খলজি বংশ (১২৯০-১৩২০ খ্রিঃ)
খলজিদের আদি পরিচয় সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। মধ্যযুগীয় ঐতিহাসিক নিজামউদ্দিন, ফেরিস্তা প্রমুখের মতে, খলজিরা তুর্কিজাতির অন্তর্ভুক্ত। আধুনিক ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুকুমার রায় প্রমুখও এই বক্তব্যের সাথে একমত। এঁদের মতে, ফিরোজ খলজির পূর্বপুরুষরা তুর্কিস্থানে বসবাস করতেন। মামুদ গজনি, মহম্মদ ঘুরি এবং মোঙ্গলদের আক্রমণের সময় এঁরা মধ্য-এশিয়া থেকে আফগানিস্তানের আলমন্দ (বা হেলমন্দ) উপত্যকা ও লামঘানে এসে বসতি স্থাপন করেন। ফিরোজের পূর্বপুরুষেরা এখানে প্রায় দুশো বছর বসবাস করেন। ‘খলজ’ নামে পরিচিতি এ অঞ্চলে বসবাস করার জন্য এঁরা ‘খলজি’ নামে পরিচিত হন। দীর্ঘকাল আফগানিস্তানে বসবাসের ফলে এঁরা আফগানিস্তানের আচার-আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। তাই আদি তুর্কিরা এঁদের সমগোত্রীয় বলে মানতে অস্বীকার করে। অন্যদিকে বারাণীর মতে, খলজিরা তুর্কিদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি জাতি এবং এঁরা সম্ভবত চেঙ্গিস খাঁর জামাতা কুলিজ খাঁ’র বংশধর। যাই হোক, খলজিরা গজনি ও ঘুর বংশের সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। মামুদ ও মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের সূত্রে এঁদের অনেকে ভারতে প্রবেশ করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাই তুর্কি-মালিকদের চোখে এঁরা হিন্দুস্তানি মুসলমান হিসেবে পরিচিত হন।
খলজি বিপ্লব ও তার গুরুত্ব:
সুলতান কাইকোবাদের বিলাসব্যসন এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবনধারার সুযোগে মালিক নিজামউদ্দিন প্রকারান্তরে সুলতানি প্রশাসনের হর্তাকর্তায় পরিণত হয়েছিলেন। পিতা বুগরা খাঁ’র পরামর্শে সুলতান কাইকোবাদ কিছুটা দায়িত্বসচেতন হয়ে এই ক্ষমতালোভী অভিজাতকে মুলতানের দায়িত্ব দিয়ে দিল্লি ছাড়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু নিজামউদ্দিন নানা অজুহাতে ক্ষমতার উৎসভূমি দিল্লি ছাড়তে দেরি করেন। ইতিমধ্যে তাঁর আচরণে অন্যান্য তুর্কি অভিজাতরাও প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এই সুযোগে তাঁরা কাইকোবাদের কাছে নিজামউদ্দিন কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে রাজাদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে সুলতানকে উত্যক্ত করে তোলেন। শেষ পর্যন্ত এঁদের ষড়যন্ত্রে বিষপ্রয়োগ করে নিজামউদ্দিনকে হত্যা করা হয়।
নিজামউদ্দিনের মৃত্যু সুলতানি প্রশাসনে অস্থিরতা প্রকট করে। কারণ নিজামউদ্দিন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও অত্যাচারী হলেও দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তাঁর স্থান পূরণ করার জন্য কাইকোবাদ খলজি মালিক ফিরোজকে সামানা থেকে দিল্লিতে নিয়ে আসেন। মালিক ফিরোজ ও তাঁর ভাই শিহাবউদ্দিন (আলাউদ্দিন খলজির পিতা) সুলতান বলবনের অধীনে দীর্ঘকাল চাকরি করেছিলেন। ফিরোজ ছিলেন সাহসী সৈনিক ও দক্ষ প্রশাসক। তাই তিনি অল্পদিনের মধ্যে ‘সর-ই-জন্দার’(দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান) পদে উন্নীত হন। একইসঙ্গে তিনি সীমান্ত রাজ্য সামানার গভর্নর নিযুক্ত হন। সামানার প্রশাসক হিসেবে তিনি মোঙ্গল আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। নিজামউদ্দিনের মৃত্যুর পর সুলতান কাইকোবাদ এই দক্ষ যোদ্ধা এবং প্রশাসককে দিল্লিতে এনে বরণের গভর্নর নিযুক্ত করেন এবং ‘আর্জ-ই-মামালিক’ পদে মালিক চাড্ডুর স্থলাভিষিক্ত করেন।
