মার্কসীয় তত্ত্বে নাগরিক সমাজের ধারণা আমরা পাই মার্কসের বিভিন্ন রচনার মধ্যে। মার্কস তাঁর নাগরিক সমাজ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছেন মূলতঃ হেগেলের নাগরিক সমাজের ধারণাকে সমালোচনার মধ্য দিয়ে। হেগেলের মতে নাগরিক সমাজ হচ্ছে পরিবার এবং রাষ্ট্রের অন্তর্বর্তী একটি বিশেষ স্তর যেখানে ব্যক্তি নিবিড় পারিবারিক বন্ধন থেকে বেরিয়ে এসে স্বার্থ সংরক্ষণে তথা ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনে ব্যস্ত থাকে। এই স্তর হচ্ছে এক অবাধ বাজার অর্থনীতির জগৎ, যেখানে স্বাধীন নাগরিক জীবিকা অর্জনে সদাই ব্যস্ত থাকে। ফিলসফি অফ রাইটে হেগেল মন্তব্য করছেন যে নাগরিক সমাজে ব্যক্তির এই স্বাতন্ত্র্য অর্জনের সুযোগ। এক অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা। তবে হেগেল সচেতন ছিলেন যে ব্যক্তির স্বার্থ সংরক্ষণের প্রচেষ্টা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব ইত্যাদির দরুন নাগরিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে। প্রতিযোগিতা একদিকে যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তির পুঞ্জীভবন ঘটাবে, অন্যদিকে তেমনি সৃষ্টি করবে সম্পত্তিহীনতা। এই দ্বন্দ্ব নিরসনে তিনি নাগরিক সমাজের নৈতিক বন্ধনের কথা বলেন। ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতার পাশাপাশি নাগরিক সমাজের সদস্যদের মধ্যে গোষ্ঠী মানসিকতাও বিরাজ করে। অনেকটা বৃহত্তর পরিবারের আদলে এই নৈতিকতা বাজারী অর্থনীতির সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে বিরাজ করে। এবং এই নৈতিকতার মূর্ত প্রকাশ হচ্ছে রাষ্ট্র। নাগরিক সমাজের দ্বন্দ্বগুলির সমাধান ঘটে রাষ্ট্রীয় নৈতিকতা, নিয়ন্ত্রণের আওতায়। নাগরিক সমাজের নৈতিকতা সম্পূর্ণতা লাভ ঘটে যুক্তির আধার রাষ্ট্রের মধ্যে। হেগেলের রাষ্ট্র নাগরিক সমাজ সুলভ ব্যক্তিগত স্বার্থ-নিরপেক্ষ উর্ধ্বগামী একটি আদর্শায়িত প্রতিষ্ঠান হলেও এর মধ্য দিয়েই কিন্তু ব্যক্তির আত্মচৈতন্যের যথার্থ প্রকাশ ঘটে। নাগরিক সমাজের যাবতীয় দ্বন্দ্ব অসংগতির উর্ধ্বে রাষ্ট্র সমাজের সার্বজনিক স্বার্থ/ইচ্ছার প্রতিমূর্তি।
মার্কসও হেগেলকে অনুসরণ করে নাগরিক সমাজকে দেখছেন প্রধানত একটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবে যেখানে চরম স্বার্থপরতা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের প্রতিযোগিতা এবং সেই হেতু এখানে ব্যক্তি নাগরিকের সঙ্গে অন্য ব্যক্তি-নাগরিকের পারস্পরিক হানাহানি সব সময় বিরাজ করে। এই পরিস্থিতি অনেকটা হবস কথিত প্রকৃতির রাজত্বের মত। চরম স্বার্থপর পরস্পর বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি অধ্যুষিত নাগরিক সমাজের সমালোচনা করছেন মার্কস তাঁর প্রথমদিককার নানা লেখায়, বিশেষ করে On the Jewish Question এবং Critique of Hegel’s Philosophy of Right প্রবন্ধে। নাগরিক সমাজে ব্যক্তি চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক, ভোগসর্বস্ব হয়ে ওঠে। এখানেই পরস্পর বিচ্ছিন্ন মানুষের আত্মবিচ্যুতি চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। তাই মার্কসের কাছে নাগরিক সমাজ আলাদা কোন ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয় না। বরং নাগরিক সমাজের যাবতীয় দ্বন্দ্ব বিচ্ছিন্নতা একমাত্র দূর হতে পারে এই ক্ষেত্রে এবং এই ক্ষেত্রের ধারক রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে এক সামাজিক রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে তাঁর প্রথম দিককার রচনায় রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজ সম্পর্কে মার্কস যতটা বিস্তৃত আলোচনা করেছেন পরবর্তী কালে, বিশেষ করে তিনি যখন ঐতিহাসিক বস্তুবাদী পদ্ধতির তত্ত্ব নির্মাণ করেন তখন নাগরিক সমাজ এবং তার নানা দিক সম্পর্কে তিনি অনেকটাই নিরুৎসাহী হয়ে পড়েন। মার্কস পরবর্তী তাত্ত্বিকদের রচনায় এই সম্পর্কে আর কোন উল্লেখ করা হয়নি। মূল ধারার মার্কসীয় চিন্তায় এটিকে বাতিল করা হয়। তবে পরবর্তীকালে গ্রামশ্চীর রচনায় নাগরিক সমাজ এক ভিন্ন অর্থ এবং ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়। নাগরিক সমাজের ধারণাকে নতুন করে বিশ্লেষণ করেন গ্রামশ্চী তাঁর Prison Notebooks-এর অন্তর্ভুক্ত নানা লেখায়।
