আদি মধ্যযুগের অর্থনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে রামশরণ শর্মা, বি. এন. এস. যাদব, রমেন্দ্রনাথ নন্দী, ডি. এন. ঝা প্রমুখের বিশ্লেষণের সাথে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, কীর্তিনারায়ণ চৌধুরী প্রমুখের বক্তব্যের মৌলিক পার্থক্য সমকালীন বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। শর্মা প্রমুখ মনে করেন যে, অগ্রহারব্যবস্থা ও ভূমিদাস কর্মসূচির বহুমাত্রিক প্রয়োগ ব্যক্তিগত মালিকানার সৃষ্টি করে, যার পরিণতিতে একদল শক্তিশালী ভূম্যধিকারীর উদ্ভব ঘটে। ক্রমে উৎপাদন ব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক উপাদানের প্রাধান্য ও প্রাবল্য ঘটে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ উৎপাদনে উদ্বৃত্ত সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি করে এবং অনিবার্যভাবে বাণিজ্যের অবক্ষয় দ্রুততর হয়। একইভাবে সামন্তব্যবস্থার বিকাশ ভারত-রোম বাণিজ্যের ধারাকে শিথিল করলে বহির্বাণিজ্যেও মন্দা প্রকটতর হয়। এঁরা মনে করেন যে, একাদশ শতকের আগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের ভূমিকা ছিল নগণ্য। সপ্তম শতক থেকে একাদশ শতকের অন্তর্বর্তীকালে সার্বিক স্তরে ভারতের বাণিজ্যের ধারা ছিল অতি ক্ষীণগতি। পক্ষান্তরে, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ গবেষক মুদ্রা ও লেখমালার ভিত্তিতে দেখিয়েছেন যে, ষষ্ঠ শতক ও একাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে ভারতের অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যের পরিমাণ ও গতি কিছুটা দুর্বল হলেও, তাকে এককথায় অবক্ষয়ী বা নগণ্য বলা যায় না। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘Markets And Merchants in Early Medieval Rajastan” শীর্ষক প্রবন্ধে মধ্য ভারতের বিভিন্ন বাণিজ্যকেন্দ্র এবং বণিকদের ব্যস্ততার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ‘Commerce And Money In Western And Central Sectors of Eastern India’ শীর্ষক প্রবন্ধে শর্মার যুক্তি খণ্ডন করে মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন ও সমৃদ্ধ বাণিজ্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে মতপ্রকাশ করেছেন। Industry And Internal Trade শীর্ষক প্রবন্ধে গবেষক ভকত প্রসাদ মজুমদার দেখিয়েছেন যে, সপ্তম-ত্রয়োদশ শতকে উত্তর ভারতের শহর ও উপকূল ভাগে শিল্প ও বাণিজ্যের প্রাণবন্ত চরিত্র অব্যাহত ছিল। তিনি মনে করেন, আদি-মধ্যযুগে বাণিজ্যের মৌলিক পরিবর্তন হয়তো ঘটে, কিংবা নতুন নতুন অঞ্চলে বাণিজ্যের প্রসার লক্ষণীয়ভাবে ঘটেনি, তবে পূর্ব প্রচলিত বাণিজ্যকেন্দ্রগুলি সমস্ত সময় জুড়েই অতীতের ধারা বহমান রেখেছিল। এ বিষয়ে রণবীর চক্রবর্তীর প্রবন্ধ ‘মণ্ডপিকা’ : আদি-মধ্যযুগে উত্তর ভারতের স্থানীয় বাণিজ্যকেন্দ্র উল্লেখের দাবি রাখে।
সমকালীন লেখমালার সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, আদি-মধ্যযুগে উত্তর ভারতে বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল মণ্ডপিকাসমূহ। রণবীর চক্রবর্তীর মতে, খ্রিস্টীয় ৬০০ অব্দের আগে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে মণ্ডপিকার বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাই অনুমান করা যায় যে, স্তম্ভযুক্ত আচ্ছাদিত মণ্ডপ বা মণ্ডপিকা বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে আদি-মধ্যযুগেই গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে কাংড়া, ভরতপুর, জব্বলপুর, রাজস্থান, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলে বহু মণ্ডপিকা গড়ে ওঠে। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন যে, রাজস্থান ও গুজরাটে বহুসংখ্যক মণ্ডপ গড়ে উঠেছিল। ৬৪৪-১২৯৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালে উৎকীর্ণ চব্বিশটি লেখ বিশ্লেষণ করে বারোটি মণ্ডপিকা ও বারোটি হাটের (হট্ট) অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। রাজস্থানের মণ্ডপিকাগুলির অবস্থান গ্রাম ও শহর উভয় অঞ্চলে লক্ষ্য করা যায়। সম্ভবত, শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত বৃহদাকার মণ্ডপিকাগুলি ‘মহামণ্ডপিকা’ নামে অভিহিত হত। উত্তর ভারতের মণ্ডপিকার মতো দক্ষিণ ভারতের বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ‘নগরম্’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। কেনেথ হল চোল আমলের লেখমালা থেকে এরকম তেত্রিশটি বাণিজ্যকেন্দ্রের নাম উদ্ধার করেছেন। তাঁর মতে, একাধিক গ্রামের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রতিটি ‘নাড়ু’তে একটি করে ‘নগরম্’ থাকত। এই কেন্দ্র থেকে নাড়ুর অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন গ্রামের সাথে যেমন বাণিজ্যসম্পর্ক গড়ে তোলা হত, তেমনি অন্য নাড়ুর সাথেও বাণিজ্যসম্পর্ক