ফিরোজ খলজির এই পদোন্নতি ক্ষমতাগবী তুর্কি অভিজাতদের ঈর্ষান্বিত ও ক্ষুব্ধ করে তোলে। এঁদের মতে, খলজি বংশ মর্যাদাগতভাবে তুর্কিদের সমকক্ষ নয়। তুর্কিদের বিচারে খলজিরা হিন্দুস্তানি মুসলমান। একজন তুর্কি সুলতানের অধীনে একজন হিন্দুস্তানি সৈনিকের এই উন্নতি তাদের উষ্মার কারণ হয়। কাইকোবাদ এই সময় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে জটিল অবস্থা আরও জটিলতর হয়। তুর্কি অভিজাতরা এই ভেবে আশঙ্কিত হন যে, অতঃপর পঙ্গু সুলতানকে আড়ালে রেখে ফিরোজ খলজি রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করবে এবং তুর্কি অভিজাতদের মর্যাদা ও অধিকার বিনষ্ট হবে। এর ফলে মালিক আইতিমার (কাচ্চন) এবং মালিক সুরখা’র নেতৃত্বে তুর্কি অভিজাতরা ফিরোজের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হন। অন্যদিকে তুর্কি-আধিপত্যের বিরোধী তথা পরিবর্তনপন্থী অভিজাতবর্গ মালিক ফিরোজ খলজির নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হন। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, কাইকোবাদ জীবিত থাকা সত্ত্বেও, তুর্কি অভিজাতরা তাঁর তিন বছরের শিশুপুত্র কায়ুমসকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন এবং ‘দ্বিতীয় সামসউদ্দিন উপাধি দিয়ে রাজধানীর ‘চবুতরা-ই-নাসিরী ‘প্রাসাদে অভিষেক সম্পন্ন করেন। অতঃপর কাচ্চন ও সুরখা ফিরোজের প্রাণনাশের এক পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করেন।
এই সময় মালিক ফিরোজ ‘ভুগাল পাহাড়ী’ (বারাণীর মতে বাহারপুর)-তে সামরিক বাহিনী পরিদর্শনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ‘নায়েব-ই-হাজির মালিক মহম্মদ চাপ মারফত ফিরোজ এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারেন এবং অতি সন্তর্পণে নিজের সমর্থকদের নিয়ে গিয়াসপুরে চলে যান। তুর্কিদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তিনি নির্লিপ্ততা দেখান এবং প্রচার করেন যে, সম্ভাব্য মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার জরুরি প্রয়োজনেই তিনি রাজধানীতে ফিরে যেতে পারছেন না। এই সময় কায়ুমর্সের এক জরুরি নির্দেশ নিয়ে মালিক কাচ্চন ফিরোজের শিবিরে উপস্থিত হলে ফিরোজ তাঁকে হত্যা করেন। অতঃপর ফিরোজ খলজি দ্রুত রাজধানীতে উপস্থিত হন। তাঁর পুত্র প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করে শিশু-সুলতান কায়ুমসকে নিজেদের শিবিরে নিয়ে চলে আসেন। মালিক সুরখা ও অন্যান্য তুর্কি-মালিকরা খলজিদের বাধা দিতে এলে সুরখা-সহ অনেকে নিহত হন। ফব্রুদ্দিন কোতোয়াল দিল্লির জনগণকে খলজিদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। সুরখা ও কাচ্চনের মৃত্যুর ফলে তুর্কিদের মনোবল ভেঙে যায় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। বহু তুর্কি এবং অ-তুর্কি আমির ও মালিক ফিরোজ খলজির পক্ষ অবলম্বন করলে তিনি অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হন।
ড. নিজামীর মতে, তুর্কি-অভিজাতদের বিরুদ্ধে ফিরোজ খলজির এই লড়াই ছিল নিতান্তই আত্মরক্ষামূলক। দিল্লির রাজক্ষমতা দখলের আদৌ কোনো ইচ্ছা যে তাঁর ছিল না সেকথা প্রমাণ করে তাঁর পরবর্তী আচরণ। বিরোধী তুর্কিদের ষড়যন্ত্র ধ্বংস করার পর ফিরোজ কায়ুমসকে কিলখোরী প্রাসাদে সুলতানি সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং মালিক চাজ্জুকে নাবালক সুলতানের অভিভাবকত্ব গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু চাড্ডু কারা-মানিকপুরের গভর্নরপদে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ফিরোজ কোতোয়াল ফব্রুদ্দিনকে অভিভাবকত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেন। কিন্তু বৃদ্ধ কোতোয়ালও সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। অতঃপর ফিরোজ সুলতানের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন।
সম্ভবত এই সময় তাঁর মনে সুলতানি সিংহাসন দখলের পরিকল্পনা আসে। এই রাজনৈতিক প্রহসন শেষ করার জন্য তাঁর নির্দেশে জনৈক খলজি মালিক কিলখোরী প্রাসাদে প্রবেশ করে পক্ষাঘাতে পঙ্গু এবং শয্যাশায়ী কাইকোবাদকে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহ যমুনার জলে নিক্ষেপ করে। শিশু কায়ুমসকে কারারুদ্ধ করা হয়। অতঃপর ফিরোজ ‘জালালউদ্দিন ফিরোজ শাহ’ নাম নিয়ে কিলখোরী প্রাসাদে নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন (১২৯০ খ্রিঃ)। ঐতিহাসিক আর. পি. ত্রিপাঠী ও কে. এস. লাল প্রমুখ এই ঘটনাকে ‘খলজি-বিপ্লব’ (Khalji Revolution) নামে অভিহিত করে বিশেষ ইতিহাসগত মর্যাদা দিয়েছেন।
ড. লাল, হবিবউল্লাহ ও ত্রিপাঠী প্রমুখ অধিকাংশ ঐতিহাসিক ‘খলজি-বিপ্লব’কে ভারত ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী ঘটনা বলে মনে করেন। ড. কে. এস লাল-এর মতে, “এই বিপ্লব কেবল একটি রাজবংশ থেকে অন্য রাজবংশের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সাধারণ ঘটনা ছিল না। এটি ছিল তুর্কি একাধিপত্যের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানদের জেহাদ ও সাফলের নিদর্শন।”
মহম্মদ ঘুরির আমল থেকে ভারতীয় মুসলিম সাম্রাজ্যে শুধুমাত্র তুর্কি মুসলমানদের কর্তৃত্ব ও মর্যাদা সরকারিভাবে স্বীকৃত ছিল। ইলতুৎমিস, বলবন প্রমুখ প্রত্যেক সুলতান গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে তুর্কি-মুসলমান ছাড়া কাউকে নিয়োগ করতেন না। অথচ ভারতবর্ষে তুর্কি-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একেবারে প্রাথমিক পর্ব থেকেই অবহেলিত খলজিরা অতি বিশ্বস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তরাইনের প্রথম যুদ্ধে’ (১১৯০ খ্রিঃ) তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানের হাতে যখন মহম্মদ ঘুরি পরাজিত ও মারাত্মক রূপে আহত হন, তখন একজন খলজি অনুচরই চরম বিশ্বস্ততা ও সাহসের পরিচয় দিয়ে তাঁকে বিপদমুক্ত করেছিলেন। বখতিয়ার খলজি আপন শৌর্য ও দক্ষতা দ্বারা বাংলা-বিহারসহ পূর্ব-ভারতে মহম্মদ ঘুরির বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। স্বভাবতই মামেলুক সুলতানদের আমলে সরকারি উচ্চপদে খলজি অভিজাতদের একটি দাবি পরোক্ষে স্থাপিত হয়েছিল। এদিকে ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে মোঙ্গল যোদ্ধারা হেলমন্দ উপত্যকা ও কাবুল আক্রমণ করে ধ্বংসলীলা চালালে খলজিরা দলে দলে ভারতে প্রবেশ করে এবং গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। মামেলুক সুলতানদের উন্নাসিকতার ফলে খলজিদের অধিকাংশই যোগ্যতা ও দক্ষতা সত্ত্বেও সাধারণ কৃষিজীবী রূপে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। ইলতুৎমিস, বলবন প্রমুখ তুর্কি ও খলজিদের মধ্যে জাতিগত ভেদাভেদের প্রাচীর তুলে শেষোক্তদের রাজনৈতিক অধিকার সংকুচিত করে রাখেন।
বলবন তো প্রকাশ্যেই জাতি ও বংশকৌলীন্যকে সরকারি পদে নির্বাচনের প্রধান মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করার চেষ্টা করেন। ফলে খলজি ছাড়াও অন্যান্য বহিরাগত মুসলমান এবং ধর্মান্তরিত ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে তুর্কি শাসনের প্রতি তীব্র ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়। জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজির মামেলুক-বিরোধী প্রয়াস এইসব বিক্ষুব্ধগোষ্ঠীকে অনিবার্যভাবেই তাঁর সমর্থকে পরিণত করে। জাল উদ্দিন ফিরোজ ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রাসাদ-বিপ্লব ঘটিয়ে অ-তুর্কি মুসলমানদের বাসনাকে বাস্তব রূপ দেন। খলজি-বিপ্লব দ্বারা দিল্লির সিংহাসন দখল করে ফিরোজ খলজি প্রমাণ করেছিলেন যে, দিল্লির সিংহাসনে তুর্কিজাতির অধিকার একচেটিয়া নয়। এই বিপ্লব প্রমাণ করেছিল যে, রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য বংশকৌলীন্য বা নীলরক্ত আবশ্যিক নয়। ড. লাল (K. S. Lal) তাঁর ‘History of the Khalji’s’ গ্রন্থে লিখেছেন : “The revolution resulted in the supercession of commoner’s government over that of the Blue-blood’s.”
খলজি-বিপ্লব প্রমাণ করে যে, ধর্ম এবং ধর্মগুরু বা উলেমাদের সাহায্য এবং প্রভাবমুক্ত হয়েও রাজনৈতিক লক্ষ্যে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। ইলতুৎমিস কিংবা বলবন রাজনীতিতে উলেমাদের কর্তৃত্বকে যেভাবে স্বীকার করেছিলেন, তাতে রাষ্ট্রনীতির ওপর ধর্মের সর্বগ্রাসী ছায়া প্রসারিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। ‘ঈশ্বরসৃষ্ট রাজপদের সাফল্য ধর্মগুরুদের শুভেচ্ছার ওপর নির্ভরশীল’—এই তত্ত্বকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছিলেন ফিরোজ খলজি। ড. ত্রিপাঠী মন্তব্য করেছেন, “খলজি-বিপ্লবের প্রধান অস্ত্র ছিল ফিরোজ খলজির অস্ত্রশক্তি।” এর ফলে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতিগত পরিবর্তন সম্ভব হয়। দিল্লি-সুলতানি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র না হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