নাগরিক সমাজ এবং রাষ্ট্র – গ্রামশ্চীর তাত্ত্বিক অবস্থান: সাধারণভাবে মার্কসীয় তত্ত্বে রাষ্ট্রকে দেখা হয় শাসকশ্রেণীর হাতিয়ার হিসেবে। রাষ্ট্র সম্পর্কে এই অতিসরলীকৃত ধারণার সবচেয়ে সুস্পষ্ট প্রকাশ লেনিনের রাষ্ট্র ও বিপ্লব প্রবন্ধে। অর্থনীতিবাদী অবস্থান থেকে যে দৃষ্টিভঙ্গি মূলধারার মার্কসীয় মহলে বিরাজ করে তা হচ্ছে এই (১) অর্থনীতির জগতে আধিপত্যকারী শ্রেণী রাষ্ট্রকে দখল করে, শাসিত শ্রেণীগুলির ওপর দমন-পীড়ন নামিয়ে আনে এবং (২) রাষ্ট্র মূলতঃ একটি নিপীড়নমূলক প্রতিষ্ঠান। এই নিপীড়ন চলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বুর্জোয়া রাষ্ট্র সম্পর্কে এই দৃঢ় প্রত্যয়ী দৃষ্টিভঙ্গিতে অবস্থান করেই গণতন্ত্র, অধিকার ভোটাধিকার ইত্যাদিকে দেখা হয় মূলতঃ শাসক বুর্জোয়াশ্রেণীর অধিকার বলে। সাধারণ মানুষের কাছে এটি বিভ্রান্তিকর। গ্রামশ্চী কিন্তু যান্ত্রিক অর্থনীতিবাদী অবস্থান থেকে সরে এসে রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে এক জটিল তত্ত্ববিন্যাস নির্মাণ করছেন। তাঁর মতে এটা ঠিক যে রাষ্ট্রের মধ্য দিয়েই শাসকশ্রেণীগুলির ঐক্য প্রকাশ পায়। তিনি একই সঙ্গে মন্তব্য করছেন যে রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট নাগরিক সমাজকে যথাযথভাবে না বুঝলে রাষ্ট্রকে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। অবশ্য নাগরিক সমাজের ধারণা গ্রামশ্চীর লেখায় কখনই সুসংহতভাবে পাওয়া যায় না। Prison Note Books-এ নাগরিক সমাজ সম্পর্কে তাঁর সবচেয়ে সস্পষ্ট অভিমত পাওয়া যায় যখন তিনি বলেন যে উপরিকাঠামোর স্তরে দুটি ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করা যায়; প্রথমটি হচ্ছে নাগরিক সমাজ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে রাজনৈতিক-সমাজ বা রাষ্ট্র। নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠে সেই সমস্ত বেসরকারী সংগঠন গুলিকে নিয়ে যেগুলির অবস্থান রাষ্ট্রের চৌহদ্দীর বাইরে। ব্যক্তি নাগরিকের একান্ত নিজস্ব ক্ষেত্র হচ্ছে এই নাগরিক সমাজভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলি। এই নাগরিক সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্য দিয়েই শাসকগোষ্ঠীর মতাদর্শগত আধিপত্য বা ‘হেগেমনি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রামশ্চী নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক-সমাজ বা রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে নিম্নবর্গের শ্রেণীগুলি যে এক বিশেষ ধরনের বিন্যাস ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শোষিত ও শাসিত হয় তার উল্লেখ করেছেন। শাসকশ্রেণী পুঁজিবাদী সমাজের শুধুমাত্র শাসনযন্ত্রে তার প্রভুত্বই প্রতিষ্ঠা করে না নাগরিক সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তাঁর কর্তৃত্বের সপক্ষে জনগণের সক্রিয় সম্মতিও আদায় করে। গ্রামী এই জায়গায় রাষ্ট্রসম্পর্কে লেনিনের সংকীর্ণ নিপীড়নমূলক তত্ত্বকে অস্বীকার করে মন্তব্য করছেন যে, শুধুমাত্র নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রশক্তিকে অবলম্বন করে বুর্জোয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। শাসক বুর্জোয়া শ্রেণী তার শাসনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে ও ভাবাদর্শের জগতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটায়। এবং শাসিত শ্রেণীগুলি থেকে সামাজিক সম্মতি আদায় করে।
গ্রামশ্রী নাগরিক সমাজ বলতে বুঝিয়েছেন মূলতঃ গোটা সমাজ জুড়ে থাকা বিভিন্ন ধর্ম প্রতিষ্ঠান, ট্রেড ইউনিয়ন, রাজনৈতিক দল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলিকে। এই প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনগুলি স্পষ্টতই উৎপাদন প্রক্রিয়া বা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা। পুঁজিবাদী সমাজের জটিল সামাজিক ক্রিয়া, সামাজিক সম্পর্ক, পুঁজি-শ্রম-দ্বন্দ্ব ইত্যাদির মধ্য দিয়েই নাগরিক সমাজের জটিল বিন্যাস গড়ে ওঠে। গ্রামশ্চীকে অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি যে পুঁজিবাদী সমাজে তিন ধরনের সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্র দেখা যায়–