গড়ে তোলা হত। কেনেথ হল দক্ষিণ ভারতে স্থলবাণিজ্যের বৃহত্তর কেন্দ্র হিসেবে ‘এরিবীর পট্টিনম’ নামক কেন্দ্রের অস্তিত্ব ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। তবে হল (Hall) নাডুপিছু একটি করে নগরের অস্তিত্ব সম্পর্কে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য চলত প্ৰধানত স্থলপথে। সমকালীন লেখমালা থেকে স্থলপথগুলির বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। যেটুকু পাওয়া যায় তা থেকে অনুমান করা হয় যে, স্থলপথে ভারতের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। ‘দুধপানি লেখ’ থেকে জানা যায় যে, অষ্টম শতকে তিনভাই বাণিজ্যের কাজে অযোধ্যা থেকে স্থলপথে পশ্চিম বাংলার তাম্রলিপ্তে এসেছিল। কিয়াতানের চৈনিক বিবরণ (৭৮৫ ৮০৫ খ্রিঃ) থেকে জানা যায় যে, কামরূপ থেকে উত্তরবঙ্গ হয়ে পূর্ব ভারতের মধ্যস্থল মগধে পৌঁছানো যেত। আরবীয় লেখক আলবেরুণীর রচনা থেকে আদি-মধ্যযুগের শেষদিকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থলপথের বিবরণ জানা যায়। কনৌজের সাথে পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের স্থলপথে যোগাযোগ ছিল। একটি পথ কনৌজ থেকে বারাণসী, পাটনা ও মুঙ্গের হয়ে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। আর একটি পথ কনৌজ থেকে প্রয়াগ, উড়িষ্যা হয়ে সুদুর দক্ষিণ ভারতের কান্যকুব্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আলবেরুণীর বিবরণী অনুসারে কনৌজের সাথে সুদূর কামরূপ, কাশ্মীর, নেপাল প্রভৃতি অঞ্চলের স্থলপথে যোগাযোগ ছিল। আর একটি পথ গুজরাটের সোমনাথ বন্দরের সাথে মথুরার যোগসাধন করেছিল। স্থলপথ ধরে বাণিজ্য করার জন্য সম্ভবত বণিকদের ‘মার্গনক’ নামক একটি কর দিতে হত।
বাণিজ্যে গতিশীলতার অন্যতম নিদর্শন হল বণিকদের সংঘবদ্ধতা ও সাংগঠনিক স্তরে বাণিজ্যের নিরাপত্তা বিধান। সেদিক থেকেও আদি-মধ্যযুগ পিছিয়ে ছিল না। মৌর্য ও গুপ্তযুগে ‘শ্রেষ্ঠী’, ‘স্বার্থবাহ নামাঙ্কিত বাণিজ্যজীবীদের অভিধাগুলির ব্যবহার আদি-মধ্যযুগেও দেখা যায়। দক্ষিণ ভারতের কোহলাপুর (১১৩৬ খ্রিঃ), সিরাজ (১১৪৩ খ্রিঃ) ও বেলগাঁও (১২০৫ খ্রিঃ)-তে প্রাপ্ত তিনটি লেখতে বণিকদের সমাবেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে সমবেত বণিকদের নাম, পরিচয়, আবাসস্থল ইত্যাদির বিবরণ পাওয়া যায়। উত্তর ভারতে বণিক সংগঠনের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতকের একটি লেখ থেকে ‘মনিগ্রামস্’ ও ‘নানাদেশি’ নামক বণিক সংগঠনের নামোল্লেখ পাওয়া যায়। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায়ের মতে, এই সংগঠনের বণিকরা দূরবর্তী দেশ থেকে মূল্যবান পাথর, বিলাসদ্রব্য, সুগন্ধি, ধাতু ইত্যাদি নিয়ে আসতেন। বণিক সংগঠনগুলি নিজস্ব সেনাবাহিনী পোষণ করত, যা তাদের সাংগঠনিক ও বৃত্তিগত শক্তির পরিচয় দেয়। সম্ভবত, স্থানীয় শাসকবৃন্দ আর্থিক কারণে বণিকদের সাথে সহযোগিতা করতেন।
আদি-মধ্যযুগের সামুদ্রিক বাণিজ্য :
খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে ভারত এবং রোম বাণিজ্যের সংকোচন, গুপ্ত-পরবর্তীকালে জমিতে ব্যক্তিমালিকানার বিকাশ, নগরের অবক্ষয়, বদ্ধ-অর্থনীতির প্রকাশ ইত্যাদি নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে ড. রামশরণ শর্মা, ডি. এন. ঝা. প্রমুখ বাণিজ্য সংকোচের যে তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন, তা সার্বিক বলে মানতে অস্বীকার করেছেন অধ্যাপক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, কীর্তিনারায়ণ চৌধুরী প্রমুখ অনেকেই। সমকালীন লেখমালা, পর্যটকদের বিবরণী, মুদ্রা ইত্যাদির ভিত্তিতে এঁরা দেখিয়েছেন যে, সপ্তম শতকের পরবর্তীকালেও ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের গতি অব্যাহত ছিল। রণবীর চক্রবর্তী তাঁর ‘Coastal Trade and voyages in konkan : The Early Medieval Scenario (1998) এবং Trade in Early India’ (2000) গ্রন্থে আদি-মধ্যযুগে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বিশেষভাবে কোঙ্কন উপকূলের বাণিজ্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কীর্তিনারায়ণ চৌধুরীর গবেষণার সাথে একমত হয়ে তিনি লিখেছেন যে, সপ্তম শতকে ইসলামের প্রসার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে গুরুতর পরিবর্তন নিয়ে আসে, ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যেও তার প্রভাব পড়ে।
