জে. এস. মিল-এর আগের উদারনীতিবিদদের তত্ত্ব সাবেকী উদারনীতি এবং মিলের পরবর্তী আমলের উদারনীতিকে আধুনিক উদারনীতি বলা হয়। সাবেকী উদারনীতি অনুসারে রাষ্ট্র মানুষের তৈরী। কতকগুলি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বর্তমান। ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি প্রাকৃতিক অধিকারগুলি সংরক্ষণের স্বার্থে চুক্তির দ্বারা রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। সুতরাং ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক হল পুরোপুরি চুক্তিগত। সাবেকি উদারনীতিবাদী দর্শনে ব্যক্তি মানুষের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যুক্তিবাদী প্রকৃতির জন্য ব্যক্তি মানুষের গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে তুলে ধরা হয়েছে। গাউবা এ বিষয়ে বলেছেন: “…early liberalism or classical liberalism – which started taking shape in the eighteenth century-placed the individual at the centre of its philosophy. It sought to argue that the individual is endowed with the faculty of reason’ which enables him to find what is most conducive to his interests.” সাবেকি উদারনীতিবাদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রগুলি হল চুক্তি সম্পাদন, উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, দর-কষাকষি প্রভৃতি। এই মতবাদে ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে প্রগতির শর্ত হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তি হল ব্যক্তি-মানুষের শ্রম এবং আন্তরিক উদ্যোগ আয়োজনের ফসল। খোলা বাজারের প্রতিযোগিতা এবং ব্যক্তি মানুষের মুনাফা অর্জনের মানসিকতাকে সাবেকি উদারনীতিতে সামাজিক প্রগতির সহায়ক হিসাবে সমর্থন করা হয়েছে। সুতরাং সরকারের কাজ হবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, চুক্তিসমূহকে কার্যকর করা, ব্যক্তি-স্বাধীনতা বজায় রাখা এবং সম্পত্তির শান্তিপূর্ণ বিনিয়োগকে সুনিশ্চিত করা।
জন লক্: ইংল্যাণ্ডের চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লক্ (John Locke, 1632-1704)-এর চিন্তাধারায় মধ্যে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কিত সাবেকী উদারনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়াদির পরিচয় পাওয়া যায়। লকের মতানুসারে জনসাধারণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এই জনগণেরই কল্যাণ সাধনের জন্যই। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে তার কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে থাকে। শাসনতান্ত্রিক সরকার আইনের অনুশাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রাকৃতিক আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ। দেওয়ানী আইনই হল প্রাকৃতিক আইনের প্রকাশ। প্রাকৃতিক অধিকারের পিছনে প্রাকৃতিক আইনের সমর্থন বর্তমান থাকে। ব্যক্তি তার জীবনকে স্বাধীনভাবে পরিচালিত করতে পারে। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। রাষ্ট্রের দায় দায়িত্ব মূলত নেতিবাচক। তবে রাষ্ট্রকে ব্যক্তি-স্বাধীনতার বাধাগুলিকে দূর করতে হয়। লকের উদারনীতিবাদের মূল কথা হল নিয়ন্ত্রণবাদ। তাঁর অভিমত অনুযায়ী শাসক ও শাসিত উভয়েই আইনের অনুশাসনের অধীন। তিনি সরকারকে দেখেছেন রাজা, অভিজাত ও প্রজার সমন্বয়বাদী শক্তি হিসাবে। লকের মতানুসারে মানবিক গুণ ও লক্ষ্য অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সমাজের পরিবর্তনশীল চাহিদা ও গতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া। দরকার। লকের মতে স্বাধীনতা হল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা। স্বাধীনতা পরিচালিত হয় সুবুদ্ধি ও নৈতিকতার দ্বারা। অর্থাৎ স্বাধীনতা বলতে নিয়ন্ত্রণবিহীনতাকে বোঝায় না। লকের অভিমত অনুসারে স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। লক রাজনীতিক কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তার কারণ হিসাবে মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার উপর জোর দিয়েছেন।
বেন্থাম: সাবেকী উদারনীতির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হল হিতবাদ বা উপযোগিতাবাদ। আর একজন ইংরাজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বেন্থাম হলেন এর মূল রূপকার। বেন্থামের মতে সমষ্টিগত উপযোগিতাই হল। সকল অধিকারের ভিত্তি। সামাজিক লাভ-ক্ষতির হিসাব অনুসারে তিনি উপযোগিতার ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে রাষ্ট্র হল সকল রকম অধিকারের উৎস। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল ‘সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য’ ( greatest happiness of the greatest number)-এর ব্যবস্থা করা। বেন্থামের মতানুসারে মানুষ তার অধিকার, স্বাধীনতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের উপরই ভরসা করতে পারে। হিতবাদী দার্শনিক বেন্থামের মতানুসারে মানুষ স্বভাবতই সামাজিক প্রাণী। সুখ লাভ ও দুঃখ পরিহারের বাসনাই হল মানুষের কাজকর্মের প্রেরণা। আনন্দ লাভই মানুষের মুখ্য লক্ষ্য। জনমত, ধর্ম, আইন প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ নিজের সুখের সন্ধান করে জনসাধারণের সুখের মধ্যে। আইন, প্রথা প্রভৃতির দ্বারা মানুষের সুখানুসন্ধানের বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ আইন প্রণয়নের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের নিকট সম্পর্ক বর্তমান। গাউবা তাঁর An Introduction of Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন : “Bentham and his followers came to the conclusion that the main function of the state is legislation, and that the chief object of legislation is to remove all institutional restrictions on the free actions of individuals.” হিতবাদী বেন্থামের মতানুসারে মানুষই জনসম্প্রদায়ের সুখ প্রাপ্তিকে সুনিশ্চিত করার স্বার্থে রাষ্ট্রযন্ত্র সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রের পরিধিকে প্রসারিত করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁর মতানুসারে মানুষ সুখ লাভ ও দুঃখ পরিহারের জন্য কাজকর্মে আত্মনিয়োগ করে এবং ব্যক্তিমাত্রেই নিজের স্বার্থকে সব থেকে ভাল বোঝে।
বেন্থাম সর্বসাধারণের অবাধ ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি থেকে বিচার ব্যবস্থার স্বতন্ত্রীকরণ, গোপন ব্যালটের ভিত্তিতে নির্বাচন প্রভৃতিকে স্বীকার ও সমর্থন করেছেন। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব জনসাধারণের কল্যাণ সাধনের স্বার্থে। রাষ্ট্রের কাছে আনুগত্য প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা অধিক। এই কারণে মানুষ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার না করে স্বীকার করে। হিতবাদী বেন্থামের মতানুসারে বহু সংখ্যক মানুষের হিতসাধনই হল রাষ্ট্রের আদর্শ। রাষ্ট্রের গুরুত্ব বা মূল্য বিচার করতে হবে বহুসংখ্যক মানুষের হিতসাধনের মাপকাঠিতে। বেন্থাম বর্তমানের প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা ও আইনের মূল্য পরিমাপের পক্ষপাতী ছিলেন। গাউবা এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “Bentham argued that the business government is to promote the happiness of society by a system of punishments and rewards. It had no other justification for existence. A good government is the one that promotes the happiness of its subjects. A government which employs ineffectual means in this sphere, loses its title to authority.”
অ্যাডাম স্মিথ: অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ অর্থনীতিবিদগণ নির্দিষ্ট কতকগুলি কার্যাবলীর মধ্যে রাষ্ট্রের ক্রিয়াকলাপের এলাকাকে সীমাবদ্ধ করার পক্ষপাতী। স্মিথ আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ‘অবাধ নীতি’ (Laissez faire)-এর প্রধান প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। অ্যাডাম স্মিথ আর্থনীতিক উদারনীতিবাদের প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। ওয়াটকিনস-এর অভিমত অনুসারে অ্যাডাম স্মিথের বিখ্যাত গ্রন্থ The Wealth of Nation হল আর্থনীতিক উদারনীতিবাদের প্রথম বৃহৎ ইস্তাহার। স্মিথ নিয়ন্ত্রণ, মুক্তি, অবাধ প্রতিযোগিতা ও অবাধ বাণিজ্যকে স্বীকার ও সমর্থন করেছেন। তাঁর মতানুসারে ব্যক্তি মানুষের মুনাফা অর্জনের উদ্যোগ-আয়োজনের মধ্যেই সমাজের আর্থিক প্রগতির সূত্র বর্তমান। সমাজের কল্যাণ ব্যক্তির কল্যাণের মধ্যে নিহিত আছে। আগে আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারের একাধিপত্য কায়েম ছিল। সরকারের এই একাধিপত্যের বিরোধিতা করেছেন স্মিথ। তিনি অবাধ নীতির সম্প্রসারণের কথা বলেছেন এবং শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহিত করার কথা বলেছেন। সর্বসাধারণের আর্থিক কল্যাণ সাধনই হল সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। স্মিথের মতানুসারে আর্থনীতিক অগ্রগতির মূল নিহিত আছে উৎপাদন, বিক্রয়, মুনাফা অর্জন এবং উপভোগের স্বাধীনতার মধ্যে। গাউবা এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “In accordance with this concept of man, Adam Smith postulated a system of ‘natural liberty’-implying perfect freedom of commerce and industry in order to promote national prosperity.” এই স্বাভাবিক স্বাধীনতা’র ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কর্তব্যকর্ম তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই তিনটি বিষয় হল:
-
(১) বৈদেশিক আক্রমণের হাত থেকে দেশের নিরাপত্তা বিধান;
-
(২) সমাজের সকলের সুরক্ষা ও ন্যায়-বিচার সুনিশ্চিত করা; এবং
-
(৩) ব্যক্তিগত উদ্যোগের বাইরে অবস্থিত জনস্বার্থমূলক কাজকর্ম সম্পাদন ও জনস্বার্থমূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা।