বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা: ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক অতি বিতর্কিত আলোচনার বিষয়। ব্যক্তিগতভাবে সম্পত্তি অর্জন, ভোগদখল এবং দান-বিক্রয়ের অব্যাহত সুযোগকেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বলে। এই অধিকারকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বের আলোচনায় বিতর্কের ঝড় উঠেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয় যে, ব্যক্তির আত্মোপলব্ধির স্বার্থে এই অধিকার আবশ্যক। এই অধিকার মানুষের সহজাত। এই অধিকার ব্যতিরেকে ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ অসম্ভব। সেইজন্য রাষ্ট্রের উচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অধিকার হিসাবে একে স্বীকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
লিয়নটিয়েভ মন্তব্য করেছেন: “Bourgeois scientists… try to represent things as if the existence of society and even of man himself is not conceivable without private .” কিন্তু সমাজতন্ত্রবাদিগণ সম্পত্তির অধিকারের বিরোধী। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ অনুসারে ব্যক্তিগত property.” সম্পত্তির অধিকারের স্বীকৃতি সমাজে ধনবৈষম্যের সৃষ্টি করে। এই ধনবৈষম্যমূলক সমাজে শ্রেণী-শোষণ, অত্যাচার ও বঞ্চনার অমানবিক ঘটনা সংঘটিত হয়। মুষ্টিমেয় বিত্তবান সংখ্যাগরিষ্ঠ বিত্তহীনের উপর অব্যাহতভাবে শোষণ-পীড়ন কায়েম করার সুযোগ পায়। সেইজন্য মার্কসবাদিগণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বিলোপ সাধনের পক্ষপাতী।
ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধের সৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে মার্কসাবাদী দর্শন অনুসারে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারা বিশ্লেষণ করা দরকার। মার্কস ও তার অনুগামী সমভোগবাদিগণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ও তার ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আদিম সাম্যবাদী সমাজ, শ্রেণীবৈষম্যমূলক সমাজ ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ সম্পর্কে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করেন।
আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধ ছিল না: আদিম সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধের সৃষ্টি হয়নি। আদিম সমাজে মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বাস করত। জীবনের নিরাপত্তা ও খাদ্য সংগ্রহের তাগিদে যৌথ জীবন ছিল অপরিহার্য। এই সময় শ্রমশক্তিই ছিল উৎপাদনের মূল উপাদান। তা ছাড়া পাথর বা কাঠের তৈরী অতি সাধারণ কিছু হাতিয়ার ছিল। উৎপাদনের সকল উপাদানের উপর গোষ্ঠীর যৌথ মালিকানা ছিল। উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সকলে সমানভাবে ভোগ করত। এই সময় অপরের পরিশ্রমের ফল ভোগ করে জীবনধারণের কোন সুযোগ ছিল না। উৎপাদন ব্যবস্থা অনুন্নত ছিল বলে শুধু জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদিত হত। সেইজন্য উদ্বৃত্ত উৎপাদন বা সঞ্চয় ছিল না। তাই সমাজ বিবর্তনের এই পর্বে কোন প্রকার ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব ছিল না। স্বাভাবিক কারণে আর্থনীতিক অসাম্য, শ্রেণী শোষণ ছিল না। বস্তুত আদিম সমাজব্যবস্থায় কোন প্রকার অসাম্য ছিল না। সেইজন্য একে আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা বলা হয়।
দাস-ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব: মানবসমাজের প্রগতির ধারায় দাস-ব্যবস্থাতেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধের উদ্ভব হয়। দাস-সমাজই হল প্রথম শ্রেণী-বৈষম্যমূলক সমাজ। দাস-সমাজ দাস-মালিক ও দাস বা শোষক ও শোষিত এই দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। দাস-সমাজেই শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণীশোষণের সূত্রপাত ঘটে। দাস-সমাজব্যবস্থায় উৎপাদন ক্ষেত্রের প্রসার, উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি, উদ্বৃত্ত উৎপাদন, সঞ্চয়, বিনিময় প্রথার সৃষ্টি প্রভৃতির ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব এবং আর্থনীতিক অসাম্য দেখা দেয়। প্রকৃতপক্ষে মানব ইতিহাসে দাস-মালিকরাই হল প্রথম সম্পত্তিবান শ্রেণী। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে-কোন উপায়ে ব্যক্তিগত সম্পদ-সামগ্রী বৃদ্ধি করার এক অশুভ প্রবণতাও দেখা দেয়।
