ্রাম হল শ্রমিক শ্রেণীর বাচ্চ শ্রেণী-সংগ্রাম। এই শ্রেণী সংগ্রাম সমগ্র দেশ জুড়ে সংগঠিত ও পরিচালিত হয়। রাজীনৈতিক শ্রেণী-সংগ্রামের ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা এবং শ্রেণী-সচেতনতা বিশেষভাবে দরকার। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণ-পীড়ন ও অন্যায় অত্যাচারের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
মতাদর্শগত শ্রেণী-সংগ্রাম: মতাদর্শগত শ্রেণী-সংগ্রাম হল শ্রেণী-সংগ্রামের আর একটি প্রকাশ। লেনিনের অভিমত অনুসারে পুঁজিপতি শ্রেণীর শোষণের হাত থেকে চিরতরে মুক্তি লাভের জন্য শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক সংগ্রাম ব্যাপক ও নিবিড় হওয়া দরকার এবং রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল করা দরকার। এই প্রত্যয় ও চেতনা এক বিশেষ মতাদর্শের জন্ম দেয়। সেই মতাদর্শের ভিত্তিতে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম পরিচালিত হওয়া দরকার। তা হলেই শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য এবং সংগ্রামের সাফল্য সুনিশ্চিত হবে। শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেণী সচেতনতা ছাড়া পুঁজিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণী-সংগ্রাম পরিচালিত হতে পারে না। এই শ্রেণী-সচেতনতার ব্যাপক বিকাশের ফলে তা মতাদর্শের পর্যায়ে উন্নীত হয়। এই মতাদর্শের সাহায্যে পুঁজিবাদের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রলক্ষণগুলি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের মতানুসারে মতাদর্শগত শ্রেণী-সংগ্রাম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মতাদর্শগত শ্রেণী সংগ্রাম ব্যতিরেকে শ্রেণী স্বার্থ এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রলক্ষণগুলি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যায় না।
সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত শ্রেণী-সংগ্রাম চলবে: মার্কস-এঙ্গেলস-এর অভিমত অনুসারে শ্রেণী-সংগ্রামই হল মুক্তির একমাত্র উপায় বা হাতিয়ার। লেনিনের মতানুসারে শ্রেণী-সংগ্রামের মুখ্য লক্ষ্য হল প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণী-সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটে না। পুঁজিপতি শ্রেণীও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহের বিলোপসাধন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত শ্রেণী-সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা থাকে। দ্বান্দ্বিকতার সূত্র অনুসারে যে পর্যন্ত না সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়, সে পর্যন্ত শ্রেণী-সংগ্রাম চলতে থাকবে। বৈষম্যমূলক ও বিরোধমূলক কোন সমাজই শ্রেণী সংগ্রাম থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।
শ্রেণী ও শ্রেণী-সংগ্রাম সম্পর্কিত সমালোচনা
শ্রেণী ও শ্রেণী-সংগ্রাম সম্পর্কিত মার্কসীয় আলোচনা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। অ-মার্কসবাদী চিন্তাবিদরা শ্রেণী ও শ্রেণী-সংগ্রাম বিষয়ক মার্কসবাদী বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করে থাকেন। বিরুদ্ধবাদীদের যুক্তিগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে বিন্যস্ত করা যায়।
(১) অতি সরলীকরণ: সমালোচকদের অভিমত অনুসারে মার্কসবাদে শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্ব অতি সরলীকরণ দোষে দুষ্ট। মার্কসবাদে শ্রেণী সংগ্রাম ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সমাজের দু’টি মুখ্য শ্রেণীর মধ্যে বিরোধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী ও গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত সমাজে শ্রেণী-সংগ্রামের বিষয়টি বিশেষভাবে জটিল। একে অতি সহজভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়। না। বাস্তবে বিত্তবান ও বিত্তহীন বা শোষক ও শোষিত শ্রেণী ছাড়াও বিভিন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। অভিজ্ঞতা থেকে বলা হয় যে কোন কালেই কোন দেশের জনগণকে সুস্পষ্ট দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় না।
(২) সরল সংগ্রাম শ্রেণী-সংগ্রাম নয়: সমালোচকদের মতে সমাজে বিভিন্ন কারণে সংঘাত-সংগ্রামের সৃষ্টি হতে পারে। এই সমস্ত সংগ্রামকেই শ্রেণী-সংগ্রাম হিসাবে অভিহিত করা যায় না। যেমন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণের ভিত্তিতে সমাজে সংগ্রামের সৃষ্টি হতে পারে এবং হয়ও। তেমনি আবার ধর্মকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ঘটতে পারে। মানবজাতির ইতিহাসে এমন সংগ্রামের নজিরের অভাব নেই। এরকম সংঘর্ষের ঘটনা মধ্যযুগে বহু ঘটেছে এবং এখনও ঘটে। কিন্তু এই সমস্ত সংগ্রামকে শ্রেণী-সংগ্রাম বলা যায় না। মার্কসীয় তত্ত্বে কেবল আর্থনীতিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণী-সংঘাতের কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু আর্থনীতিক স্বার্থ ছাড়াও বিভিন্ন কারণে সমাজে সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে।
(৩) শ্রেণী-সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী নয়: সমাজে মুখ্য দু’টি শ্রেণী থাকলে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে শ্রেণী-শত্রুতার সম্পর্ক, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। শ্রেণী দু’টির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যদি শত্রুতার না হয় তা হলে শ্রেণী সংগ্রাম সৃষ্টির কোন সম্ভাবনা থাকে না। আবার শ্রেণী দু’টির পারস্পরিক সম্প যদি বিরোধিতার সম্পর্কও হয়, তাহলেও শ্রেণী-সংগ্রাম দেখা দেবেই তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ কোন বিরোধই সীমাংসার অতীত নয়। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শ্রেণী-দু’টির মধ্যেকার যাবতীয় বিরোধ-বিতর্কের মীমাংসা সম্ভব।
(৪) তৃতীয়-দুনিয়ার দেশগুলির ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়: সমালোচকদের মতানুসারে শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রাম সম্পর্কিত মার্কস-এঙ্গেলস-এর বিচার-বিশ্লেষণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ক্ষেত্রে খাটে না। এঁদের অভিমত অনুসারে ব্রিটিশ ও মার্কিন পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কস-এঙ্গেলস শ্রেণী ও শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্বটি খাড়া করেছেন। কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকার শিল্পোন্নত দেশগুলির পুঁজিপতি ও প্রলেতারিয়েতের আকৃতি-প্রকৃতির সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির পুঁজিপতি ও প্রলেতারিয়েতের চেহারাচরিত্রের তুলনা চলে না। এ প্রসঙ্গে মিলিবাও (Ralph Miliband) তাঁর Marxism and Politics শীর্ষক গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি একেবারে অন্য রকম। সুতরাং মার্কসবাদী বিচার-বিশ্লেষণ এ ক্ষেত্রে তেমন প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হতে পারে না।
(৫) শ্রমিক শ্রেণী ও প্রলেতারিয়েতের মার্কসীয় ধারণা স্পষ্ট নয়: মার্কসীয় শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্বে ‘শ্রমিক শ্রেণী’ কথাটির ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং শ্রমিক শ্রেণী সম্পর্কে ধারণাটি পরিষ্কার হওয়া দরকার। শ্রমিক শ্রেণী, প্রলেতারিয়েত প্রভৃতি কথাগুলি যথাযথভাবে অনুধাবন করা না গেলে শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বটি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যাবে না। অথচ মার্কস-এঙ্গেলস এই ধারণা দুটি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তেমন আলোকপাত করেননি। সমালোচকদের মতানুসারে শ্রেণী-সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সমাজের অনেক ব্যক্তিকেই শ্রেণী-বিন্যস্ত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে সরকারী কর্মচারী, সৈন্যবাহিনীর সদস্য, পুলিশ বাহিনীর সদস্য প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গের কথা বলা যায়। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে এই সমস্ত ব্যক্তি কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবেন তা বলা মুশকিল।
(৬) বর্তমানে শ্রেণী-সংগ্রাম অপ্রয়োজনীয়: শ্রমিক শ্রেণীর আর্থিক অবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো। বর্তমানে শ্রমিক শ্রেণী অনেক বেশি সংঘবদ্ধ। মালিক শ্রেণীর সঙ্গে দরকষাকষির ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণী এখন আর অসহায় অবস্থায় নেই। মালিকপক্ষের উপর কার্যকর চাপসৃষ্টির ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণী এখন অনেক অনুকূল অবস্থায় অবস্থিত। এই কারণে শ্রমজীবী মানুষের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বর্তমানে আগের থেকে অনেক বেশি বেড়েছে। মেহনতী মানুষের মজুরী বেড়েছে, কাজের শর্তাদির উন্নতি সাধিত হয়েছে। অথচ পুঁজিপতিদের মুনাফা কিন্তু হ্রাস পায়নি। সমালোচকদের অভিমত অনুসারে এই অবস্থায় শ্রমিক শ্রেণীর দিক থেকে শ্রেণী-সংগ্রাম অপ্রয়োজনীয় প্রতিপন্ন হয়।
