পরস্পর-বিরোধী: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সম্পত্তির অধিকার একটি প্রাচীন বিষয়। সমাজ ও সমাজবাসীদের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের তাৎপর্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে। তবে এ বিষয়ে চিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ব্যক্তিগতভাবে সম্পত্তি অর্জন ও ভোগদখলের ব্যাপারে অনিয়ন্ত্রিত অধিকার অভিপ্রেত কিনা এ বিষয়ে পরস্পর-বিরোধী দুটি মত আছে। গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক উপাদান হিসাবে অভিহিত করেছেন। তাঁর আরও অভিমত হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি সমাজবন্ধনের মূল ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার এক ‘পবিত্র অধিকার’ হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশেষতঃ সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বা উদারনীতিক মতবাদের প্রবক্তারা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে পবিত্র অধিকার হিসাবে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু মার্কসীয় দর্শনে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করা হয়। মার্কসবাদ অনুসারে সমাজে শ্রেণী-বৈষম্য, শ্রেণী-দ্বন্দ্ব ও শ্রেণী-শোষণের মূল কারণ হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার। এই কারণে মার্কসবাদের উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ সাধন। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার প্রসঙ্গে উপরিউক্ত পরস্পর-বিরোধী বক্তব্যের পিছনে যে সকল যুক্তির অবতারণা করা হয় তার পর্যালোচনা প্রয়োজন।
ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের পক্ষে যুক্তি
(১) স্বাভাবিক অধিকার: সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে উদারনীতিক মতবাদের প্রবক্তারা ‘পবিত্র অধিকার’ হিসাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পিছনে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। এই শ্রেণীর দার্শনিকদের মতানুসারে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সহজাত ও স্বাভাবিক। তানেকের মতে ইংরেজ চিন্তাবিদ লক্-ই এই অধিকারের দার্শনিক ভিত্তি রচনা করেছেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে এই চুক্তিবাদী দার্শনিকের মতানুসারে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার হল মানুষের স্বাভাবিক অধিকার। কারণ সম্পত্তি হল মানুষের ব্যক্তিগত দক্ষতা ও পরিশ্রমের ফল। লকের মতে মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিত্যাগ করে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে মূলত সম্পত্তি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার মৌলিক অধিকার। এই অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের ক্ষমতা কারও নেই। পরবর্তীকালে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দার্শনিকগণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে স্বাভাবিক ও অপরিত্যজ্য অধিকার হিসাবে স্বীকার করেছেন এবং এই অধিকার সংরক্ষণ রাষ্ট্রের পবিত্র কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছেন। এ প্রসঙ্গে অ্যাডাম স্মিথ, বেহাম, মিল, গ্রীণ প্রমুখ দার্শনিকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(২) ঐতিহাসিক যুক্তি: অনেকের মতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার ঐতিহাসিক বিবেচনায়ও সমর্থনযোগ্য। ঐতিহাসিক নজিরের ভিত্তিতে বলা হয় যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তিতেই উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজের সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটেছে। অনেক লেখক দাবি করেন যে সম্পত্তির অধিকার মানবসভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। কার্যতঃ বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানবসমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত।
(৩) মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি: মনস্তাত্ত্বিক যুক্তির ভিত্তিতে বলা হয় যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার মানুষকে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে গঠনমূলক কাজে নিযুক্ত রাখে। এই অধিকার মানুষকে উদ্যোগী করে এবং কাজকর্মে প্রেরণা যোগায়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার মানুষের মনে এক ধরনের নিরাপত্তাবোধের সৃষ্টি করে। এই অধিকার ব্যক্তিজীবনে আনন্দের অনুভূতি ও এক গভীর তৃপ্তিবোধের সৃষ্টি করে। সুতরাং মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সমর্থিত হয়।
