শশাঙ্কের মৃত্যুর পর থেকে বঙ্গদেশের শান্তিশৃঙ্খলা সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়েছিল। কার্যত, এই সময়ে বাংলাদেশ বহু ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং এখানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। ক্রমে দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচারের চরম পরিণতি রূপে দেখা দিল এক অসহ্য নৈরাজ্যকর অবস্থা। এই অবস্থাকেই সমসাময়িক লিপি ও কাব্যে ‘মাৎস্যন্যায়’বলে বর্ণনা করা হয়েছে। পুকুরের বড়ো মাছ যেমন ছোটো ছোটো মাছকে নির্বিচারে গ্রাস করে, তেমনি অরাজকতার সুযোগে বাংলাদেশে সবলেরা দুর্বলের ওপরে যথেচ্ছ শোষণ চালাত। তাই এ সময়কে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। লামা তারানাথ তৎকালীন বাংলার অবস্থা প্রসঙ্গে বলেছেন, “তখন বাংলায় কোনো রাজা ছিল না। প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, সামন্ত ও বণিক নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। কিন্তু তখন সমগ্রদেশের কোনো রাজা ছিল না।”
ধর্মপালের ‘খালিমপুর’ তাম্রশাসনের চতুর্থ শ্লোক থেকে জানা যায় যে, এই নৈরাজ্যকর অবস্থা বা মাৎস্যন্যায়ের অবসান ঘটানোর জন্য প্রকৃতিপুঞ্জ গোপালকে রাজপদে অভিষিক্ত করেছিল। এখানে প্রকৃতি বলতে ঠিক কাদের বোঝানো হয়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। কলহন ‘প্রকৃতিপুঞ্জ’ বলতে জনসাধারণ অর্থাৎ প্রজামণ্ডলীকে বুঝিয়েছেন, যাঁরা গোপালকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু অনেক পণ্ডিত এই মতের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, রাজ্যের এইরূপ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে সমগ্র প্রজাবর্গের সম্মিলিত নির্বাচন সম্ভব ছিল না। তাই মনে হয় ‘প্রকৃতি’ বলতে এখানে কতিপয় প্রধান সচিব বা কর্মচারীকে বোঝানো হয়েছে এবং এঁরাই গোপালকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করেন। ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখার্জী অর্থশাস্ত্রের মত উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, ‘প্রকৃতি’ বলতে রাজা, অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, সেনা, মিত্র ইত্যাদিকে বোঝানো হত। সুতরাং মাৎস্যন্যায়ের অবসানকল্পে মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা গোপালকে নির্বাচিত করেন—এমন ভাবা যেতে পারে।
পালরাজা গোপাল (৭৫০-৭৭০ খ্রিঃ) :
গোপালের বংশপরিচয় বা প্রথম জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। ‘রামচরিত’ অনুযায়ী বরেন্দ্রী ছিল পালরাজাদের আদি বাসস্থান। ড. মজুমদারও এই মত সমর্থন করেন। খালিমপুর তাম্রশাসনে গোপালের পিতা ও পিতামহ হিসেবে ব্যপট ও দয়িতবিষ্ণুর নাম রয়েছে। এই লেখতে ব্যপটকে শত্রুনিধনকারী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এ থেকে মনে হয় যে, তিনি হয়তো সামরিক-প্রধান ছিলেন। পালগণের বংশপরিচয় সম্পর্কেও নানা মত প্রচলিত আছে। ‘রামচরিত অনুযায়ী এঁরা ছিলেন ক্ষত্রিয়। আবার ‘আর্যমঞ্জুশ্রী-মূলকল্পে’ পালবংশকে ‘দাসজীবীনর’ বলা হয়েছে। আবুল ফজলের মতে, এঁরা ছিলেন কায়স্থ।