জর্জ হৌরানী ভারত সাগরে আরব বণিকদের কার্যকলাপের ওপর গবেষণা করে বলেছেন যে, খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে আরব বণিকরা দূরপাল্লার সমুদ্রবাণিজ্যে অংশ নিয়ে চিন পর্যন্ত চলে যেতেন। চৈনিক বিবরণীতে ‘পো-সো’ এবং ‘তা-সি’ নামক জাহাজের উল্লেখ আছে। হৌরানীর মতে, যথাক্রমে পারসি ও আরব জাহাজ বোঝাতে এই দুটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবসাগর ও বঙ্গোপসাগরের এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার সময় এই জাহাজগুলি বিশ্রামের জন্য অবশ্যই ভারতের উপকূল বন্দরগুলিতে নোঙ্গর ফেলত। তখন বাষ্পচালিত নৌ-যান আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে নাবিকরা মৌসুমি বায়ুর ওপর ভর করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিত। স্বভাবতই ভারতের পশ্চিম-উপকূলে আরব জাহাজগুলিকে সাময়িক বিরতি ঘটাতে হত। সেখান থেকে আবার চিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করত। কীর্তিনারায়ণ চৌধুরীর মতে, খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের আগে পর্যন্ত পশ্চিম এশিয়া থেকে রওনা হয়ে বাণিজ্য জাহাজগুলি চিনের ক্যান্টন বন্দর (ধান-ফু) পর্যন্ত চলাচল করত। কিন্তু এই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা ছিল বেশ ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। তাই অষ্টম শতকের পরবর্তীকালে পশ্চিম এশিয়ার জাহাজগুলি ভারতের পশ্চিম উপকূলে কুইলন ও কালিকট বন্দরে নোঙ্গর করত। মৌসুমি বায়ুর সাহায্য নিয়ে এই যাত্রা ছিল সহজ ও কম সময়সাপেক্ষ। অতঃপর চিনা জাহাজগুলি ওই পণ্য সংগ্রহ করে চিনে যেত। এর ফলে ভারতের পশ্চিম-উপকূলীয় বন্দরগুলি পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার জাহাজের যোগসূত্রে পরিণত হয়। এইভাবে ভারতবর্ষ সমৃদ্ধ পশ্চিম-উপকূলীয় বন্দরগুলি চিন বাণিজ্যের মধ্যবর্তীর ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়। এইভাবে ভারতীয় বাণিজ্যে নতুন প্রাণপ্রতিষ্ঠা ঘটে। ইবন বতুতার বিবরণীতেও এই সিদ্ধান্তের সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন যে, আরবদেশীয় ‘ধাও’ জাহাজগুলি পশ্চিম ভারতের ‘কুইলন’ ও ‘কালিকট’ বন্দর পর্যন্ত আসত। অন্যদিকে চিনের ‘জাঙ্ক’ (জাহাজ) কুইলন ও কালিকট অতিক্রম করে যেত না। এইভাবে দু-প্রান্তের জাহাজ ভারতীয় বন্দরে পণ্য বিনিময় করার ফলে ভারতীয় বন্দর বৈদেশিক বাণিজ্যের অংশীদার হয়ে ওঠে।
সমকালীন আরব লেখকদের বর্ণনা থেকেও আদি-মধ্যযুগে আন্তর্জাতিক সমুদ্রবাণিজ্যে ভারতের এবং বিশেষভাবে পশ্চিম-উপকূলের বন্দরগুলির অংশগ্রহণের তথ্য সমর্থিত হয়। সুলেমান (৮৫১ খ্রিঃ), আল মাসুদী (৯১৫ খ্রিঃ), ইবন খোরদাদবা (৯১২ খ্রিঃ), আবু জায়েদ (৯১৬ খ্রিঃ) আল ইশ্ তাখরি (৯৫১ খ্রিঃ) ইবন হাউকল (৯৪৩-‘৬৮ খ্রিঃ), আল ইদ্রিসি (১১৬২ খ্রিঃ) প্রমুখ আরব লেখকরা অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের অন্তর্বর্তীকাল ভারতের অনেকগুলি ব্যস্ত বাণিজ্যের উল্লেখ করেছেন। পারস্যের বস্তা ও সিরাক থেকে আরব পণ্যবোঝাই জাহাজগুলি গুজরাটের কানবায়া (ক্যাম্বে), কোঙ্কনের সুবারা (সোপারা), সিন্দাবুর (গোয়া), সৈমুর (চৌল), মালাবারের কুলমমালি (কুইলন) প্রভৃতি বন্দরে এসে ভিড়ত।
রাষ্ট্রকুট আমলের লেখমালা ও আরব বণিকদের রচনা থেকে সেকালে আরব-ভারত বাণিজ্য ও সুসম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। আরব লেখকরা ‘কামকাম’ দেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কেউ কেউ এর নাম করেছেন ‘মাকামকাম’ বা ‘কামকার’। তাঁরা এই অঞ্চলটিকে ‘বালহারা’ শাসকগোষ্ঠীর অধীন বলে বর্ণনা করেছেন। রণবীর চক্রবর্তীর মতে, রাষ্ট্রকূট রাজাদের বংশগত উপাধি ‘বল্লভরাজ’। এরই উল্লেখ ‘বালহারা’ শব্দে নিহিত আছে। চিনচানি থেকে পাওয়া রাষ্ট্রকূটদের তাম্রশাসনগুলিতেও এই মতের সমর্থন মেলে। রাষ্ট্রকুট তৃতীয় ইন্দ্রের তাম্রশাসনে (৯২৬ খ্রিঃ) স্বীকার করা হয়েছে যে, তাঁর পিতা দ্বিতীয় কৃষ্ণের রাজত্বকালে (৮৭৮-৯১৫ খ্রিঃ) আরব বণিকরা (তাজ্জিক) কোঙ্কন উপকূলের বন্দরগুলির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। রাষ্ট্রকুট ও আরব বণিকরা মিলিতভাবে কোঙ্কন অঞ্চলের ওপর যৌথ আধিপত্য দীর্ঘস্থায়ী করতে প্রয়াসী ছিলেন। ‘রাষ্ট্রকূট লেখ’ থেকেই প্রমাণিত হয়, তৃতীয় ইন্দ্র ও তৃতীয় কৃষ্ণের আমলেও কোঙ্কন উপকূলে আরব বণিকদের বাণিজ্যিক ব্যস্ততা অব্যাহত ছিল। রাষ্ট্রকুটদের পরে কোঙ্কনে ‘শিলাহার’ বংশের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। শিলাহার রাজা ছিণ্ডুরাজের তাম্রশাসন থেকে (১০৩৪ খ্রিঃ) বোঝা যায় যে, তাঁর আমলেও কোঙ্কন উপকূলে আরব বণিকদের বাণিজ্য গতিময় ছিল। তাঁর লেখতে আরব বণিকদের নামোল্লেখ পাওয়া যায়। আল্ মাসুদীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, দশম শতকে চৌল বন্দরে আরব বণিকদের স্থায়ী বসতি গড়ে উঠেছিল। ওমান, বসরা, সিরাফ, বাগদাদ প্রভৃতি স্থানের বহু মুসলমান বণিক এখানে বাণিজ্যিক কাজে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