সামন্তসমাজে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা: সমাজ বিবর্তনের পরবর্তী অধ্যায় সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ভূস্বামী ও ভূমিদাস এই দুই পরস্পর বিরোধী শ্রেণীতে বিভক্ত। এই পর্যায়ে জমির উপর সামন্ত প্রভুদের ব্যক্তিগত মালিকানার রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তা ছাড়া এই সময় বিনিময় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মুদ্রা আবিষ্কৃত হয় এবং ভূসম্পত্তির ক্রয়-বিক্রয় ও বন্ধক দেওয়া শুরু হয়। এর ফলে মুষ্টিমেয় সামন্তপ্রভুরা ক্রমশ অধিকতর সম্পদশালী হতে লাগল এবং পাশাপাশি সম্পদহীনের দল দিনে দিনে ভারী হতে লাগল। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অর্থনীতির মূল বনিয়াদ ছিল ভূমি। এই ভূমির উপর সামন্তপ্রভুদের ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম হয়। এঙ্গেলসের মতানুসারে পরিবারসমূহের প্রধানদের ধনসম্পত্তির ক্ষেত্রে অসাম্য দেখা দেওয়ায় আদিম যৌথ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল এবং গোষ্ঠীর ভূমির চাষ বন্ধ হল। আবাদি জমিসমূহ প্রথমে সাময়িকভাবে এবং পরে স্থায়ীভাবে বিভিন্ন পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট হল। জোড় বাঁধা পরিবার থেকে একপতি-পত্নীত্ব পরিবারে উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হল।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার: সমাজ বিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক সমাজে বস্তুত একই ঘটনা আরও দ্রুতলয়ে সংঘটিত হল। শিল্প বিপ্লবের পর ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানগুলির মালিকানা পুঁজিপতিদের হাতে থাকে। জমি, কলকারখানা, মূলধন প্রভৃতির একমাত্র অধিকারী হল এই পুঁজিপতিরা। আপাতদৃষ্টিতে সর্বহারা শ্রমিক সম্প্রদায়কে মুক্ত ও স্বাধীন বলে মনে হয়। কিন্তু কার্যতঃ তারা মালিক শ্রেণীর আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণের অধীন। শ্রমিকশ্রেণী উৎপাদনের সর্বপ্রকার উপকরণ থেকে বঞ্চিত। তারা সহায়-সম্বলহীন। নিজেদের শ্রমশক্তি টুকুই তাদের একমাত্র পুঁজি। শ্রমিকদের এই অসহায় অবস্থার সুযোগে মালিকগণ নামমাত্র পারিশ্রমিক দিয়ে তাদের শোষণ করে। পুঁজিপতিদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে সুরক্ষিত করার জন্য রাজনীতিক কর্তৃত্বকে প্রয়োগ করা হয় এবং তত্ত্বগতভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে একটি পবিত্র অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিবর্তে সামাজিক সম্পত্তির সৃষ্টি: সমাজ বিবর্তনের পরবর্তী পর্বে অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সমষ্টির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে উৎপাদন-উপাদানগুলির উপর সামাজিক মালিকানা কার্যকরী হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ করে সমাজের সম্পদ-সামগ্রীর ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের মাধ্যমে সমষ্টির সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনই সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য। সমষ্টির স্বার্থেই উৎপাদনব্যবস্থা ও শিল্পবাণিজ্য রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়। এখানে কোন পরশ্রমভোগী শোষক শ্রেণী থাকে না। তাই ব্যক্তিগত মুনাফার প্রশ্ন এখানে নেই। সামাজিক মুনাফা বৃদ্ধিই সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। সমাজতান্ত্রিক কাঠামোয় উৎপাদিত ভোগ্য সামগ্রীগুলি ব্যক্তি ভোগ করতে পারে, কিন্তু সমাজের আর্থনীতিক সম্পদের উপর ব্যক্তির কোন অধিকার থাকে না। ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিবর্তে সামাজিক সম্পত্তি এবং ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সামাজিক সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি হল একটি বিশেষ নীতি। নীতিটি হল: যে কাজ করবে না, সে খেতেও পাবে না’ (“He who shall not work, neither shall he eat.”)। মার্কসীয় দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শ্রেণীবিভক্ত সমাজেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয়; শ্রেণী-বৈষম্যের অবসান ঘটলে পরশ্রমজনিত ব্যক্তিগত সম্পত্তিও অবলুপ্ত হবে।