গোপাল সম্ভবত ভদ্ররাজবংশের কন্যা দদ্দাদেবীকে বিবাহ করেন। কারণ ‘খালিমপুর লেখ’তে দদ্দাদেবী সম্পর্কে ‘ভদ্রাত্মজা’ বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়েছে। সিংহাসনে আরোহণ করে গোপালের প্রথম ও প্রধান কাজ ছিল দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা। তিনি সেই কাজে সফল হন এবং সম্ভবত সমগ্র বঙ্গদেশের ওপর নিজ কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। ‘খালিমপুর লেখতে বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন ‘পরম সৌগত’ অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মের উপাসক। গোপাল ৭৫০ থেকে ৭৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
ধর্মপাল (৭৭০-৮১০ খ্রিঃ) :
গোপালের মৃত্যুর পর আনুমানিক ৭৭০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র ধর্মপাল বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন সুদক্ষ যোদ্ধা ও কূটনীতিজ্ঞ। ক্ষুদ্র পালরাজ্যকে তিনি সাম্রাজ্যের মর্যাদায় উন্নীত করেন। বিজেতা হিসেবে তিনি সমগ্র আর্যাবর্তে সার্বভৌম ক্ষমতার অভিলাষী ছিলেন। সেই সময়ে উত্তর ভারতের প্রভুত্বকে কেন্দ্র করে প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট বংশের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল। কালক্রমে ধর্মপালও এই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।
সিংহাসনে বসেই ধর্মপাল ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এই ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বের তিনটি পক্ষ ছিল যথাক্রমে পূর্ব ভারতের পালগণ, পশ্চিম ভারত অর্থাৎ মালব-রাজপুতনার প্রতিহারগণ এবং দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকূটগণ। সেই সময় কনৌজ ছিল ‘সাম্রাজ্যবাদের আসন ও প্রতীক’। তাই মগধ, বারাণসী ও প্রয়াগ জয় করে ধর্ম র কনৌজ জয়ের জন্য অগ্রসর হন। একইভাবে প্রতিহাররাজ বৎস্যরাজও কনৌজের ওপর আধিপত্য প্রচেষ্টায় উদ্যোগী হন। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ উভয়ের মধ্যে সংঘাত হয়, যাতে ধর্মপাল পরাজিত হন। কিন্তু বৎস্যরাজ জয়ের ফলভোগ করার আগেই আবির্ভাব ঘটে তৃতীয় শক্তির অর্থাৎ রাষ্ট্রকুটরাজ ধ্রুবর। তিনি বৎস্যরাজকে পরাজিত করেন ও রাজপুতানায় ফিরে যেতে বাধ্য করেন। অবশ্য ধর্মপালও এরপর ধ্রুবর হাতে পরাজিত হন। তবে এই পরাজয়ের ফলে ধর্মপালের বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ ধ্রুব এরপর নিজ রাজ্যে ফিরে যান। প্রতিহাররাজের পরাজয় ও ধ্রুবর নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তনের ফলে উত্তর ভারতে যে শক্তিশূন্যতার সৃষ্টি হয়, ধর্মপাল তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। তিনি পুনরায় ক্ষমতা বিস্তারে অগ্রসর হন। নারায়ণপালের ‘ভাগলপুর তাম্রশাসন’ থেকে জানা যায় যে, ধর্মপাল কনৌজ অধিকার করেন ও কনৌজের সিংহাসনে নিজ মনোনীত চক্ৰায়ুধকে বসান। কনৌজের পূর্ববর্তী রাজা ইন্দ্রায়ুধ বিতাড়িত হন। কনৌজ ছাড়াও ধর্মপাল উত্তর ভারতের আরও নানা রাজ্য জয় করেন। কনৌজে অনুষ্ঠিত এক দরবারে উপস্থিত উত্তর ভারতের অনেক রাজা ধর্মপালের প্রতি বশ্যতা জ্ঞাপন করেন বলে ‘খালিমপুর লেখ’ থেকে জানা যায়। ‘খালিমপুর লেখাতে এই রাজ্যগুলির নামের তালিকা পাওয়া যায়। (১) ভোজ (বরার), (২) মৎস্য (জয়পুর), (৩) মদ্র (মধ্য পাঞ্জাব), (৪) অবন্তি (মালব), (৫) গান্ধার (পশ্চিম পাঞ্জাব), (৬) কুরু (পূর্ব পাঞ্জাব), (৭) যদু (পাঞ্জাব), (৮) যবন (সিন্ধু উপত্যকার মুসলিম রাজা) ইত্যাদি। অনেক পণ্ডিত মনে করেন, ‘খালিমপুর লেখ’র এই বর্ণনা কিছুটা অতিরঞ্জিত। কিন্তু ‘মুঙ্গের লেখ’তেও এই বর্ণনার সমর্থন পাওয়া যায়। সুতরাং অন্তত কিছুকালের জন্য ধর্মপাল সমগ্র উত্তর ভারতের ওপর নিজ কর্তৃত্ব বিস্তারে সমর্থ হয়েছিলেন— এতে কোনো সন্দেহ নেই। সম্ভবত, এই দূরবর্তী রাজ্যগুলির শাসনের দায়িত্বে থাকতেন ধর্মপালের প্রতি অনুগত সামন্তগণ। আর বাংলা ও বিহার ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল।
ধর্মপালের রাজত্বের শেষদিকে ত্রিশক্তি সংঘর্ষের অঙ্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় নব শতকের সূচনায় দ্বিতীয় নাগভট্টের নেতৃত্বে প্রতিহারগণ পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠে ও কনৌজ দখল করে নেয়। এই অবস্থায় ধর্মপাল সম্ভবত রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের সাহায্যপ্রার্থী হন। কারণ রাষ্ট্রকুট রাজকন্যা রন্নাদেবী ছিলেন ধর্মপালের পত্নী। অবশ্য রাষ্ট্রকূট সাহায্য আসতে বিলম্ব হওয়ায় ধর্মপাল একাই কনৌজ পুনরুদ্ধারে এগিয়ে যান। কিন্তু এবারেও তিনি নাগভট্টের কাছে পরাজিত হন। আবার দ্বিতীয় নাগভট্টও রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের কাছে পরাজিত হন। ধর্মপাল তৃতীয় গোবিন্দের বশ্যতা স্বীকার করে নিজ অস্তিত্ব রক্ষা করেন। সম্ভবত, এরপর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ধর্মপাল কনৌজ তথা উত্তর ভারতে নিজ প্রতিপত্তি বজায় রাখতে সমর্থ হন।
ধর্মপাল কেবল রাজ্যবিজেতাই ছিলেন না, শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক শিক্ষানুরাগী হিসেবেও তিনি ছিলেন কৃতিত্বের অধিকারী। বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি বহু বৌদ্ধমঠ নির্মাণ করেন। তাঁর গুরু ছিলেন বৌদ্ধ পণ্ডিত হরিভদ্র/ মগধে নতুন রাজধানী স্থাপন করে তিনি সেখানে বিখ্যাত ‘বিক্রমশীল বিহার’ নামক বৌদ্ধমঠটি নির্মাণ করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘বিক্রমশীল’ ছিল ধর্মপালের উপাধি। বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র হিসেবে বিক্রমশীল বিহারের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। এ ছাড়া পাহাড়পুরের সোমপুরী বিহার এবং ওদন্তপুরী বিহারও ধর্মপালের অনন্য কীর্তি। তারানাথের মতে, ধর্মপাল অন্তত ৫০টি বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাকেন্দ্রও নির্মাণ করেছিলেন। ৮১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হলে তাঁর সুযোগ্য পুত্র দেবপাল বাংলার সিংহাসনে বসেন।
দেবপাল (৮১০-৮৫০ খ্রিঃ) :
পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধি দেবপাল ৮১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনিই ছিলেন পালবংশের শ্রেষ্ঠ নরপতি এবং তাঁর উত্তরাধিকারীদের বিভিন্ন লেখ থেকে আমরা তাঁর রাজ্যজয়ের বিস্তৃত বিবরণ পাই। এই লেখগুলি হল ‘মুঙ্গের লেখ’, ‘ভাগলপুর লেখ’ও ‘বাদল প্রশক্তি’। ‘বাদল প্রশস্তি’ থেকে জানা যায় যে, দেবপাল উৎকল, হুন, দ্রাবিড় ও গুর্জরদের পরাজিত করেছিলেন। ‘ভাগলপুর লেখ’তে তাঁর উৎকল ও প্রাগজ্যোতিষ জয়ের কথা আছে। ‘মুঙ্গের তাম্রলেখ’তে বলা হয়েছে যে, দেবপালের বিজয় পতাকা পশ্চিমে কম্বোজ ও দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত বাহিত হয়েছিল।
তারানাথের মতে, পালদের উত্থানের ঠিক পূর্ববর্তী সময়ে বাংলার মতো উৎকলেও নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা চলছিল। তারপর কর রাজারা সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেবপাল সম্ভবত এই করবংশীয় রাজা শিবকরকে পরাস্ত করে উৎকল জয় করেন। ‘ভাগলপুর লেখ’ অনুযায়ী দেবপালের ভ্রাতা জয়পাল উৎকলে উপস্থিত হলে উৎকলরাজ তাঁর রাজধানী পরিত্যাগ করে পলায়ন করেন। দেবপাল ‘প্রাগজ্যোতিষ’ জয় করেন। ‘প্রাগ্জ্যোতিষ’ বলতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাকে বোঝায়। ভাগলপুর লেখতে বলা হয়েছে যে, জয়পাল যখন প্রাগজ্যোতিষ আক্রমণ করেন, তখন সেখানকার রাজা দেবপালের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেন। কয়েকজন ঐতিহাসিক মনে করেন যে, কামরূপরাজ ও দেবপালের মধ্যে এক চুক্তি হয়, যার ফলশ্রুতিতে তাঁরা একযোগে উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। পঞ্চম শতকের শেষদিকে ও ষষ্ঠ শতকের প্রথমদিকে মধ্য-এশিয়ার যাযাবর হুন জাতি উত্তর ভারতের রাজনীতিতে এক বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল। এই সময়ের পরে আর তাদের বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়নি। ‘হর্ষচরিতে’ অবশ্য প্রভাকরবর্ধনের শত্রু হিসেবে হুনদের উল্লেখ আছে। সুতরাং বোঝা যায় যে, উত্তর ভারতের কোনো স্থানে এদের কোনো ক্ষুদ্র রাজ্য হয়তো থেকে গিয়েছিল, দেবপাল সেখানেই অভিযান করেছিলেন। এরপর সম্ভবত তিনি ‘কম্বোজ’ রাজ্যে অভিযান করেন। ‘কম্বোজ’ রাজ্যটি সাধারণত ভারতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ছিল বলে মনে করা হয়। এখানকার অশ্ব বিখ্যাত ছিল। ‘মুঙ্গের লেখ’তেও এ প্রসঙ্গে অশ্বের উল্লেখ থাকায় মনে করা যায় যে, দেবপাল ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কম্বোজ রাজ্যই অভিযান করেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, দেবপালের পক্ষে দূরবর্তী কম্বোজ রাজ্য জয় করা সম্ভবপর ছিল না। কিন্তু এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, ধর্মপাল গান্ধার পর্যন্ত তাঁর আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। তাই দেবপালের কম্বোজ জয়ের দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক না-ও হতে পারে।
‘বাদল লেখ’য় যে গুর্জরগণের উল্লেখ আছে, তারা ও প্রতিহারগণ অভিন্ন ছিল কিনা, তা নিয়ে পণ্ডিতমহলে মতভেদ আছে। যদি লেখয় উল্লিখিত গুর্জর ও প্রতিহারগণ একই হয়, তাহলে বলা যায়। যে, ধর্মপালের সময়ে যে ত্রিশক্তি দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়েছিল, দেবপালের সময়েও তা অব্যাহত ছিল। দেবপালের সমসাময়িক প্রতিহাররাজ ছিলেন মিহিরভোজ। তাঁর ‘গোয়ালিয়র প্রশস্তি’ থেকে জানা যায় যে, তিনি পালরাজের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। তবে ড. চৌধুরী মনে করেন যে, ভোজ প্রথমে জয়লাভ করলেও পরবর্তীকালে দেবপালের কাছে পরাজিত হন।
দেবপাল যে দ্রাবিড়দের পরাস্ত করেন, তারা কারা ছিল— সে বিষয়েও বিতর্ক আছে। অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন যে, ‘দ্রাবিড়’ বলতে রাষ্ট্রকুটদের বোঝানো হয়েছে। দেবপাল রাষ্ট্রকুটরাজ প্রথম অমোঘবর্ষকে পরাস্ত করেছিলেন। কিন্তু ড. মজুমদার মনে করেন যে, এই পরাজিত দ্রাবিড় রাজা ইলেন পাণ্ড্যরাজ শ্রীমার শ্রীবল্লভ। অবশ্য ড. নীহাররঞ্জন রায়-সহ অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ মনে করেন না যে, দেবপাল সুদূর দক্ষিণের পাণ্ড্যরাজ্য পর্যন্ত অঞ্চল জয়ে সমর্থ হয়েছিলেন। ‘মুঙ্গের লেখতে দেবপালের রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, উত্তরে ‘হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে ‘রামেশ্বর সেতুবন্ধ’ পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তৃত ছিল এবং পূর্ব ও পশ্চিমে এটি সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত ছিল। এই বর্ণনায় কিছুটা অতিশয়োক্তি আছে সন্দেহ নেই। সে তুলনায় ‘বাদল প্রশস্তি’তে প্রদত্ত রাজ্যসীমা অনেকটা যুক্তিগ্রাহ্য। এখানে বলা হয়েছে যে, দেবপালের রাজত্ব উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর পূর্ব-পশ্চিম সীমা পূর্বের রাজ্যসীমার অনুরূপ। এই দুটি লেখর সাক্ষ্য থেকে মনে হয় যে, দেবপাল দক্ষিণের কিছু অংশ অন্তত জয় করেছিলেন। অবশ্য ড. দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে, “এই দুটি বর্ণনার মূলে আছে সমগ্র ভারতবোধক আদি চক্রবর্তীক্ষেত্র এবং পরবর্তীকালে কল্পিত উত্তর ভারতবোধক ক্ষুদ্র চক্রবর্তীক্ষেত্র। যে-কোনও সম্রাটই এ ধরনের দাবি করতেন। এর কিছুমাত্র ঐতিহাসিক মূল্য নেই।” তবে দেবপালের সাম্রাজ্য যে যথেষ্ট বিস্তৃত ছিল তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
দেবপালের সঙ্গে যবদ্বীপের শৈলেন্দ্রবংশীয় রাজা বালপুত্রদেবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায় ‘নালন্দা লেখ’ থেকে। এই লেখ থেকে জানা যায় যে, বালপুত্রদেব নালন্দায় একটি বিহার নির্মাণের অনুমতি প্রার্থনা করে দেবপালের কাছে দূত পাঠান। দেবপাল কেবল অনুমতি দান করেন তাই নয়, ওই বিহারের ব্যয়নির্বাহের জন্য পাঁচটি গ্রাম দান করেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, পাল সাম্রাজ্য ও শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। আরবদেশীয় পর্যটক সুলেমান দেবপালের রাজত্বকালে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর বিবরণী থেকে দেবপালের বিশাল ও সুদক্ষ সেনাবাহিনীর কথা জানা যায়।
পালযুগে নালন্দা বিহারের খ্যাতি দেশবিদেশে বিস্তৃত হয়েছিল। দেবপালের পৃষ্ঠপোষকতায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধধর্মচর্চার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল। ‘ঘোস্ট্রবর্ণ লেখ’ থেকে জানা যায় যে, দেবপালের সময়ে নগরহারের বাসিন্দা বীরদেব ছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। পিতার মতোই দেবপালও ছিলেন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক। ড. মজুমদারের মতে, ধর্মপাল ও দেবপাল আর্যাবর্তে যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, তার পরিচয় বাঙালির ইতিহাসে পূর্বে বা পরে আর কখনও পাওয়া যায়নি।