(৪) নৈতিক যুক্তি: নৈতিক দিক থেকে বলা হয় যে, সম্পত্তি হল ব্যক্তিগত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফল। সম্পত্তির সৃষ্টি হয় ব্যক্তির শ্রমের ফলে। তাই সম্পত্তির উপর ব্যক্তির অধিকার নৈতিক বিচারে সমর্থনযোগ্য। সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত অধিকারকে অস্বীকার করার অর্থ হল ব্যক্তির গুণগত যোগ্যতা ও দক্ষতাকে অস্বীকার করা এবং শ্রমের মর্যাদাকে অবহেলা করা।
(৫) সামাজিক যুক্তি: ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের পিছনে সামাজিক যুক্তিও দেখান হয়। বলা হয় যে, এই অধিকারের ভিত্তিতে সমাজে সৃজনশীল কর্মে মানুষ আত্মনিয়োগ করে, উৎসাহ-উদ্যোগ বৃদ্ধি পায়, পরিবারের প্রতি মমত্ববোধ ও উদারতার বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন সামাজিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীকে বিকশিত করে।
ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের বিপক্ষে যুক্তি
(ক) স্বাভাবিক অধিকারের যুক্তি ঠিক নয়: ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের পিছনে স্বাভাবিক অধিকারের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যক্তি-মানুষ সমাজের মধ্যে সমাজের সদস্য হিসাবে অধিকার ভোগ করে। অধিকার একটি সামাজিক ধারণা এবং সমাজব্যবস্থার আপেক্ষিক। মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় বিশেষ একটি পর্যায়ে মানুষের অধিকারের সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারেরও উদ্ভব হয়েছে এইভাবে। সুতরাং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বাভাবিক, সহজাত ও চিরন্তন নয়।
(খ) অযৌক্তিক: সমাজের মধ্যে ব্যক্তির যে-কোন অধিকার সামাজিক দায়-দায়িত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারও ব্যক্তির সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের উপর নির্ভরশীল হওয়া আবশ্যক। এই কারণে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার পবিত্র, নিরঙ্কুশ ও অবাধ অধিকার হতে পারে না।
(গ) অনৈতিক: ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের ভিত্তিতে সমাজে পরশ্রমভোগী এক শোষক শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। অন্যান্য ব্যক্তির পরিশ্রমের ফল ভোগের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন ও ভোগদখলের পিছনে কোন নৈতিক সমর্থন নেই। প্রকৃত ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিকারের মাধ্যমে মুনাফা লাভের প্রচেষ্টাকেই স্বীকার করা হয়।
(ঘ) সমাজকল্যাণের পরিপন্থী: ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার অনেক সময় সামাজিক স্বার্থের বিরোধী। ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তির ভাণ্ডারকে ক্রমশ স্ফীত করার উদগ্র তাড়নায় মানুষ বিভিন্ন আপত্তিকর কাজকর্মে লিপ্ত হয়। সামাজিক স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণের পরিপন্থী এই সমস্ত উদ্যোগ সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা ও দুষ্ক্রিয়তার সৃষ্টি করে।
(ঙ) মনস্তাত্ত্বিক যুক্তিও ভ্রান্ত: ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার মানুষের মনে উৎসাহ-উদ্যোগ ও কর্মপ্রেরণার সৃষ্টি করে—এই যুক্তিও সব সময় ঠিক নয়। এর বিপরীত ঘটনাও ঘটে। সমাজে সম্পদশালী ব্যক্তির উত্তরাধিকারীর মধ্যে আলস্যে দিন যাপনের প্রবণতা দেখা দিতে পারে। মানবসমাজে এ রকম নজিরের অভাব নেই।
(চ) মার্কসবাদীদের যুক্তি: ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার প্রসঙ্গে মার্কসবাদীদের বক্তব্য স্বতন্ত্র ও সুস্পষ্ট। মার্কসবাদ অনুসারে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সমাজে শ্রেণী-বৈষম্য, শ্রেণী-দ্বন্দ্ব ও শ্রেণী-শোষণের সৃষ্টি করে ও সংরক্ষণ করে। আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। প্রথম ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি হয়েছে দাস-সমাজব্যবস্থায়। এই সময় দাস-মালিকদের শোষণমূলক শ্রেণী-সম্পর্ক সংরক্ষণের স্বার্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। তারপর সামন্ত সমাজে ও পুঁজিবাদী সমাজে শোষণমূলক সামাজিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখার তাগিদে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয় অধিকার হিসাবে স্বীকৃত হয়। এই সমস্ত কারণে মার্কসবাদীরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির সম্পূর্ণ বিলোপ সাধনের কথা বলেন। তা ছাড়া, অধিকার কোন শাশ্বত, স্বাভাবিক, সহজাত ও চিরন্তন বিষয় নয়। সমাজ বা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ছাড়া অধিকার সার্থক হয় না। এই কারণে প্রাক-রাজনীতিক বা প্রাক্-সামাজিক পরিবেশে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের উদ্ভব অসম্ভব।