আলাউদ্দিন খলজির বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ:
আলাউদ্দিন খলজির রাষ্ট্রনীতি রূপায়ণে তাঁর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংঘটিত বিদ্রোহগুলির বিশেষ ভূমিকা ছিল। দিল্লির সিংহাসন দখল করার পরেও তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল। সুলতান ও তাঁর সুযোগ্য অনুচরবৃন্দ অবশ্য এই সকল অভ্যুত্থান দমন করে দেন।
১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটবিজয় সম্পন্ন করে দিল্লি প্রত্যাবর্তনের পথে নব-মুসলমানদের একাংশ প্রথম রাজদ্রোহী হয়। ইসলামে ধর্মান্তরিত মোঙ্গলদের ‘নব-মুসলমান’ বলা হত। জালালউদ্দিনের আমল থেকেই এরা দিল্লিতে বসবাস শুরু করে এবং সুলতানি বাহিনীতে যোগ দেয়। গুজরাটে অভিযানকালে সৈনিকেরা যে অর্থ লুণ্ঠন করে, নিয়মানুযায়ী তার একাংশ সুলতানের প্রাপ্য। কিন্তু নব-মুসলমানদের একাংশ এই অর্থ দিতে অসম্মত হয় এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে। জলোর নামক স্থানে মহম্মদ শাহ, খবরু, ইলহক্ এবং বুরাক্ নাম্নী চার নেতার প্ররোচনায় দুই থেকে তিন হাজার অশ্বারোহী উলুঘ খাঁর শিবির আক্রমণ করে। উলুঘ খাঁ পেছনের দরজা দিয়ে নুসরৎ খাঁর তাঁবুতে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। বিদ্রোহীরা নুসরৎ খাঁর ভ্রাতা আইজউদ্দিন ও আলাউদ্দিনের ভাগিনেয়কে হত্যা করে। ইতিমধ্যে সুলতানি অনুগত যোদ্ধারা রুখে দাঁড়ালে বিদ্রোহী নেতারা রণথম্ভোরে গিয়ে রানা হামিরের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। সুলতানের নির্দেশে বিদ্রোহীদের পুত্রকন্যা ও পত্নীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। বারাণীর মতে, এইভাবে আলাউদ্দিন গৃহকর্তার অপরাধের শাস্তি তার স্ত্রী-পুত্রের ওপর আরোপের রীতি চালু করেন। কিন্তু উলসী হেগ মনে করেন, “এই ধরনের রীতি আগেও চালু ছিল; আলাউদ্দিন রাষ্ট্রনীতির সাথে একে যুক্ত করেছিলেন।”
আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আকৎ খাঁ। আকৎ ছিলেন ভকিলদার। রণথস্তোর বিজয়ের জন্য যাত্রা শুরু করে আলাউদ্দিন সৈন্যসংগ্রহের জন্য তিলপত্ নামক স্থানে কয়েকদিন অবস্থান করেন। এই সময় একদিন যখন তিনি শিকারের উদ্দেশ্যে মাচায় বসেছিলেন, তখন আকৎ খাঁ ও তার সঙ্গীরা ‘বাঘ’ ‘বাঘ’ চিৎকার করে সুলতানের দিকেই তির নিক্ষেপ করতে থাকে। জনৈক বিশ্বস্ত ক্রীতদাস মানিক (মতান্তরে নায়েক) সুলতানকে নিজের দেহ দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করে। তবুও দুটি তির আলাউদ্দিনকে বিদ্ধ করে এবং তাঁর প্রচুর রক্তপাত হয়। সুলতান অজ্ঞান হয়ে যান। আকৎ খাঁ সম্মুখে এসে তরবারি দ্বারা তাঁর মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে উদ্যত হন। সুলতানের অতি বিশ্বস্ত পাইকরা ঘটনার আকস্মিকতায় বিভ্রান্ত হলেও আকৎ খাঁকে বলেন যে, সুলতান যখন মারাই গেছেন, তখন আর তাঁর মুণ্ডচ্ছেদ করা কেন? পাইকদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে আকৎ ফিরে যান এবং নিজেকে ‘সুলতান’ বলে ঘোষণা করেন। অতঃপর আকৎ খাঁ সুলতানের হারেমে প্রবেশ করতে চাইলে হারেমের প্রধান রক্ষক মালিক দিনার বাধা দেন এবং মৃত সুলতানের ছিন্নমুণ্ড প্রদর্শনের দাবি করেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই আলাউদ্দিনের মুণ্ড সেখানে আনীত হয়, তবে, লেনপুলের ভাষায় : ছিন্ন অবস্থায় নয়, আলাউদ্দিনের সচল গর্দানের সাথেই জীবিত আলাউদ্দিনকে দেখেই আকৎ খাঁ অর্ধমৃত হয়ে পড়েন। তাঁকে বন্দি ও হত্যা করা হয়। তাঁর ভাইসহ অন্যান্য অনুচরদেরও হত্যা করা হয়। আলাউদ্দিন কয়েকদিনের মধ্যেই রণথম্ভোর যাত্রা করেন।
রণথম্ভোরের যুদ্ধে আলাউদ্দিন যখন ব্যস্ত, সেই সুযোগে তাঁর দুই ভাগিনেয় মালিক উমর ও মঙ্গ খাঁ বিদ্রোহী হন। এঁরা তখন যথাক্রমে বদাউন ও অযোধ্যার শাসনকর্তা ছিলেন। সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য এঁরা সৈন্য সংগ্রহ শুরু করেন। সংবাদ পাওয়ামাত্র আলাউদ্দিনের নির্দেশে এঁদের গ্রেপ্তার করে রণথভোরে আনা হয় এবং সুলতানের নির্দেশে প্রথমে চক্ষু উৎপাটন করে পরে হত্যা করা হয়। এদের পরিবারবর্গ ও অনুচরদেরও হত্যা করা হয়।
১৩০১ খ্রিস্টাব্দের মে-জুন মাসে দিল্লিতে আলাউদ্দিনের অনুপস্থিতির সুযোগে সেখানে এক গভীর ষড়যন্ত্র রূপ নেয়। এই ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিলেন হাজি মৌলা নামক জনৈক সরকারি কর্মচারী। দিল্লির কোতোয়াল আলা-উল-মুল্ক-এর মৃত্যুর পর দিল্লির কোতোয়াল পদে নিযুক্ত হন বায়াজিদ তিরমিজ। এই সময় সিরিতে নতুন রাজধানী নির্মাণের কাজ চলছিল। তাই সেখানে স্বতন্ত্র কোতোয়াল হিসেবে মহম্মদ আয়াজ’কে নিয়োগ করা হয়েছিল। তিরমিজ তাঁর রুক্ষ ব্যবহারের জন্য খুবই অ-জনপ্রিয় ছিলেন। সেই সময় আলাউদ্দিন রণথত্তোর দখলের কাজে সেখানে ব্যস্ত ছিলেন। এই সুযোগে হাজি মৌলা আলাউদ্দিনকে সিংহাসনচ্যুত করার এক ষড়যন্ত্র করেন। বারাণীর মতে, ‘হাজি মৌলা ছিলেন একজন দুঃশ্চরিত্র, দুর্নীতিপরায়ণ এবং বেপরোয়া ষড়যন্ত্রী প্রকৃতির মানুষ।”
হাজি মৌলা বিদ্রোহের জন্য মে-জুন মাসে রমজানের সময়টাকে বেছে নেন। আলাউদ্দিনের নামাঙ্কিত একটা জাল নির্দেশনামা প্রদর্শন করে বেশ কিছু অনুগামী জোগাড় করে তিনি প্রথমে কোতোয়াল তিরমিজকে হত্যা করেন। অতঃপর আয়াজের সন্ধানে সিরিতে উপস্থিত হন। কিন্তু আয়াজ ইতিমধ্যেই হাজি মৌলার ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে যান এবং আত্মগোপন করে থাকেন। হাজি মৌলা লালপ্রাসাদ দখল করে সরকারি কোষাগার হস্তগত করেন। বহু বন্দিকে তিনি মুক্তি দেন। অর্থ ও মুক্তির লোভে অনেকেই মৌলাকে সমর্থন করে। অতঃপর মৌলা ইলতুৎমিসের কন্যার বংশধর জনৈক আলাভি’কে ‘দিল্লির সুলতান’ বলে ঘোষণা করেন। আলাভি অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাজি মৌলার ভয়ে সিংহাসনে বসতে বাধ্য হন। হাজি মৌলা উদার হাতে অর্থ, অস্ত্র আর ঘোড়া বিতরণ করে বহু অনুচর সংগ্রহ করেন এবং দিল্লির অধিবাসীদের আতঙ্কগ্রস্ত করে রাখতে সক্ষম হন।
আলাউদ্দিন রণথম্ভোরে যুদ্ধের চরম মুহূর্তে এই বিদ্রোহের সংবাদ পান। কিন্তু বিচক্ষণ সুলতান সমস্ত সংবাদ গোপন করে রাখেন। কারণ তাঁর লক্ষ্য ছিল প্রথমে রণথত্তোর অভিযানের নিষ্পত্তি করা। এদিকে আমরোহা থেকে ‘আমির-ই-কোহ্’ মালিক হামিউদ্দিন দিল্লিতে সৈন্য পরিদর্শনের (আজ) কাজে এসে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। ড. কে. এস. লালের মতে, আলাউদ্দিনই গোপন নির্দেশ দিয়ে হাজি মৌলার বিদ্রোহদমনের জন্য হামিদউদ্দিনকে প্রেরণ করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে উলুঘ খাঁকেও সুলতান দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন। অবশ্য উলুঘ খাঁ আসার আগেই হামিদউদ্দিন বিদ্রোহীদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। বিদ্রোহের চতুর্থ দিনে হামিদউদ্দিন দিল্লিতে ঢোকেন এবং দুদিন বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর প্রকাশ্য রাজপথে হাজি মৌলাকে হত্যা করেন। হামিদউদ্দিনও প্রতিপক্ষের অস্ত্রাঘাতে দারুণ জখম হন। এই অবস্থায় হামিদ ‘লালপ্রাসাদে’ প্রবেশ করে অসহায় এবং নিরপরাধী আলভিকে হত্যা করে তার ছিন্নমুও বর্শাফলকে গেঁথে দিল্লির রাজপথে প্রদর্শন করেন। ইতিমধ্যে উলুঘ খাঁও দিল্লিতে পৌঁছে যান। তাঁর নির্দেশে সমস্ত বিপ্লবীকে হত্যা করা হয়। এমনকি প্রাক্তন কোতোয়াল মালিক ফকরুদ্দিনের পৌত্রগণ, যাঁরা কোনোভাবেই এই অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ছিলেন না, তাঁদেরও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হাজি মৌলার বিদ্রোহদমনের সংবাদ পাওয়ার পরেও আলাউদ্দিন রণথত্তোর থেকে ফিরে সরাসরি শহরে প্রবেশ না করে মাসাধিককাল শহরের উপকণ্ঠে অবস্থান করেন। বারাণী, খসরু প্রমুখের মতে, দিল্লির জনসাধারণের অকৃতজ্ঞতায় ক্ষুব্ধ হয়ে সুলতান শহরে প্রবেশ করতে বিলম্ব করেন। বেণীপ্রসাদও এই মত সমর্থন করেন। কিন্তু অধ্যাপক লাল মনে করেন, দিল্লির অভ্যন্তরে নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হবার জন্যই আলাউদ্দিন শহরের বাইরে কিছুটা সময় অতিবাহিত করেছিলেন।