(৭) পুঁজিপতি বা প্রলেতারিয়েত কারুরই কোন স্থায়ী বৈশিষ্ট্য নেই: সমালোচকদের অভিমত অনুসারে পুঁজিপতি শ্রেণী বা প্রলেতারিয়েত শ্রেণী সমাজের এই দুটি শ্রেণীর কোনটাই সমজাতীয় বা স্থায়ী বৈশিষ্ট্যযুক্ত নয়। মানবসবাজ ও সমাজের অধিবাসীদের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ নিয়ম হল পরিবর্তনশীলতা। সামাজিক সচলতার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায় না। নানা কারণে পুঁজিপতি শ্রেণীর ক্ষমতার হ্রাস ঘটেছে এবং স্থায়িত্ব বিপন্ন হয়েছে। এই সমস্ত কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : সম্পত্তির মালিকানার বিকেন্দ্রকরণ, রাজনৈতিক ক্ষমতার গণতন্ত্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ, সর্বজনীন প্রাপ্ত-বয়স্কের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি প্রভৃতি। বর্তমানে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যেও কারিগরি দক্ষতার বিচারে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক সমাজ-সভ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক সচলতার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। শ্রমিক শ্রেণীর সংহতির উপর এই সামাজিক সচলতার প্রতিকুল প্রভাব বিশেষভাবে প্রতীয়মান হয়। তা ছাড়া বর্তমানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার ফলেও এখন শ্রমিকশ্রেণীর প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক কমেছে।
(৮) জাতীয়তাবাদের প্রভাব অস্বীকৃত: মার্কসবাদ-বিরোধীদের মতানুসারে শ্রেণী ও শ্রেণী-চেতনার থেকে জাতীয় ভাব বা জাতীয়তাবাদের ক্রিয়া অধিক শক্তিশালী। কিন্তু মার্কসবাদে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিরোধ এবং জাতীয়তাবাদের কার্যকর প্রভাবকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে জাতিসমূহের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রভাব ক্রমবর্ধমান। বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের ক্ষেত্রেও এ কথা সমভাবে প্রযোজ্য। তাই দেখা যায় যে সমাজতান্ত্রিক দেশের জনগণ এবং কমিউনিস্ট পার্টি তাদের সরকারের যুদ্ধায়োজনকে সমর্থন জানায়। দেশ ও জাতির প্রতি মানুষের আনুগত্য প্রবল হয়। এই আনুগত্যের ভিত্তিতে শ্রেণী-স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ সংগ্রামের সামিল হতে পারে। এই কারণে সমালোচকদের অভিমত হল এই যে, মার্কসবাদে কেবল শ্রেণী-দ্বন্দ্ব ও আর্থনীতিক দ্বন্দ্বের উপর গুনীতিক দ্বন্দ্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং বাস্তব অবস্থাকে উপেক্ষা করা হয়।
(৯) সামাজিক সচলতার প্রভাব: শোষক শ্রেণী অথবা শোষিত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকাটা কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট থাকে না। আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজে সামাজিক সচলতার ক্রিয়া বা প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ। এখনকার মুক্ত সমাজে এই সামাজিক সচলতার গতিও বেশ লক্ষণীয়। এই অবস্থায় একটি সামাজিক স্তর থেকে অন্য একটি সামাজিক স্তরে ব্যক্তিবর্গের গমনাগমনের সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকে।
(১০) বটোমোরের অভিমত: বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ বটোমোর মর্যাদাভিত্তিক ক্রমস্তরবিন্যস্ত এক সামাজিক কাঠামোর উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতানুসারে বর্তমানে শ্রেণী-চেতনার প্রসার বহুলাংশে রুদ্ধ হয়েছে। এর কারণ হিসাবে তিনি মর্যাদাভিত্তিক গোষ্ঠীর বিকাশ ও বিস্তারের কথা বলেছেন। বিভিন্ন স্তরে এই সমস্ত গোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক বিরোধিতার নয়। এই সম্পর্ক হল প্রতিযোগিতার।
(১১) রাষ্ট্র শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র নয়: মার্কসীয় দর্শন অনুসারে রাষ্ট্র হল শ্রেণী-শোষণের যন্ত্রবিশেষ। কিন্তু আধুনিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রকে শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র বলা যায় না। বর্তমানে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সক্রিয় সহযোগিতায় শোষণ, অত্যাচার ও নিপীড়নকে রোধ করে সমাজের ব্যাপক কল্যাণ সাধন সম্ভব হয়েছে। সুতরাং এখনকার এই জনকল্যাণব্রতী রাষ্ট্রকে শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার বা অত্যাচার-নিপীড়নের যন্ত্র হিসাবে অভিহিত করা যায় না।
(১২) শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজ কাল্পনিক বিষয়: সমালোচকদের মতে মার্কসবাদীরা শ্রেণী-সংগ্রামের ফলশ্রুতি হিসাবে সর্বহারা শ্রেণীর জয়লাভ এবং শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে অতিমাত্রায় আশাবাদী। ল্যাস্কি বলেছেন: “The break-down of capitalism might result not in communism but in anarchy from which there might emerge some dictatorship unrelated in principle to communist ideals.” অনেকের মতে শ্রেণীহীন সমাজ বাস্তব নয়, কাল্পনিক। সর্বহারা শ্রেণীর জয়লাভের পরও নতুন এক সুবিধাভোগী শ্রেণীর সৃষ্টি হতে পারে। তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অংশীদার বা যন্ত্রবিদ বা পরিচালক হতে পারে।
(১৩) সহযোগিতামূলক পথেও সমাজের পরিবর্তন হয়: এক শ্রেণীর সমালোচকের মতে কেবলমাত্র সংগ্রামের মাধ্যমে যাবতীয় সামাজিক পরিবর্তন ঘটে একথা ঠিক নয়। সহযোগিতামূলক উদ্যোগের মাধ্যমেও মানবসমাজের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। এবং ইতিহাসে এমন নজির কম নেই। প্রখ্যাত লেখক স্যাবাইন (Sabine) বলেছেন: “The co-operative side of the relationship must be as normal as the antagonistic.” মানব ইতিহাসের একমাত্র সত্য হিসাবে শ্রেণী-সংগ্রামের কথা বলা যায় না।
(১৪) বর্তমানে একমাত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব: মার্কসবাদ-বিরোধী সমালোচকদের আরও অভিমত হল যে, শ্রেণী ও শ্রেণী-সংগ্রাম সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণা বর্তমানে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়। এই সমালোচকদের মতানুসারে সমাজে দুটি শ্রেণীর অস্তিত্ব এবং শ্রেণী দু’টির মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতার সম্পর্ক এখন আর দেখা যায় না। এঁদের মতে সমাজে এখন বুর্জোয়া বা প্রলেতারিয়েত শ্রেণী নেই। আছে একটি মাত্র শ্রেণী। এই শ্রেণীটি হল মধ্যবিত্ত শ্রেণী। অই অবস্থায় শ্রেণী-সংগ্রামের ধারণা অচল।
মূল্যায়ন: ‘শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্ব আধুনিক অবস্থায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে— মার্কসবাদ বিরোধীদের এই অভিমত মেনে নেওয়া যায় না। প্রকৃত প্রস্তাবে শ্রেণীর অস্তিত্ব এবং শ্রেণী-সংগ্রামের বিষয়টি মার্কস-এঙ্গেলসের আবিষ্কার বলা যায় না। গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর সময়ও শ্রেণী-সংগ্রাম ছিল। মার্কস-এঙ্গেলস কেবল এটাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে শ্রেণীসংগ্রাম হল মানবসমাজের ক্রমবিকাশের প্রধান উপাদান। তাঁরা পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এই কারণে শ্রেণী ও শ্রেণী-সংগ্রাম সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্ব হল বিজ্ঞানসম্মত। তবে এ কথাও ঠিক যে বর্তমানে শ্রমজীবী মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত অনেকেই এখন পরিচালনা সম্পর্কিত কাজকর্মে অংশগ্রহণ করেন। আবার অনেকে অন্যান্য বৌদ্ধিক কাজকর্মও সম্পাদন করে থাকেন। তেমনি আবার অখনকার উন্নত শিল্পসভ্যতার যুগে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়’ পুঁজিবাদের প্রকলতির পরিবর্তন ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের আকৃতি-প্রকৃতিতেও পরিবর্তন এসেছে।
বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রাম সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক তাৎপর্যকে অস্বীকার করা অসম্ভব। যে-কোন সমাজে বিভিন্ন গৌণ শ্রেণীর উপস্থিত সত্ত্বেও উৎপাদন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি পরস্পর বিরোধী মুখ্য শ্রেণীর অস্তিত্ব এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনা ঐতিহাসিক সত্য। মার্কসের মতানুসারে অন্যান্য মধ্যবর্তী গোষ্ঠীগুলির সন্ধিক্ষণের (TRANSITIONAL) চরিত্রসম্পন্ন। দুটি মূল বিবদমান শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকলে মধ্যবর্তী অন্যান্য গোষ্ঠীগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যে-কোন একদিকে ঝুঁকে পড়ে শ্রেণী-সংগ্রামের সামিল হয়ে পড়ে। শ্রেণী-সংগ্রাম বলতে মার্কস এই অর্থে দুটি মূল শ্রেণীস্বার্থের সংঘাতকে বুঝিয়েছেন। আবার কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীর অন্তরালে বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থের পৃষ্ঠপোষকতার কথা অস্বীকার করা যায় না। তা ছাড়া অন্যান্য কারণে সমাজব্যবস্থায় সংঘাতের সৃষ্টি হলেও আর্থনীতিক সংঘাতই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব মার্কসীয় দর্শনের অবদান হিসাবে বিবেচিত হয়।