ভূমিকা (Intruction): আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাস্তববাদী বক্তব্যকেই প্রধান্যকারী মতবাদ হিসাবেই স্বীকার করা হয়। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। তবে এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বিচারে বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে উদারনীতিবাদের দাবিকেও অস্বীকার করা যায় না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে মাঝে মাঝে উদারনীতিবাদী বক্তব্য গুরুত্ব লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় অনেক সময় উদারনীতিক মতাদর্শ ও মূল্যবোধ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কর্মসূচী প্রণয়নের উপর জোর দেওয়া হয়। বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে পশ্চিমী বেশকিছু দেশের জনমতকে এবং নীতি নির্ধারণকারী এলিটদের উদারনীতিক চিন্তাভাবনা বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। কেতাবি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যালোচনায় এই অধ্যায়টিকে আদর্শবাদী অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অল্প কিছুকাল আবার উদারনীতিক ভাবপ্রবণতার অভ্যুত্থান পরিলক্ষিত হয়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এর অভিব্যক্তি ঘটে। তবে অনতিবিলম্বে ঠাণ্ডাযুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উদারনীতিক ঐতিহ্য আবার দুর্বল হয়ে পড়ে। ক্ষমতার রাজনীতি ও ঠাণ্ডাযুদ্ধের অবসানের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উদারনীতির আশার আলো আবার উজ্জ্বল হতে শুরু করে। পশ্চিমের রাষ্ট্রনেতারা নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার কথা বলতে শুরু করেন। উদারনীতিক তাত্ত্বিক এবং বুদ্ধিজীবীরাও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে বিবিধ যুক্তির অবতারণা করেন; তাঁরা এক্ষেত্রে অন্যান্য মতবাদের তুলনায় উদারনীতিবাদের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় আধুনিককালের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক স্ট্যানলে হফম্যান (Stanley Hoffmann) এক সময় মন্তব্য করেছেন “…..international affairs have been the nemesis of liberalism.”
ঐতিহাসিক দিক থেকে বিচার-বিবেচনা করলে উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সংযোগ সম্পর্ক কখনোই সন্তোষজনক নয়। এতদসত্ত্বেও উদারনীতিক চিন্তাবিদ্রা ক্ষমতার রাজনীতির যুক্তিসমূহের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী ক্ষমতার রাজনীতিও এক ধরনের ধারণার ফল। পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে ধারণার পরিবর্তন ঘটে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অদ্যাবধি উদারনীতিবাদ তেমন একটা জায়গা করে নিতে পারেনি। এ কথা ঠিক। এতদসত্ত্বেও এ কথা বলা যাবে না। যে, আগামী দিনের আন্তর্জাতিক রাজনীতি উদারনীতিক পথে পরিচালিত হবে না। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ্ টিম দুন্নে (Tim Dunne) তাঁর Liberalism শীর্ষক এক রচনায় মন্তব্য করেছেন “..Liberalism is described in the literature as the tradition of optimism.” তিনি আরও বলেছেন: “The practice of international relations has not been accommodating to Liberalism. Whereas the domestic political realm in many states has witnessed an impressive degree of progress, with institutions providing for order and justice, the international realm in the era of the moderm states system has been characterized by a precarious order and the absence of justice.”
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উদারনীতিক ঐতিহ্য আধুনিক উদারনীতি রাষ্ট্রের অভ্যুত্থানের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। আধুনিক নাগরিক সমাজ (civil society) ও পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উদারনীতিক দার্শনিকরা মানুষের প্রগতির বৃহত্তর সম্ভাবনার সন্ধান করেছেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে জন লক (John Locke)-এর সময় থেকে এই অনুশীলনের সূত্রপাত ঘটেছে। আধুনিক কালের উদারনীতিক রাষ্ট্রে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করা হয়। এই কারণে নাগরিক সমাজ ও পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিকশিত হওয়ার সুযোগ-সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। আধুনিকতা নতুন ধরনের উন্নততর জীবনকে প্রতিপন্ন করে। এ ধরনের জীবনধারা উন্নতর পর্যায়ের বৈষয়িক বা বস্তুগত কল্যাণযুক্ত এবং কর্তৃত্ববাদী সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত।
উদারনীতিক তাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন যে, মানুষের ভয় ও ক্ষমতার লালসার উপর মানুষের যুক্তিবোধ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। উদারনীতিবাদীদের আরও বক্তব্য হল যে, সংঘাত-সংঘর্ষ ও যুদ্ধ অনিবার্য নয়। মানুষ তার যুক্তিবোধ প্রয়োগের মাধ্যমে পারস্পরিক সুবিধাজনক সহযোগিতায় উপনীত হতে পারে। এই সহযোগিতা শুধুমাত্র রাষ্ট্রের সীমানার অভ্যন্তরে নয়, রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সম্ভব। উদারনীতিবাদীরা সাধারণত মানুষের প্রকৃতি প্রসঙ্গে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। মানুষের যুক্তিবোধের উপর তাঁদের অগাধ আস্থা। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে মানুষের যৌক্তিক নীতিসমূহ প্রয়োগ করা যাবে। উদারনীতিক চিন্তাবিদরা স্বীকার করেন যে, ব্যক্তিবর্গের মধ্যে স্বার্থপরতা আছে, আছে প্রতিযোগিতাও। কিন্তু মানুষের স্বার্থপরতা ও প্রতিযোগিতার মনোভাবের সীমা আছে। এটাই মানব প্রকৃতির পুরো পরিচয় নয়। ব্যক্তিবর্গ অনেক সাধারণ স্বার্থের অংশীদার হয়। এইভাবে মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সামাজিক ক্রিয়াকর্মের সামিল হতে পারে। এই সহযোগিতা স্বরাষ্ট্রের মত পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়েও সম্ভব। কিন্তু এক্ষেত্রে সাফল্যের পথে প্রতিবন্ধকতাসমূহের ব্যাপারে উদারনীতিক দার্শনিকদের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। উদারনীতিবাদীদের মধ্যে একদলের মতে এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন সহজে সম্ভব। আর একদলের মতে এ বিষয়ে সাফল্য লাভের পথে বিবিধ প্রতিবন্ধকতা বর্তমান। স্বভাবতই এই প্রক্রিয়া দীর্ঘকালীন হতে বাধ্য। তবে সকল উদারনীতিবাদী স্বীকার করেন যে চূড়ান্ত বিচারে পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে সহযোগিতাই সফল হবে। কারণ আধুনিকীকরণ সহযোগিতার সুযোগ ও পরিসর প্রসারিত করে।
উদারনীতিবাদীরা প্রগতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু এই প্রগতি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে উদারনীতিবাদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বর্তমান। আগেকার দিনের অধিকাংশ উদারনীতিক চিন্তাবিদ অতিমাত্রায় আশাবাদী ছিলেন। এ প্রসঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে কাল্পনিক উদারনীতিবাদ (utopian liberalism)-এর অভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করা আবশ্যক। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে কাল্পনিক উদারনীতিবাদ বহুলাংশে নীরব হয়ে পড়ে। তবে ঠাণ্ডা যুদ্ধ (cold war)-এর অবসানের পর উদরনীতিক আস্থা ও বিশ্বাস আবার উজ্জীবিত হয়। মার্কসবাদের পরাজয় এবং সর্বত্র উদারনীতিক গণতন্ত্রে বিজয়াভিযান এ ক্ষেত্রে উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ২০০১ সালে ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ উদারনীতিবাদী চিন্তাভাবনার উপর বিরাট আঘাত হেনেছে।
উদারনীতিবাদ হল একটি মতাদর্শ। এই মতাদর্শের মূল কথা হল ব্যক্তিবর্গের স্বাধীনতা। উদারনীতিবিদদের কাছে স্বাধীনতা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ন্যায় ও নিরাপত্তার সংরক্ষণ সুনিশ্চিত হতে পারে না; এরজন্য বাহ্যিক পরিস্থিতিরও পরিমার্জন প্রয়োজন হতে পারে। প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষজন যেভাবে জীবন যাপন করত, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহ পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে অনুরূপভাবে অবস্থান করলে নিরাপত্তা, শান্তি ও প্রগতির প্রসঙ্গে উদারনীতিক পরিকল্পনা চিরকালই অধরা থেকে যাবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিজ্ঞানী টিম দুরে (Tim Dunne) তাঁর Liberalism শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করেছেন: “Liberalism is fundamen tally anchored around the liberty of the individual. Domestic and international institutions are to be judged according to whether they further this aim.”
আন্তর্জাতিক রাজনীতির ব্যবহারিক ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে পরবর্তী কালে যুদ্ধোত্তর কালে। যুদ্ধোত্তর কালেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় উদারনীতিক চিন্তাভাবনার বিশেষ বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। এই সময় আদর্শবাদীদের অনুশীলনেই উদারনীতি বাদের চর্চা সমৃদ্ধি লাভ করে। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদের মীমাংসার ব্যাপারে যুদ্ধ হল অপ্রয়োজনীয় ও অচল একটি উপায়। দার্শনিকরা ন্যায় ও শান্তি চর্চায় বিবিধ উপায়-পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছেন। এই আলোচনার মধ্যেই আবছাভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উদারনীতিক ভাবনাচিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের মতানুসারে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংঘাত-সংঘর্ষ কোন স্বাভাবিক বিষয় নয়। এই অবস্থানটিকে টিম দুন্নে বলেছেন: “….. one which could only be tamed by the careful management of power through balance of power policies and the construction of alliances against the state which threatened international order.”
আধুনিক সাংবিধানিক রাষ্ট্রের অভ্যুত্থানের সঙ্গে উদারনীতিক চিন্তাভাবনা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী আধুনিকীকরণ হল একটি প্রক্রিয়া। জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রগতি এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। আধুনিককীকরণের প্রক্রিয়া সহযোগিতার পরিধিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রসারিত করে। মানুষ যুক্তিবাদী। আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে মানুষ তার যুক্তিবাদিতাকে প্রয়োগ করলে পরিণামে বৃহত্তর সহযোগিতা সুনিশ্চিত হবে। প্রগতি বলতে উন্নততর জীবন, অন্তত অধিকাংশের জন্য উন্নতর জীবনকে বোঝায়। আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়ার ধারায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। উন্নততর উপায়-পদ্ধতির কল্যাণে দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন পৃদ্ধি পায় এবং প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়। এই প্রক্রিয়া অধিকতর শক্তিশালী হয় উদারনীতক বৌদ্ধিক বিপ্লবের মাধ্যমে। মানুষের যুক্তিবোধের ও ন্যায়পরায়ণতার উপর উদারনীতিক বৌদ্ধিক বিপ্লবের আস্থা ছিল অপরিসীম। এর ভিত্তিতেই উদারনীতিবাদীরা প্রগতির ব্যাপারে বিশ্বাসী। আধুনিক উদারনীতিক রাষ্ট্র বিশেষ ধরনের রাজনীতিক ও অর্থনীতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষপাতী। এই আর্থ-রাজনীতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক মঙ্গল সাধন সম্ভব হবে (“Greatest happiness of the greatest number. “Jeremy Bentham)।