গণতন্ত্র সম্পর্কে আধুনিক রাষ্ট্রতাত্ত্বিকদের মধ্যে ডেভিড হেল্ড (David Held) একটি বিশিষ্ট নাম। গণতন্ত্র সম্পর্কিত ডেভিড হেল্ডের ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় Models of Democracy শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। গণতন্ত্র সম্পর্কিত হেল্ডের এই সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ রাষ্ট্রতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিশেষ আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। প্রাজ্ঞ এই আধুনিক রাষ্ট্রদার্শনিকের অভিমত অনুযায়ী গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণার ক্ষেত্রে ঐকমত্যের বড়ই অভাব। বিবিধ পরস্পর বিরোধী চিন্তা-ভাবনার ভারে গণতন্ত্রের ধারণা ভারাক্রান্ত। গণতন্ত্রের অর্থ সম্পর্কে অতিরিক্ত জটিলতা বর্তমান। গণতন্ত্রের অর্থ ও পরিধি প্রসঙ্গে বিবিধ প্রশ্ন উঠে আসে। তাই গণতন্ত্রের ধারণাটি এক কথায় জটিল। ডেভিড হেল্ড বলেছেন: “The idea of democracy remains complex and contested.”।
ডেভিড হেল্ড গণতন্ত্রের বিভিন্ন রূপ বা মডেল সম্পর্কিত আলোচনার আগেই গণতন্ত্রের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নির্ধারণে উদ্যোগী হয়েছেন। প্রাচীন কালে গ্রীস দেশে উদ্ভূত ‘গণতন্ত্র’ (democracy) শব্দটির উৎসগত অর্থ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। ইংরেজি ‘ডিমোক্রেসি’ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে দুটি গ্রীক শব্দের সমাহারে। সংশ্লিষ্ট গ্রীক শব্দ দুটি হল ‘ডেমস’ (Demos) ও ‘ক্রাটস’ (Kratos)। ‘ডেমস’ কথার অর্থ হল জনগণ এবং ‘ক্রাটস’ কথার অর্থ হল ‘শাসন’ বা ‘ক্ষমতা’। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘গণতন্ত্র’ বলতে জনগণের শাসনক্ষমতাকে বোঝায়। গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল কিন্তু গণতন্ত্র বলতে ‘বিশৃঙ্খল জনগণের শাসন কে বুঝিয়েছেন। তবে সূচনা কাল থেকেই গণতন্ত্রের সঙ্গে জনসাধারণের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারণা সংযুক্ত। কালক্রমে শাসনব্যবস্থায় জনসাধারণের সমানাধিকারের অর্থেই ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির বিকাশ ও বিস্তার ঘটে।
ডেভিড হেল্ড গণতন্ত্রের অর্থ পর্যালোচনা করেছেন তিনটি ধারণার ভিত্তিতে। সংশ্লিষ্ট ধারণা তিনটি হল: (১) শাসন, (২) কার দ্বারা শাসন এবং (৩) জনগণ। গণতন্ত্র বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে তিনি এই তিনটি বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন এবং ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বিবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলির উল্লেখ আবশ্যক। (১) শাসন বলতে কী বুঝতে হবে? শাসন বলতে কেবলমাত্র আইন-শৃঙ্খলা সংরক্ষণকেই বোঝায়? নাকি আর্থনীতিক ব্যবস্থা পরিচালনাকে বোঝায়? অথবা রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সম্পর্ক পরিচালনাকে বোঝায়? (২) আবার কার দ্বারা শাসন এই বিষয়টির পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও জটিল প্রকৃতির বিবিধ বিষয় উত্থাপিত হয়। এই বিষয়গুলি হল: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধিতা ও দায়বদ্ধতার ভূমিকা কীরকম হবে? জনগণের শাসন মেনে চলা কি বাধ্যতামূলক? জনগণের শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণে অক্ষমদের ভূমিকা কী হবে? (৩) জনগণ বলতে কাদের বোঝাবে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের প্রকৃতি কী রকম হবে? গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সুফল সকলের কাছে সমানভাবে নিয়ে যাওয়া যাবে কি না? হেল্ড গণতন্ত্র বিষয়টির অর্থ অনুধাবনের ক্ষেত্রে এ রকম বহু ও বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণা করেছেন।
গণতন্ত্রকে সংগঠিত রাজনীতিক জীবনের একটি রূপ হিসাবে দেখা হয়। এ দিক থেকে গণতন্ত্রের উপযোগিতার ব্যাপারে বিশ্বাস ও সমর্থন ব্যাপক। অধুনা অধিকাংশ রাষ্ট্রই গণতান্ত্রিক। এতদসত্ত্বেও এই সমস্ত রাষ্ট্রের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিপন্ন হয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার আহত অবস্থা। গণতন্ত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিক অনুসন্ধান ও পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে হেল্ড বলেছেন যে, গণতন্ত্র প্রসঙ্গে বড়ই কম বলা হয়েছে। অথচ রাজনীতিক লেখকরা গণতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগ প্রসঙ্গে অতিমাত্রায় মুখর। তবে অতি সাম্প্রতিককালে গণতন্ত্র প্রসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ অঙ্গীকারের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।
গণতন্ত্রের সম্যক অর্থের অনুসন্ধানে ডেভিড হেল্ড আত্মনিয়োগ করেছেন। গণতন্ত্র সম্পর্কে বিদ্যমান বিবিধ ধারণাসমূহকে মাথায় রেখে গণতন্ত্রের অর্থ অনুধাবনে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী গণতন্ত্রের ধারণাগত ইতিহাস বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী, মধ্যপন্থী প্রভৃতি নির্বিশেষে সকল রাজনীতিক গোষ্ঠী নিজেদের গণতন্ত্রী হিসাবে দাবি করে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমান রাজনীতিক ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অথচ সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাই নিজেদের গণতন্ত্রী বলে জাহির করে। পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের, লাতিন আমেরিকার বা পৃথিবীর অন্যান্য রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে এ কথা প্রযোজ্য।
ডেভিড হেল্ডের মতানুসারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি ও সংরক্ষণ সহজ ব্যাপার নয়, বিশেষ সমস্যাসংকূল বিষয়। এ প্রসঙ্গে তাঁর মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে হেল্ড বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস পর্যালোচনা করেছেন এবং ঐতিহাসিক নজির উত্থাপন করেছেন। তাঁর মতানুসারে গণতন্ত্রের ধারণা অনুধাবনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চিন্তা-ভাবনা ও প্রায়োগিক ইতিহাস পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদী আক্রমণের আঘাতে গণতন্ত্র বিধ্বস্ত হয়েছে। গণতন্ত্রের সৃষ্টি ও সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছে সুগভীর আত্মত্যাগ ও সামাজিক সংগ্রামের মাধ্যমে। সামাজিক, রাজনীতিক ও আর্থনীতিক জীবনে গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রভাব গভীর ও ব্যাপক হওয়া দরকার। তা হলে গণতন্ত্রের আদর্শ ও প্রয়োগ আগামী দিনে নিরুপদ্রব হবে।
গণতান্ত্রিক তত্ত্বসমূহ
গণতান্ত্রিক ধারণার বিবর্তন: গণতন্ত্র সম্পর্কিত সমগ্র বিষয়টি বহুলচর্চিত এবং বিচিত্রগামী। গণতন্ত্রের ধারণার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসটিও খুবই জটিল। উপরন্তু সাম্প্রতিক কালে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকেরাও বিভিন্নভাবে নিজেদের শাসনব্যবস্থাকে আরও বেশী করে গ্রহণীয় এবং বৈধ প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে গণতন্ত্র, গণসমর্থন ইত্যাদি শব্দগুলির ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। এর ফলে ‘গণতন্ত্র’ এই ধারণাটির ‘প্রকৃত’ অর্থ নিরূপণ করা অত্যন্ত দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তবে আধুনিক অর্থে গণতন্ত্রের ধারণা মূলতঃ ইউরোপীয় এবং উত্তর আমেরিকা জাত। সাধারণভাবে গণতন্ত্র (Democracy) শব্দটি ষোড়শ শতকে ইংরেজী অভিধানভুক্ত হয়। শব্দটির উৎস গ্রীক ভাষা। আভিধানিক অর্থে গণতন্ত্র হচ্ছে রাজতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্রের বিরোধী এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে জনগণই শাসক। অর্থাৎ ‘জনগণই’ গণতন্ত্রের মূল শক্তি; জনগণের নামেই এখানে শাসন পরিচালিত হয়। সবকিছুর পেছনেই ‘জনগণের’ (অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠের) সমর্থন, দাবী, মতামত ইত্যাদির উল্লেখ করা হয়। গণতন্ত্রের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত থাকা ‘জনগণের’ ধারণা বা অংশগ্রহণের ধরন-ধারন নিয়ে তাত্ত্বিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। যেমন ‘জনগণ’ বলতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অর্থ করা হয়েছে। যেমন কখনও বা সম্পত্তির মালিক অথবা শিক্ষিত বা শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গরাই ‘জনগণ’ এই অভিধাভুক্ত হয়েছে। আবার এই অভিধা বিংশ শতকে এসে অনেকটাই পাল্টেছে; নিয়েছে এক বিচিত্র এবং জটিল চেহারা। ডেভিড হেল্ড তাঁর Models of Democracy গ্রন্থে গণতন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা-পর্যায়কে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন প্রাচীন গ্রীসে, বিশেষ করে এথেন্সে প্রচলিত ধ্রুপদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এর পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর বিশ্লেষণের লক্ষ্য আধুনিক উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক তত্ত্ব, যার মধ্যে তিনি মূলতঃ দুটি ধরনকে চিহ্নিত করেছেন। প্রথমটি হচ্ছে সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্র এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে উন্নয়নমূলক বা বিকাশশীল গণতন্ত্র এবং প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা। হেল্ড গণতন্ত্রের এই বিভিন্ন বর্গগুলির মধ্যে পার্থক্যগুলিও অনুধাবনের চেষ্টা করছেন।
প্রকৃত প্রস্তাবে গণতন্ত্র সম্পর্কিত আলোচনা বহুমাত্রিক এবং জটিল প্রকৃতির। স্বভাবতই গণতন্ত্র বিষয়টি যেমন একমাত্রিক নয়; তেমনি তার মডেলও একটি হতে পারে না। গণতন্ত্রের একাধিক মডেলের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। গণতন্ত্রের বিভিন্ন মডেলের মধ্যে অল্পবিস্তর ধারণাগত সাদৃশ্য থাকলেও, প্রবল পারস্পরিক বিরোধিতাও বর্তমান।
প্রাচীন গ্রীক মডেল: গণতন্ত্রের আধুনিক ধারণা ও পর্যায় নিয়ে আলোচনা করার আগে প্রাচীন গ্রীসে প্রচলিত গণতন্ত্রের ধারণা নিয়ে চর্চা অসমীচিন হবে না। কারণ হেল্ড মন্তব্য করছেন যে গ্রীক রাষ্ট্র চিত্তা নানারকম ভাবে আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে। নগররাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সক্রিয় নাগরিকের ধারণা। সক্রিয় নাগরিক অনবরত পারস্পরিক তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে আইন প্রণয়ন করে। Polity তে নাগরিকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ গ্রীক রাজনৈতিক চিন্তার বৈশিষ্ট্য। নাগরিকরা যে আইন তৈরী করে তা সর্বজনগ্রাহ্য। সাংবিধানিক সরকার বলতে আমরা আধুনিক কালে যা বুঝি, তাঁর অনেক কিছুরই উৎস গ্রীক রাজনীতিক ঐতিহ্য। সেখানেও গণপরিষদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল নাগরিকদের পরস্পর বিরোধী মতামত প্রকাশের পরিসরের অস্তিত্ব, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ এবং আনুষ্ঠানিক ভোট গ্রহণ। প্রাচীন গ্রীক নগর-রাষ্ট্রের এই অনবদ্য ঐতিহ্যের অনুরণন, হেল্ডের মতে, পাওয়া যায় 1817 সালে প্যারি কমিউনের র্যাডিক্যাল গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে। প্রভূত সম্ভাবনা সত্ত্বেও গ্রীক নগর রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ছিল মূলতঃ পিতৃতান্ত্রিক চরিত্রের। কারণ একমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নাগরিকই ছিল এর অধিকারী। নারীদের নাগরিক অধিকার স্বীকার করা হয়নি বললেই চলে। আর ক্রীতদাসদের স্থান ছিল সবকিছুর প্রান্তে। এদের ওপরই, হেল্ডের মতানুসারে, গ্রীক নাগরিক সমাজের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চেপে বসেছিল। এতদ্সত্ত্বেও এটা স্বীকার করতেই হবে যে, নাগরিকরা শাসকের নির্বাক অনুগামী নয়; বরং তারা সক্রিয়, সচেতনভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে। এই ধারণা রাজনীতির ইতিহাসে এক অনবদ্য এবং অবশ্যই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কারণ গ্রীক নগর রাষ্ট্রের সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী রেনেশী আন্দোলনের প্রথম পর্যায় পর্যন্ত এই ঐতিহ্যের খুব বেশী পুনরাবৃত্তি ঘটে নি। তবে ষোড়শ শতকের শেষ দিকে চরমতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, অস্পষ্ট ভাবে হলেও গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে। এই প্রক্রিয়াই পরবর্তীকালে ইউরোপীয় উদারনৈতিক ও মার্কসীয় তত্ত্বের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রকাশিত হয়। হেল্ড গণতন্ত্রের এই নতুন আত্মপ্রকাশ ও বিচিত্রগামিতার বিশ্লেষণ করছেন। আধুনিক গণতান্ত্রিক তত্ত্বের তিনটি মডেলের উল্লেখ তিনি করছেন তবে ক্লাসিক্যাল গ্রীক মডেল এই তিনটি মডেলের পূর্বসূরী।
গণতন্ত্রের তিনটি বর্গ: ‘গণতন্ত্র’ সম্পর্কে সাধারণভাবে যে জনপ্রিয় ধারণা চালু আছে তা মূলতঃ একমাত্রিক ধারণা। এই ধারণা অনুসারে মনে করা হয় যে, গণতন্ত্র হল এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচন হয় এবং সার্বজনীন ভোটাধিকার থাকার দরুন নাগরিকেরা নিজেদের পছন্দমত সরকার নির্বাচন করে। মূলতঃ পশ্চিম ইউরোপীয় অভিজ্ঞতাজাত এই ধারণা থেকে এটা অনেক সময় মনে হয় যে গণতন্ত্র হল যেন একটি নিটোল, তর্কাতিত, স্বতঃসিদ্ধ ধারণা। অথচ গণতান্ত্রিক তত্ত্ব চর্চার মধ্যে যে বহুতলমাত্রিক বিমিশ্রতা বর্তমান তা তাত্ত্বিকদের মধ্যে রয়েছে। এর ধরন নিয়ে যে বিচিত্র মতভেদ উনিশ শতক থেকেই অব্যাহত তা কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব পায় না। গণতন্ত্রের যে ভিন্ন ভিন্ন মডেল তাত্ত্বিকরা হাজির করছেন বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়ে যে তাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে ডেভিড হেল্ড গণতন্ত্রের ধারণাকে তিনটি বর্গে ভাগ করছেন। প্রথম বর্গকে তিনি নাম দিয়েছেন সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্র। দ্বিতীয়টি হচ্ছে উন্নয়নমূলক গণতন্ত্র এবং তৃতীয়টি হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র। এই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বর্গই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতির কথা বলে। এটা মনে রাখতে হবে যে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের যে চর্চা ইউরোপে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে শুরু হয় এবং পরবর্তী শতকগুলিতেও অব্যাহত থাকে তার কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকলেও এর কর্মপদ্ধতি বা প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে মতপার্থক্যগুলিও কিন্তু স্পষ্ট।
আধুনিক গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা: আধুনিক গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রথম প্রবক্তাদের মধ্যে অন্যতম হবস এবং লক রাষ্ট্রকে দেখেছেন একাধারে জনগণের নিয়ন্ত্রক এবং সংরক্ষক হিসেবে। এখানে রাজনৈতিক জীবনে জনগণের অংশগ্রহণের সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করা অপেক্ষা রাষ্ট্রীয় আধিপত্য ও ক্ষমতা বিস্তারের মুখোমুখি নাগরিকেরা কিভাবে নিজেদের ব্যক্তিগত পরিসর, স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা বজায় রাখবে, তা নিয়ে বেশী আলোচনা হয়েছে। আধুনিক উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক চিন্তার সূচনা কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষণের প্রশ্নকে ঘিরেই; চরমতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে প্রতিহত করার প্রশ্নটিই তখন মুখ্য। এই কারণেই লক প্রাকাষ্ট্রীয় স্বাভাবিক অধিকার রাষ্ট্রীয় সমাজেও অব্যাহত থাকার কথা বলেছেন। আবার একই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রকে দেখছেন জনগণের অছি হিসেবে; কিন্তু রাষ্ট্রের ওপর তিনি পুরোপুরি আস্থা রাখতেও আগ্রহী নন। লকের এই অবস্থানকে উপজীব্য করেই বেন্থাম এবং মিল তাঁদের তত্ত্ব নির্মাণ করছেন। ম্যাকফারসন এঁদের অবস্থানকে সংরক্ষণমূলক গণতান্ত্রিক তত্ত্ব বলে চিহ্নিত করছেন। সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের ভিত্তি হিসাবে নির্দিষ্ট পদ্ধতিগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচন, গোপন ব্যালট, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং গোষ্ঠি সংগঠনের অধিকার। এই অবস্থান গ্রহণের পেছনে মিল ও বেহাম মানব প্রকৃতিরও এক সাধারণ তত্ত্ব গড়ে তুলেছেন। তাঁদের মতে মানবপ্রকৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার ইচ্ছাপূরণের অভীপ্সা, সর্বাধিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান এবং যথাসম্ভব দুঃখমোচনের নিরন্তর প্রচেষ্টা। তাই রাষ্ট্রেরও উচিত সর্বাধিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধানের তথা উপযোগিতার নীতি অনুযায়ী সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। বেস্থামের মতে ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধানই এই কারণে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই নিরাপত্তা বলতে তিনি বোঝাচ্ছেন ব্যক্তির জীবন এবং স্ব-উপার্জিত সম্পত্তির নিরাপত্তা। এখানে ব্যক্তি এবং তার সম্পত্তির অধিকারই মূলতঃ বিচার্য; নিজের পছন্দ মত জীবনযাপন, পেশা বাছাইয়ের অবাধ সুযোগ তার থাকে। তাই অবাধ বাণিজ্যিক পুঁজিবাদী বাজারী অর্থনীতির অনুসারী হল সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্র। ব্যক্তি নাগরিকই এখানে চূড়ান্ত এবং অর্থনৈতিক সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি গড়ে তোলার একমাত্র নির্ণায়ক।
ব্যক্তি নাগরিকের সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ধাবিত গণতান্ত্রিক মডেল থেকেই উন্নয়নমূলক গণতন্ত্রের ধারণার বিকাশ। মূল যুক্তিটা হচ্ছে একমাত্র সংরক্ষণমূলক পরিবেশেই ব্যক্তি নাগরিকের সার্বিক উন্নতি ঘটে। মিল এই গণতান্ত্রিক পরিবেশকে বলছেন একধরনের শিক্ষামূলক পরিস্থিতি। সার্বজনীন ভোটাধিকারের বিস্তারের ফলে এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সংস্থা গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে এবং স্থানীয় ব্যক্তি নাগরিকদের এতে অংশগ্রহণের ফলে তারা এই গণতান্ত্রিক পরিবেশের উপযোগী হয়ে ওঠে। এই বর্গের অনুষঙ্গেই উপস্থিত হয় অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের বর্গ।