-
1. উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ঘিরে উৎপাদন সম্পর্ক বা শ্রমিক-পুঁজিপতি সম্পর্ক বা শ্রেণী সম্পর্ক;
-
2. নিপীড়নমূলক ক্ষেত্র যেখানে রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার;
-
3. এর বাইরে অন্যান্য সমস্ত সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্র বা নাগরিক সমাজ।
আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে বিশেষ করে পশ্চিমী গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় নাগরিক সমাজ হচ্ছে এক বিস্তীর্ণ পরিসর যেখানে পুঁজিপতি শ্রেণী, শ্রমিক শ্রেণীর পাশাপাশি অন্যান্য নানা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। নাগরিক সমাজের এই বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সংগঠনগুলির সৃষ্টি হয়। নাগরিক সমাজের রঙ্গমঞ্চে একদিকে যেমন শ্রেণীসংগ্রাম চলে, অন্যদিকে চলে বিচিত্র গণতান্ত্রিক আন্দোলন। নানা দাবীদাওয়ার ভিত্তিতে জনগণ নানা সামাজিক গোষ্ঠীতে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন চালায়। এই নাগরিক সমাজেই মতাদর্শগত আধিপত্য বিস্তারের সংগ্রাম চলে, শাসকগোষ্ঠী নিম্নবর্গের সঙ্গে নাগরিক সমাজের ওপর মতাদর্শগত আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়।
অর্থাৎ গ্রামশ্চীর বিশ্লেষণে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন নীতির পাশাপাশি যে এক বিস্তীর্ণ নাগরিক সমাজের অস্তিত্ব ও সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে তা ধরা পড়েছে। প্রিজন নোটবুকস-এ তিনি নাগরিক সমাজ এবং রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক সমাজের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক সমাজ হচ্ছে জেল, জরিমানা, সশস্ত্রবাহিনী ইত্যাদি দমন-পীড়নমূলক যন্ত্রসম্বলিত ব্যবস্থা এবং নাগরিক সমাজ হচ্ছে এক খোলামেলা পরিসর যেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে সহনীয় এবং গ্রহণীয় করে তোলার নানা প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত থাকে। নাগরিক সমাজে গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই মতাদর্শগত আধিপত্য বিস্তারের দীর্ঘ স্থায়ী কর্মকাণ্ড চলে। গ্রামশ্চীর মতে আধুনিক রাষ্ট্রকে দেখতে হবে রাজনৈতিক-সমাজ বা দমনপীড়নের বন্দোবস্ত এবং নাগরিক সমাজ সম্বলিত একটি জটিল ব্যবস্থা হিসেবে। তাঁর ভাষায় রাষ্ট্র হচ্ছে দমন-পীড়নের যাবতীয় বন্দোবস্ত সম্বলিত মতাদর্শগত প্রভুত্ব ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান।
রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজ ইত্যাদি সম্পর্কে গ্রামশ্রী যে তাত্ত্বিক বিন্যাস ঘটাচ্ছেন সেখানে রাষ্ট্রশক্তি এবং নাগরিক সমাজের ক্ষেত্র আপাতদৃষ্টিতে আলাদা বলে চিহ্নিত করা গেলেও এর থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যাবে না যে তিনি লেনিন কথিত দমন-পীড়নের যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে দমন-পীড়নহীন নাগরিক সমাজের ধারণাকে যুক্ত করেছেন। অবশ্য প্রিজন নোটবুকস-এর কোন কোন জায়গায় তাঁর মন্তব্য এই যে রাষ্ট্র হচ্ছে দমনপীড়ন + সম্মতি (Coercion Consent), যে সম্মতি গড়ে তোলা হয় নাগরিক সমাজের নানা প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু নাগরিক সমাজের অনেক প্রতিষ্ঠানই কিন্তু রাষ্ট্রীয় এলাকা এবং নাগরিক সমাজ উভয়েরই বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিরাজ করে। গ্রামৰ্শী এই প্রসঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করছেন। নাগরিক সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠান বিদ্যালয় আপাতভাবে পীড়নমূলক প্রতিষ্ঠান না হলেও অনেক সময় শৃঙ্খলার প্রয়োজনে সেখানে পীড়নের বন্দোবস্তও প্রচ্ছন্নভাবে থাকে। তাই গ্রামশ্চীর রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজের তত্ত্ব পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের জটিল সামাজিক সম্পর্ক অনুধাবনে নতুন তাত্ত্বিক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে।