সেনবংশের শাসনব্যবস্থা:
মহারাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তীকাল বাংলাদেশে যে সার্বিক অরাজক অবস্থা উদ্ভূত হয়েছিল, তা থেকে বাংলাকে রক্ষা করেন পালবংশের রাজাগণ। প্রশাসনিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার অবসানে তাঁরা প্রচলন করেছিলেন এক সুপরিচালিত ও সুপরিকল্পিত শাসনব্যবস্থা। অবশ্য এই শাসনকাঠামো একান্তভাবে তাঁদের উদ্ভাবন ছিল না। গুপ্তযুগে শশাঙ্কের আমলে যে প্রশাসনিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, মূলত তাকে ভিত্তি করেই পালরাজারা তাঁকে রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তুলেছিলেন।
পালযুগে রাজা ছিলেন প্রশাসনের সর্বোচ্চ। এক বিশাল আমলাতন্ত্রের সাহায্যে তিনি শাসন পরিচালনা করতেন। আপাতদৃষ্টিতে রাজা ছিলেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনিই ছিলেন প্রধান শাসক, প্রধান বিচারক ও প্রধান সেনাপতি। তবে বাস্তবক্ষেত্রে রাজার ইচ্ছা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হত তাঁর মন্ত্রিমণ্ডলের দ্বারা। এ ছাড়া, সামন্ত রাজাগণ এবং প্রচলিত সংস্কার ও শাস্ত্রের বিধান রাজার স্বেচ্ছাচার নিয়ন্ত্রণ করত।
মহামন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীগণ রাজাকে সাহায্য করতেন। পাল আমলে মন্ত্রীপদে ব্রাহ্মণশ্রেণির বিশেষ আধিপত্য ছিল। তার কারণ সম্ভবত ব্রাহ্মণগণ বিদ্যা, বুদ্ধি ও সম্পদে অন্যান্য শ্রেণি অপেক্ষা বলীয়ান ছিলেন। মন্ত্রীপদ বংশানুক্রমিক ছিল। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটু রাজমনোনীত মন্ত্রিপরিষদ শাসনকার্যে রাজাকে সহায়তা করতেন। মন্ত্রী ছাড়া প্রশাসনে রাজার বিশ্বস্ত সহায়ক ছিলেন যুবরাজগণ।
ধর্মপালের ‘খলিমপুর লেখ’এবং নালন্দা পট্ট’ থেকে পালযুগের আমলাতন্ত্রের বিবরণ পাওয়া যায়। রাজামাত্য, দণ্ডশক্তি, বিষয়পতি, বলাধ্যক্ষ, নাবাধ্যক্ষ, মহাদণ্ডনায়ক, মহাপ্রতিহার, ক্ষেত্রপাল, প্রান্তপাল প্রমুখ বহু রাজকর্মচারী কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সাথে জড়িত ছিলেন।
পালযুগে বিকেন্দ্রীকৃত শাসনধারা অব্যাহত ছিল। পাল সাম্রাজ্য কয়েকটি ভুক্তিতে বিভক্ত ছিল। ভুক্তির শাসনকর্তাকে ‘উপরিক মহারাজ’ বা ‘ভুক্তিপতি’ বলা হত। ভুক্তির নীচে শাসনতান্ত্রিক বিভাগ ছিল ‘বিষয়’ এবং তার নীচে ছিল ‘মণ্ডল’। বিষয় ও মণ্ডলের শাসনকর্তাকে যথাক্রমে ‘বিষয়পতি’ ও ‘মওলাধিপতি’ বলা হত। পালদের আমলে ‘বীথি’ নামক একটি জনপদ বিভাগের অনুমান করা হয় যে, দশটি করে গ্রাম নিয়ে একটি উপবিভাগ ছিল।
রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস ছিল কর। পাঁচটি প্রধান কর ছিল—ভাগ, ভোগ, কর, হিরণ্য এবং উপরিকর।
রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক। বিচারবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন ‘মহাদণ্ডনায়ক’, ‘দঙনায়ক’ প্রমুখ। তবে স্থানীয় শাসকগণও বিচার পরিচালনা করতেন। ‘মহীপ্রতিহার’, ‘দাণ্ডিক, ‘দওশক্তি’ নামক কর্মচারীগণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
পালযুগে সৈন্যবিভাগের সর্বোচ্চে ছিলেন ‘মহাসেনাপতি’। তাঁর অধীনে ছিলেন সেনাপতি ও বিভিন্ন বাহিনীর অধ্যক্ষগণ। অশ্ব, হস্তী, রথ ও পদাতিক বাহিনীর সাথে একটি নৌবাহিনীও ছিল। দেশের নানা প্রান্ত থেকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হত।
পালযুগে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় আদর্শ কমবেশি সেনযুগেও অনুসৃত হত। তবে সেন আমলে যেমন কিছু নতুন আমলা-পদের উল্লেখ পাওয়া যায়, তেমনি পালযুগের কিছু পদের অবলুপ্তিও লক্ষ্য করা যায়। সেনযুগের শাসনপ্রকৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পুরোহিততন্ত্র তথা ব্রাহ্মণশ্রেণির প্রাধান্য। ইতিপূর্বে রাজকার্যে ব্রাহ্মণদের নৈতিক স্বীকৃতিকে মর্যাদা দেওয়া হত। কিন্তু সেনরাজাদের আমলে ব্রাহ্মণগণ শ্রেণি হিসেবে প্রত্যক্ষ এবং সক্রিয়ভাবে প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে শুরু করেন। সেনযুগের আর একটি বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য হল রাজকার্যে মহিষীদের প্রাধান্য-বৃদ্ধি। পালযুগের প্রশাসনিক তালিকায় কোনো মহিযীর উল্লেখ পাওয়া যায়নি। কিন্তু সেনযুগের লেখগুলিতে পাটরানি ও অন্যান্য মহিষীদের নামোল্লেখ পাওয়া যায়।
সেনবংশের শাসনকালেও রাজা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তখনও সামন্ততন্ত্র অটুট ছিল। রাজা একটি মন্ত্রিমণ্ডলীর পরামর্শে একগুচ্ছ আমলার সাহায্যে শাসন পরিচালনা করতেন। সেনযুগে মন্ত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও মহাসন্ধিবিগ্রহিক, মহাভোগপতি, মহাধর্মাধ্যক্ষ, মহাসেনাপতি, মহাকরণাধ্যক্ষ, মহাসূত্রাধিকৃত প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীপদ ছিল। তবে সেনদের আমলে রাজ্যের পরিধি সংকুচিত হয়েছিল, অথচ মন্ত্রীর সংখ্যা বেড়েছিল। তাই অনেকের অনুমান যে, পালযুগের তুলনায় সেনযুগে প্রশাসনে আমলাতন্ত্রের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। সম্ভবত এই কারণে পূর্বের তুলনায় সাধারণ প্রজার সাথে প্রশাসনের ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়েছিল।
সেনবংশের শাসন :
একাদশ শতকের অন্তিমভাগে বাংলাদেশে সেনবংশের উত্থান বাংলার ইতিহাসের একটি বিশিষ্ট অধ্যায়। সেনরাজাদের পূর্বপুরুষরা দক্ষিণ ভারত থেকে বাংলায় আসেন বলে অনেকের ধারণা। বিজয় সেনের ‘দেওপাড়া লেখ’তে বলা হয়েছে যে, দাক্ষিণাত্যের চন্দ্রবংশীয় রাজাগণের অন্যতম বীরসেন ছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ। সেনরাজাদের লিপিতে তাঁরা নিজেদের ব্রাহ্ম-ক্ষত্রিয়’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাই মনে হয়, তাঁরা প্রথমে ব্রাহ্মণ ছিলেন পরে ক্ষত্রিয়তে পরিণত হন। বংশপরিচয়ের মতো এঁদের বাংলায় আবির্ভাব সম্পর্কেও মতভেদ আছে। অধিকাংশের মতে, একাদশ শতকে কর্ণাটের চালুক্যরা যখন বাংলাদেশ আক্রমণ করেন, তখন তাদের সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে সেনরা বাংলায় আসেন এবং এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। আবার অনেকের মতে, রাজেন্দ্র চোলের সেনাবাহিনীর সদস্যরূপেই সেনরা প্রথম বাংলায় আসেন। কেউ কেউ মনে করেন, সেনবংশীয় ব্যক্তিরা পালরাজাদের আমলে উচ্চ-রাজপদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। পরে পালবংশের দুর্বলতার সুযোগে এদেশে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
সামন্ত সেন ছিলেন সেন-কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠাতা। তবে তিনি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মনে হয় না। তাঁর পুত্র হেমন্ত সেন প্রথমে রাঢ় অঞ্চলে নিজ কর্তৃত্ব বিস্তার করেন। হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেনের আমলে সেনবংশ বাংলায় স্বাধীন সাম্রাজ্য স্থাপনে সক্ষম হয়।