দশম শতকের মধ্যভাগে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারতের সমুদ্রবাণিজ্যে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে। মিশরে ফতিমিদ সাম্রাজ্যের উত্থান (৯৬৯ খ্রিঃ) এবং সিরাফ অঞ্চলের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ার পরিণামে বাণিজ্যকর্মে পারস্য উপসাগরের গুরুত্ব কমে যায়। এই সময় লোহিত সাগরের বাণিজ্যিক ব্যক্ততা বৃদ্ধি পায়। লোহিত সাগরের দুই প্রান্তের দুটি বন্দর ‘এডেন’ ও ‘আলেকজান্দ্রিয়া’ বন্দর এশীয় বাণিজ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে। লোহিত সাগরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রবাণিজ্য ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের সাথে শহরে সংযুক্ত হয়ে যেতে পারে। এই সময় কোঙ্কনের বন্দরগুলির পরিবর্তে মালাবার উপকূলের বন্দরগুলির বাণিজ্যিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। কারণ এডেন থেকে জাহাজগুলি খুব সহজে এবং কম সময়ে কুইলন, কালিকট, ম্যাঙ্গালোর, গোয়া বারকুর ইত্যাদি বন্দরে উপস্থিত হতে পারে। মালাবার উপকূলে ইহুদি বণিকদের উপস্থিতির ওপর ব্যাপক তথ্য উপস্থাপিত করেেেছন এস. ডি. গয়টাইন। বাণিজ্যিক চিঠিপত্রের ওপর গবেষণা করে তিনি প্রমাণ করেছেনে যে, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে ‘কিশ’-এর সাথে গুজরাট বন্দরগুলির নিয়মিত লেনদেন ছিল। তাঁর গবেষণা থেকে স্পষ্ট হয় যে একাদশ-ত্রয়োদশ শতকে এডেন ও আলেকজান্দ্রিয়াতে বিভিন্ন ভারতীয় পণ্যের প্রবল চাহিদা ও জোগান ছিল। এই কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন ইহুদি বণিকেরা। পর্যটক বেঞ্জামিন-এর বিবরণীতেও (১১৯২ খ্রিঃ) মালাবার অঞ্চলে ইহুদি বণিকদের উপস্থিতি সমর্থিত হয়। আরব লেখকদের রচনায় ‘সেরেনদিব’ বা ‘সিলানদিব’ নামক স্থানের উল্লেখ আছে। সম্ভবত, তাঁরা সিংহলকে এই পথে অভিহিত করেছেন। সেক্ষেত্রে আদি-মধ্যযুগে আরব বণিকরা যে সিংহলের বাণিজ্যিক গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, তা অনুমান করা যায়।
আদি-মধ্যযুগে পূর্ব ভারতে এবং নির্দিষ্টভাবে বঙ্গদেশের বাণিজ্যচিত্রে নানা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। ষষ্ঠ সপ্তম শতকে ব্রহ্মদেশ, মালয়, ইন্দোনেশিয়া, সিংহল প্রভৃতি দেশের সাথে পূর্ব ভারতের বাণিজ্য যোগাযোগের অতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল ‘তাম্রলিপ্ত’ বন্দর। কিন্তু অষ্টম শতকে এই বন্দরের গুরুত্ব ভীষণ হ্রাস পায়। তবে বহির্বাণিজ্যের ধারা বন্ধ হয়ে যায়নি। নবম-দশম শতকের আরব লেখকদের রচনায় ‘সমন্দর’ নামক ব্যস্ত বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবত, এই বন্দরের অবস্থান ছিল বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত চট্টগ্রামের সন্নিকটে। ইবন বতুতা ওই বন্দরকেই ‘সুদকাওয়ান’ (চট্টগ্রাম) নামে অভিহিত করেছেন। ইবন ঘোরদাদবা ও আলইদ্রিসির বিবরণেও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমৃদ্ধির কথা সমর্থিত হয়। উড়িষ্যা (উরানশিন), দক্ষিণ ভারত (কাঞ্জা), সিংহল (সিলানদিব) ইত্যাদি স্থানের সাথেও সমন্দরের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল বলে আরব লেখকরা উল্লেখ করেছেন। চোল রাজাদের আমলে দক্ষিণ ভারতের করমণ্ডল উপকূল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চিনের সাথে বাণিজ্যের জন্য বিশেষ খ্যাতি পায়। খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সমুদ্রবাণিজ্যে চোলরাজাদের অংশগ্রহণ নানা সূত্রে সমর্থিত হয়। চোলরাজা রাজরাজ, প্রথম রাজেন্দ্র এবং প্রথম কুলোতুঙ্গ প্রমুখের দীর্ঘ শাসনপর্বে (৯৮৫-১১২০ খ্রিঃ) চোলদের শক্তিশালী নৌবহরের উপস্থিতিও তাদের বাণিজ্যকর্মের আগ্রহকে সমর্থন করে। ড. রোমিলা থাপার লিখেছেন যে, চোল-বণিকরা বহির্বাণিজ্যে বেশি উৎসাহী ছিলেন। পূর্ব উপকূলে মহাবলীপুরম্ (মামল্লপুর), কাবেরীপত্তনম, শালিয়ুর, কোরাকাই বন্দর এবং মালাবার উপকূলে কুইলম বহির্বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। পারস্য, আরবদেশ ও চিনের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সম্ভবত, চিনের মূল ভূখণ্ডে একটি ভারতীয় উপনিবেশ ছিল। আরব ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি আমদানি করত উন্নতমানের ঘোড়া। দক্ষিণ ভারত থেকে বস্ত্র, ভেষজ, মূল্যবান পাথর, হাতির দাঁত, আবলুস কাঠ, কর্পূর ইত্যাদি চিনে রপ্তানি হত। চিনের সুং বংশের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, চু-লিয়েন ( বা চোল) দেশের রাজা লোৎসা-লোৎসা (রাজরাজ) চিনে বাণিজ্য প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছিলেন। রাজরাজাদের পুত্র রাজেন্দ্র চোলের রাজত্বকালে (১০১২-৪৪ খ্রিঃ) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চিনের সাথে ভারতের নিয়মিত ও ব্যাপক বাণিজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। রণবীর চক্রবর্তী লিখেছেন যে, শ্রীবিজয়ের রাজার সাথে চোলদের সম্পর্কের সাক্ষ্য লেখমালা থেকে পাওয়া যায়। শ্রীবিজয়ের রাজা সংগ্রাম বিজয়তুঙ্গ বর্মন নাগপট্টমে একটি বিহার নির্মাণ করেছিলেন। চিনের মন্দিরে সোনা দান করেছিলেন শ্রীবিজয়ের রাজপ্রতিনিধি। অধ্যাপক চক্রবর্তীর মতে, উভয় দেশের মধ্যে নিয়মিত আর্থিক ও বাণিজ্যিক যোগসূত্র ছাড়া এই সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্ভব হত না। চিনদেশ ও করমণ্ডল উপকূলের বাণিজ্যের অন্তর্বর্তী হিসেবে শ্রীবিজয় এই সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।
রাজেন্দ্র চোলের ‘পুটুর তাম্রলেখ’ (১০২০ খ্রঃ) থেকে অনুমান করা হয় যে, মালয় উপদ্বীপের পশ্চিম উপকূলে কম্বোজ (কাম্বোডিয়া বা কাম্পুচিয়া) এর সাথেও চোলদের নিয়মিত বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল। সম্ভবত, কম্বোজরাজ প্রথম সূর্যবর্মন রাজেন্দ্র চোলের উদ্দেশ্যে কিছু উপহার পাঠিয়েছিলেন। ১০৯৮ ও ১১০২ খ্রিস্টাব্দের দুটি চোল লেখ থেকে জানা যায় যে, চোলরাজ প্রথম কুলোতুঙ্গ বাণিজ্যশুল্ক রহিত করে বৈদেশিক বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছিলেন। পাগানের (বর্তমান ব্রহ্মদেশ) রাজার সাথে কুলোতুঙ্গের কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। চৌ-জু-কুয়ার গ্রন্থ থেকে (১১২৫ খ্রিঃ) জানা যায় যে, চিন থেকে পাগানের মধ্যে দিয়ে চু-লিয়েন বা চোল দেশে যাওয়া যেত। অনুমান করা হয় যে, চিনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে কুলোতুঙ্গ পাগানের শাসকের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। ১০৬৮ ও ১০৯০ খ্রিস্টাব্দের দুটি লেখ থেকে কুলোতুঙ্গের আমলের ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ‘বিশাখাপত্তনম’ও ‘কুলোতুঙ্গ চোলপত্তনম’নামক বন্দরের নাম জানা যায়। সম্ভবত, বিশাখাপত্তনমের নাম পালটে রাজার নামানুসারে কুলোতুঙ্গ চোলপত্তনম করা হয়েছিল। রণবীর চক্রবর্তীর মতে, করমণ্ডল উপকূলবর্তী বন্দরের পরিবর্তে বেঙ্গী উপকূলের বিশাখাপত্তনম বন্দরকে গুরুত্ব দেওয়ার পেছনে বাণিজ্যিক হিসেব সক্রিয় ছিল। কৃষ্ণা গোদাবরীর বদ্বীপ অঞ্চলের বিশাখাপত্তনম থেকে পাগানের সম্পর্ক স্থাপন সহজতর ছিল বলেই কুলোতুঙ্গ এই বন্দরের গুরুত্ব বৃদ্ধি করেন।
আদি-মধ্যযুগের মুদ্রাব্যবস্থা :
সাহিত্যগত উপাদানের ভিত্তিতে কেউ কেউ মনে করেন যে, বৈদিক যুগে ভারতে মুদ্রার প্রচলন ছিল। সাহিত্যসূত্রে ‘নিষ্ক’, ‘শতমান’ ইত্যাদি স্বর্ণনির্মিত উপকরণের অস্তিত্ব জানা যায়। কিন্তু রামশরণ শর্মা মনে করেন যে, এগুলি সম্ভবত ধনী ব্যক্তিরা উপহার হিসেবে ব্যবহার করতেন। এগুলি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত কিনা বলা কঠিন। শর্মার মতে, প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রা খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের পূর্বের নয়। মৌর্যদের আমলে অঙ্ক চিহ্নিত মুদ্রার ব্যাপক ব্যবহার প্রচলিত ছিল। কুষাণরা রোমান স্বর্ণমুদ্রাকে নিজেদের মুদ্রায় রূপান্তরিত করেছিলেন। গুপ্তযুগেও স্বর্ণমুদ্রার ব্যাপক প্রচলন ছিল। গুপ্ত শাসকরা সবচেয়ে বেশি স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন। তবে স্কন্দগুপ্তের পরবর্তীকালে গুপ্তদের মুদ্রায় সোনার পরিমাণ যথেষ্ট কম ছিল। তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে গুজরাটের শকক্ষত্রপরা বিপুল পরিমাণ মুদ্রা চালু করেন। এগুলি গুপ্তদের মুদ্রার সমকালীন ছিল। শকদের এই মুদ্রা নির্মিত হত সিসা, তামা ও রূপা থেকে। তবে রূপায় ৮ ভাগের পরিবর্তে ১৪ থেকে ১৮ ভাগ তামার খাদ মেশানো হত। এ থেকে অনুমিত হয় যে, তখন রূপার জোগান সীমিত ছিল।
গুপ্তোত্তর যুগের পরবর্তী প্রায় চারশো বছর ধরে স্বর্ণমুদ্রার অনুপস্থিতি ও সাধারণ মুদ্রার অভাব দেখা যায়। শৰ্মা লিখেছেন, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে তিন শতাধিক বছর ধরে তিনটি প্রভাবশালী রাজবংশ রাজত্ব করলেও জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয় যে কোন্ মুদ্রা পাল বা রাষ্ট্রকুটরা প্রচলন করেছেন। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, বাংলার কোথাও পাল বা সেনদের চালু করা একটিও স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়নি। এমনকি সমকালীন কোনো সাহিত্যেও স্বর্ণমুদ্রার উল্লেখ নেই। পালদের মতো রাষ্ট্রকূট ও গুর্জর-প্রতিহাররাও স্বর্ণমুদ্রা চালু করেননি। ষষ্ঠ শতকের পর দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতে খুব কমই ধাতব মুদ্রার ব্যবহার দেখা যায়। ৬০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজত্বকারী পল্লব, পাণ্ড্য, চোল, চালুক্য প্রমুখের খুব কম মুদ্রাই চোখে পড়ে। তবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশের অবস্থা কিছুটা স্বতন্ত্র ছিল। আদি-মধ্যযুগে (আনুমানিক ৬০০-১০০০ খ্রিঃ) এই অঞ্চলে আফগানিস্তানের শাসকদের মুদ্রা চালু ছিল। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন ছিল। এই মুদ্রাগুলির ওপর হরিকেল (নোয়াখালি, কুমিল্লা), পট্টিক (পাইটকারা) প্রভৃতি স্থানের নাম খোদিতও আছে। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অনুমান, এই মুদ্রাগুলির ওপর আরাকানের মুদ্রার প্রভাব আছে। মুদ্রাগুলি রৌপ্যনির্মিত এবং এর একপিঠে বৃষমূর্তি ও অপরদিকে ত্রিশূলজাতীয় বস্তুর প্রতিকৃতি অঙ্কিত আছে। দশম শতকের পর মুদ্রাগুলির আকার, পরিমাণ ও ওজন পরিবর্তন করা হয়। সম্ভবত, উত্তর ভারতে প্রচলিত ‘পুরাণ’, ‘ধরন’, ‘কার্যাপর্য’, ‘দ্রম্ম’ নামক মুদ্রাগুলির সাথে বিনিময়যোগ্য করে তোলার জন্য এই পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল। পশ্চিম এশিয়ার ‘দিরহাম’জাতীয় মুদ্রাগুলির সাথে হরিকেল মুদ্রার ওজনগত সাদৃশ্য ঘটানো হয়। সম্ভবত, বাংলাদেশের মুদ্রাগুলিকে উত্তর ভারত ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য এই পরিবর্তন অনিবার্য হয়েছিল। পাহাড়পুর এলাকা থেকে খলিফা হারুণ-অল-রসিদের (৭৮৮ খ্রিঃ) গোলাকৃতি রৌপ্যমুদ্রার আবিষ্কার এবং ময়নামতী অঞ্চলে আব্বাসীয় খলিফা আবু আহম্মদ আবদাল্লার (১২৪২-‘৫৮ খ্রিঃ) স্বর্ণমুদ্রার আবিষ্কার থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে হরিকেলের অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। ইতিপূর্বে আলোচিত ‘সমন্দর’ বা ‘চট্টগ্রাম’ বন্দরটি এই অঞ্চলেই অবস্থিত ছিল।
পাল ও সেন রাজাদের আমলে কোনো মুদ্রার প্রচলন সম্পর্কে নিশ্চিত প্রমাণ না-পেলেও, বহু তাম্রশাসনে ‘পুরাণ কপদক’ শব্দটি উল্লেখ আছে। শৰ্মা ‘কপদক’ অর্থে ‘কড়ি’ বুঝিয়েছেন। এবং এটি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত। তবে দূরপাল্লার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কড়ির মতো নগণ্য দ্রব্যের ব্যবহার কতটা কার্যকরী ছিল, সে প্রশ্ন অনেকেই তুলেছেন। কারণ তখন ১টি রৌপ্যমুদ্রার জন্য ১২৮০টি কড়ি দিতে হত। ১টি স্বর্ণমুদ্রার জন্য লাগত ২০৪৮০টি কড়ি। স্বভাবতই এত বিপুল পরিমাণ কড়ি বহন করে ব্যবসা করা কষ্টকর ছিল। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ‘পুরাণ কপর্দক’-এর সাথে সাথে ‘কার্যাপন’ নামক একটি নতুন শব্দের উল্লেখ লেখমালায় দেখা যায়। বিশ্বরূপ সেনের ‘মদনপাড়া’ লেখতে এবং দামোদর দেবের মেহার তাম্রপটে ‘পুরাণ’ ও ‘চূর্ণী’ কথা দুটি একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ১১৪১ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ উড়িষ্যারাজ অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গের অলণ্ডম শাসনে ‘পুরাণ’, ‘কার্যাপন’ ও ‘চূর্ণী’ শব্দগুলি সমঅর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে চূর্ণী বলতে সম্ভবত স্বর্ণবা রৌপ্য চূর্ণ বা খণ্ডের কথা বলা হয়েছে। আরব বণিকদের রচনা থেকে জানা যায় যে, আদি-মধ্যযুগে ধাতু চূর্ণ দ্বারা বিনিময় করা হত। এক তিব্বতি বিবরণীতেও এর সমর্থন মেলে। প্রখ্যাত বৌদ্ধপণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে তিব্বতি সন্ন্যাসী বিক্রমশীলা মহাবিহারে এসেছিলেন, তাঁকে দৈনন্দিন খরচ মেটানোর জন্য কিছু সোনা দেওয়া হয়েছিল। তিনি ওই সোনাকে চূর্ণ করে ছোটো ছোটো পুঁটলিতে সংরক্ষণ করেন। অনুমান করা যায় যে, বঙ্গদেশে সোনা বা রূপার মুদ্রার সমান ওজনের ধাতুচূর্ণ পুঁটুলিতে রেখে লেনদেনের কাজে ব্যবহার করা যেত। রণবীর চক্রবর্তী আদি-মধ্যযুগের বাংলার বিনিময় ব্যবস্থায় মুদ্রার তিনটি স্তরের উল্লেখ করেছেন। এই ত্রিস্তর ব্যবস্থার সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল কড়ি বা কপর্দক; মধ্যবর্তী স্তরে ছিল ধাতব চূর্ণ (চূর্ণী) এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল ধাতব মুদ্রা, যেমন— কার্যাপন, ফ্রন্ম, পুরাণ ইত্যাদি। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ধাতুমুদ্রা চূর্ণী ও কপর্দকের সহাবস্থান ও বিনিময়যোগ্যতা উত্তর ভারতের অন্যত্র চালু ছিল বলে অনুমান করা যায়।
আদি-মধ্যযুগের শিল্প উৎপাদন :
কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষের শিল্প উৎপাদনের প্রধান উপাদান ছিল কৃষিজ উপাদান। আখ, পাট, শণ, তুলা ইত্যাদি অর্থকরী ফসল উৎপাদনের মাত্রার ওপরেই মূলত আদি-মধ্যযুগের শিল্প উৎপাদনের পরিধি নির্ভরশীল ছিল। আখ উৎপাদনে গোটা ভারতের মধ্যে বঙ্গদেশ, উত্তরপ্রদেশ, মালবদেশ অগ্রণী স্থানে ছিল। ফলে প্রাচীনকাল থেকেই চিনি ও গুড় উৎপাদনে ভারতীয় কারিগরদের দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘দেশিনামমালা’-তে ‘হস্তযন্ত্র’ বা ‘পীড়নযন্ত্র’ নামক আখ থেকে রস নিষ্কাশনের যন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। চৈনিক লেখক চৌ-জু-কুয়া মন্তব্য করেছেন যে, আদি-মধ্যযুগে মালবে প্রচুর চিনি উৎপাদন হত এবং তার অনেকটাই গুজরাট অঞ্চলে পাঠানো হত। চিনি ও গুড় শিল্প পৃথক ছিল বলে রাজস্থানের ‘অর্জুনা লেখ’তে বলা হয়েছে।
অধ্যাপক শর্মা লিখেছেন যে, নবম-দ্বাদশ শতকে ভারতবর্ষে রবিশস্য উৎপাদনের ব্যাপকতা ছিল। তৎকালে প্রচুর পরিমাণে তৈলবীজের চাষ-আবাদ হত। তৈলবীজ অধিক উৎপাদিত হওয়ার ফলে এদেশে প্রচুর তেল উৎপাদন হত। সমকালীন লেখমালায় ‘তৈলিক’ বা ‘তৈলি’ নামক বৃত্তিজীবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল তেলের ক্রয়বিক্রয়। অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী দশম শতকে তেল উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত দু-ধরনের যন্ত্রের উল্লেখ করেছেন। কামসূত্রের টিকা জয়মঙ্গলা’তে উদ্ধৃত কয়েকটি সূত্রের ভিত্তিতে ঔদ্র’ও ‘চক্রিক’ নামক দুটি বীজ পেষাই-এর যন্ত্রের নাম জানা যায়। ‘ঔদ্র’ নামক যন্ত্রে সাধারণভাবে বীজ পেষাই করা যেত (‘ঔদ্রা হি পুতিক যন্ত্রেন পীড়য়ন্তি’)। ‘চক্রিক’ ছিল ঘানিজাতীয় যন্ত্র যা চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে শস্যদানা পেষাই করত (‘চক্রিক তু চতুর্থ পার্শ্বেষু চল্যা মানেন’)। সমাকালীন লেখতে ‘ঘানি’র উল্লেখও পাওয়া যায়। ১০৩৪ খ্রিস্টাব্দে শিলাহার ছিন্তুরাজের চিনচানি তাম্রশাসনে একটি মন্দিরের উদ্দেশ্যে একটি ঘানি উৎসর্গ করার কথা উল্লেখ আছে। লেখটির শেষাংশে এক সতর্কবাণী উৎকীর্ণ করে বলা হয়েছে যে, কেউ এই ঘানির অপঘাত ঘটালে তিনি অশেষ পাপের ভাগীদার হবেন এবং নরকযন্ত্রণা ভোগ করবেন। অধ্যাপক চক্রবর্তীর মতে, “এই অভিশাপটি পরোক্ষভাবে ঘানির ব্যাপক ব্যবহার ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে।”
প্রাচীনকাল থেকেই বস্তুবয়ন শিল্পে ভারতীয়দের খ্যাতি ছিল। আদি-মধ্যযুগের সেই ধারা অব্যাহত ছিল। হেমচন্দ্র বিরচিত ‘প্রবন্ধচিন্তামণি’ গ্রন্থে তুলো পেঁজা এবং পেঁজার জন্য ধনুর ব্যবহারের উল্লেখ আছে। সমকালীন সাহিত্য, লেখমালা ও আরব পর্যটকদের বিবরণ থেকে এদেশে বস্ত্র ব্যবসার ব্যাপকতা ও বস্ত্রশিল্পের কেন্দ্রগুলির নাম জানা যায়। একাদশ শতকে রচিত ‘মানসোল্লাস’ গ্রন্থে মুলস্থান (মুলতান), বঙ্গ (বাংলাদেশ), অনহিলপত্তম (অনহিলওয়াড়া), চোলদেশ, নাগপট্টন প্রভৃতি অঞ্চলকে বস্ত্র উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। চৌ-জু-কুয়া মালব ও গুজরাটকে বস্ত্র শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে প্রশংসা করেছেন। বস্ত্র উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে পাটন এর নাম পাওয়া যায় ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে। আল মাসুদি, ইবন ঘোরদাদরা প্রমুখ আরব লেখক এবং চিনা লেখক চৌ-জু-কুয়া প্রমুখ বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের প্রশংসা করেছেন। মার্কোপোলো পূর্ব দাক্ষিণাত্যে বরঙ্গল রাজ্যের বস্ত্র শিল্পীদের দক্ষতার কথা উল্লেখ করেছেন। ভক্তপ্রসাদ মজুমদার কামরূপরাজ ধর্মপালের আমলে উৎকীর্ণ দ্বাদশ শতকের একটি লেখর ভিত্তিতে ভারতের পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলে তাঁত শিল্পীদের সক্রিয়তার অস্তিত্ব উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, প্রাক্-মধ্যযুগে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক ও তার পূর্ববর্তীকালে তাঁত শিল্পের জন্য খ্যাত ভারতীয় অঞ্চলগুলির উল্লেখ আদি-মধ্যযুগের উপাদানে পাওয়া যায় না। এ থেকে অনুমান করা হয়, সম্ভবত ষষ্ঠ শতকের পরবর্তীকালে মগধ, কৌশাম্বী, মথুরা প্রভৃতি বস্ত্রবয়ন কেন্দ্রগুলি অবক্ষয়ের গ্রাসে পড়েছিল।
আদি-মধ্যযুগে ধাতু শিল্পের ক্ষেত্রেও ভারতীয়দের সক্রিয়তা দেখা যায়। দ্বাদশ শতকে রচিত ‘পর্যায়মুক্তাবলি’ গ্রন্থের ভিত্তিতে ড. রামশরণ শর্মা উল্লেখ করেছেন যে, সেখানে লোহার ব্যবহার শিল্পীদের করায়ত্ত ছিল। তিনি ছয় প্রকার লোহার অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করেন। কোনারকের সূর্যমন্দির ও পুরীর গুণ্ডিচাবাড়িতে লৌহনির্মিত কড়ি-বর্গার ব্যবহার লক্ষণীয়। তামা ও ব্রোঞ্জের ব্যাপক ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। অসংখ্য তাম্রশাসনের ব্যবহার এবং ব্রোঞ্জনির্মিত ভাস্কর্য কর্মগুলি এর প্রমাণ দেয়। ধাতুর ব্যবহার করায়ত্ত হওয়ার কারণে ভারতীয় কারিগররা অস্ত্র নির্মাণে দক্ষতা দেখান। রাজা ভোজের ‘যুক্তিকল্পতরু’ গ্রন্থে পাল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ মগধ ও অঙ্গদেশে উন্নত মানের তলোয়ার নির্মিত হত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আরব লেখকরাও পাল সাম্রাজ্যের তলোয়ারের প্রশংসা করেছেন। বারাণসী সৌরাষ্ট্র ও কলিঙ্গদেশ তলোয়ার নির্মাণে খ্যাতি অর্জন করেছিল।
আদি-মধ্যযুগের শিল্প-সংগঠন বা গিল্ড :