খলজি-বিপ্লব দিল্লির সিংহাসনে রাজবংশ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এক গতিশীল ও প্রাণবন্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা করে। অধ্যাপক লাল লিখেছেন: “It ushered in an era of ceaseless conquers, of unique experiment in state craft and of incomparable literary activity.” খলজি বংশের সুলতান আলাউদ্দিন খলজির নেতৃত্বে দিল্লি-সুলতানির ভারতীয় সাম্রাজ্যে উত্তরণের যুগ শুরু হয়। উত্তর ভারতের সীমানা অতিক্রম করে দক্ষিণ ভারতের ওপর সুলতানি প্রশাসনের কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত হয় খলজিদেরই নেতৃত্বে। ইলতুৎমিস বা বলবন মহম্মদ ঘুরি এবং কুতুবউদ্দিনের সাম্রাজ্যকে সামান্যতম সম্প্রসারিত করেননি। দিল্লিভিত্তিক সুলতানি রাজ্যকে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যে রূপান্তরের শুরু হয়েছিল খলজি সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে। আর সেই খলজি সাম্রাজ্যবাদের সূচনা ছিল খলজি-বিপ্লব।
খলজি-বিপ্লব এবং পরবর্তী ঘটনাবলি একাধারে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব ও জনমতের ভূমিকা ও গুরুত্ব প্রমাণ করে। দিল্লির মামেলুক সুলতানদের কেন্দ্র করে যে ধরনের আনুগত্য গড়ে উঠেছিল, তাতে সিংহাসন দখলের ক্ষেত্রে সামরিক শক্তির গুরুত্ব ক্রমশ শিথিল হচ্ছিল। তুর্কি অভিজাতবর্গ সুলতানের মনোনীত ব্যক্তি কিংবা তার পুত্র-কন্যাকেই উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছিলেন। কিন্তু ফিরোজ খলজি সামরিক অভ্যুত্থানের দ্বারা সিংহাসন দখল করলে এই সত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় যে, সামরিক শক্তি দ্বারা ক্ষমতাদখলের মধ্যযুগীয় রীতি তখনও যথেষ্ট সক্রিয়। মামেলুক সুলতানদের আমলে সৃষ্ট জন-আনুগত্যের ভিত্তি খুবই শিথিল। আবার একই সঙ্গে ক্ষমতাদখলের অব্যবহিত পর ফিরোজ খলজির কর্মধারা ঠিক বিপরীতধর্মী একটি উপাদানের অস্তিত্ব তুলে ধরে। ফিরোজ কর্তৃক জোরপূর্বক ক্ষমতাদখলের সংবাদে দিল্লির মুসলমান জনতার মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। প্রধানত উলেমা ও তুর্কি অভিজাতদের প্ররোচনায় অভ্যুত্থান-বিরোধী একটা গণমানসিকতার অস্পষ্ট আভাস অনুভূত হয়েছিল। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, ইতিমধ্যে দিল্লির মুসলিম জনতার মধ্যে একটা রাজনৈতিক চেতনা ও আনুগত্যবোধ সৃষ্টি হয়েছিল। এই বিরূপতার সোচ্চার প্রকাশ হয়তো ছিল না, কিন্তু গভীরতা নিশ্চয়ই ছিল। অন্যথায় ফিরোজ খলজি ক্ষমতাদখলের অব্যবহিত পরেই দিল্লিতে প্রবেশ করতে দ্বিধা করতেন না। ক্রমে মুসলিম জনতার আস্থা অর্জন করার পর তিনি দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, এই সময় সামরিক শক্তিভিত্তিক স্বৈরাচারিতা এবং গণসমর্থনভিত্তিক রাজতন্তের ধারণা দোদুল্যমান অবস্থায় সহাবস্থান করছিল। পরিস্থিতি অনুযায়ী কোনো একটি শক্তি অপরটিকে টপকে সামনে এসে পড়েছিল। যাই হোক, জনমতের এই পরিণতি স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষেত্রে একটা ক্ষীণ আশার সঞ্চার করেছিল।