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকেই উত্তর ভারতে কারিগরি শিল্পে পেশাদারি সংগঠনের আবির্ভাব ঘটেছিল। বৌদ্ধায়ন ধর্মপুত্র, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ও পালি সাহিত্যে এই জাতীয় বৃত্তিমূলক সংগঠনগুলিকে ‘শ্রেণি’, ‘গণ’, ‘পুগ’, ‘সংঘ’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। বিনয়পিটকের রচনাকাল থেকে বিভিন্ন কারিগরদের নিজ নিজ শ্রেণি বা সংগঠনের অধীনে কাজ করতে দেখা যায়। এগুলিকেই গিল্ড (Guild) বা শিল্পসংঘের অনুরূপ সংগঠন বলা হয়। প্রতিটি হস্তশিল্পের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র সংগঠন ছিল। ধর্মশাস্ত্রগুলিতে পেশাদারি সংগঠনগুলির বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে। বৃহস্পতি স্মৃতি, নারদ স্মৃতি ইত্যাদিতে সমকালীন অনুশাসনের ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে, ‘আচার্য’ বা ‘প্রমুখ’ অর্থাৎ প্রধান কারিগরদের অধীনে সংঘগুলি কর্মরত থাকবে। সংঘের কাজকর্ম তত্ত্বাবধানের জন্য ‘কাৰ্যচিত্তক, ‘হিতবাদী’ নামক কর্মচারী নিযুক্ত হতেন।
গুপ্ত রাজাদের আমল থেকে কিছু লেখ ও সিলমোহরে গিল্ড-এর প্রধানদের নামোল্লেখ পাওয়া যায়। স্কন্দগুপ্তের ইন্দোর তাম্রশাসনে (৪৬৬ খ্রিঃ) জীবন্ত নামক জনৈক ব্যক্তিকে উক্ত এলাকার তৈলিক বা তেল উৎপাদন শ্রেণির প্রধান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নবম-দশক শতকে উৎকীর্ণ গুর্জর প্রতিহারদের কিছু লেখতে গোয়ালিয়র ও সিয়াডোনী অঞ্চলের সংঘ-প্রধানদের নাম পাওয়া যায়। বিজয়সেনের ‘দেওপাড়া লেখ’তে শূলপাণি নামক ব্যক্তিকে ‘বরেন্দ্রক শিল্পীগোষ্ঠী চূড়ামণি’ বলা হয়েছে।
দ্বাদশ শতক থেকে শ্রেণি সংগঠনগুলির চরিত্র পরিবর্তিত হয়েছিল বলে সাম্প্রতিক কোনো কোনো গবেষক মনে করেন। বিজ্ঞানেশ্বর ‘শ্রেণি’ অর্থে বিভিন্ন জাতির এক-একটি গোষ্ঠীকে বুঝিয়েছেন, যেমন—চর্মকার, কুবিন্দ (তাঁতি), তাম্বলিক ইত্যাদি। ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’ ও ‘বৃহৎ ধর্মপুরাণে’ ৩৬ টি মিশ্রজাতির উল্লেখ আছে। এদের জাতিভিত্তিক নিজস্ব সংগঠন ছিল। যেমন—কর্মকার, কুম্ভকার, শাঙ্খিক, রজক, মালাকার ইত্যাদি। সম্ভবত, আদি-মধ্যযুগে সংঘগুলির সদস্যসংখ্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পুরোনো সংঘগুলি ভেঙে যায় এবং ক্রমে জাতিভিত্তিক সংঘ গড়ে ওঠে। স্বভাবতই সংঘগুলি আগেকার সাংগঠনিক শক্তি ও সংহতি থেকে বিচ্যুত হয়। এর সাথে আরও কিছু কারণের সমন্বয় ঘটলে আদি-মধ্যযুগের মাঝামাঝি সময়ে শিল্প-সংগঠনগুলির অবক্ষয় দেখা দেয়। রণবীর চক্রবর্তীর মতে, শ্রেণির অভ্যন্তরীণ পরিচালন ব্যবস্থার ওপর শাসকশ্রেণির কর্তৃত্ব ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ায় ‘শ্রেণি’গুলির স্বাতন্ত্র্য বিঘ্নিত ও ক্ষুণ্ন ।। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে রচিত লেখ-পদ্ধতিতে ‘শ্রেণিকরণ’ শব্দটির উল্লেখ আছে। এর অর্থ এক প্রশাসনিক দপ্তর বা ‘করণ’ বা শ্রেণির ওপর নজরদারি করার দায়িত্বপ্রাপ্ত। এর ফলে সমবায় সংঘ বা শ্রেণির স্বাধীন অস্তিত্ব বিপন্ন হয়।
আদি-মধ্যযুগের ‘শ্রেণি’গুলিকে নানা শাস্ত্রে জাতি অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকের ‘বৃহৎধর্ম পুরাণ’ ও ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে’ শ্রেণিগুলিকে বলা হয়েছে ‘শংকর’ বা ‘মিশ্র’ জাতি, যা তৎকালীন সমাজে নিম্ন পর্যায়ভুক্ত বলেই বিবেচিত হত। জম্বুদ্বীপ প্রজ্ঞপ্তি’ গ্রন্থে কুম্ভকার, তত্ত্ববায় প্রভৃতি শ্রেণিকে শুদ্ধ বলা হলেও চর্মকার, তৈলিক, কাঁসারি প্রভৃতি মিশ্র শ্রেণিকে (জাতি) অচ্ছুৎ ঘোষণা করা হয়েছে। জিনসেন সুরির ভাষ্যেও শিল্প কর্মকারদের সকলকে নিচ্ ও অধম বলা হয়েছে (‘শিল্প কর্মকার সমুদয় অধম’)। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের মতে, আদি-মধ্যযুগে শিল্প-সংগঠনগুলি ‘শ্রেণি’তে বিভক্ত হয়ে পড়লে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি আপনা থেকেই দুর্বল হয়ে পড়ে। গোপগিরির দুটি লেখতে (৮৭৫ ও ৮৭৬ খ্রিঃ) অন্তত ২০ জন ‘তৈলিক প্রধান’ ও ১৪ জন মালাকার প্রধান-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ একটি বৃত্তিতে নিযুক্ত ব্যক্তিদের একাধিক সংগঠন ও একাধিক প্রধান ছিলেন। এই ঘটনা শ্রেণি-সংঘবদ্ধতার মূলে চিড় চড়াতে বাধ্য। ভক্তপ্রসাদ মজুমদার ‘Decline of guilds in Early Medieval India” শীর্ষক প্রবন্ধে শিল্প-সংগঠনগুলির ক্রমিক অবক্ষয়ের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে, আদি-মধ্যযুগে ভূমিদান ব্যবস্থার ব্যাপকতা, জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার উৎপত্তির ফলে যে নতুন ভূস্বামী শ্রেণির অভ্যুত্থান ঘটে, তারা জমিতে অধিক সংখ্যক কৃষক নিয়োগ করতে থাকে। ফলে শিল্প-সংগঠনে যথেষ্ট শ্রমিকের অভাব প্রকট হয়। এতে ‘শ্রেণি’ দুর্বল হয়। তা ছাড়া, ইতিপূর্বে শ্রেণির বা সংঘ সাংগঠনিকভাবে ব্যাংকের ভূমিকা পালন করত। সদস্যরা সংঘের হাতে তাদের আমানত জমা রাখত। কিন্তু আদি-মধ্যযুগে সংগঠনের পরিবর্তে সংঘের প্রধানের কাছে ব্যক্তিগত স্তরে আমানত সঞ্চয় রাখার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ফলে শ্রেণির আর্থিক ভিত্তি শিথিল হয়ে পড়ে। এইভাবে রাজকীয় হস্তক্ষেপ, শ্রেণিগুলির সামাজিক চরিত্রের পরিবর্তন, শ্রেণি সংগঠনের খণ্ডিতকরণ, শ্রমশক্তির অপ্রতুলতা ইত্যাদি একাধিক কারণে আদি-মধ্যযুগে শিল্পসংগঠন বা শিল্পব্যবস্থা অবক্ষয়ের শিকার হয়।