এথেন্সের উদ্ভব: স্বাধীনতার ধারণা সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয় প্রাচীনকালে গ্রীস দেশের এথেন্স নগরীতে। এই ধারণা এথেনীয় স্বাধীনতা হিসাবে পরিচিত। এথেনীয় স্বাধীনতার দুটি দিক আছে— সম্প্রদায়গত স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। সম্প্রদায়গত স্বাধীনতা বলতে সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণবিহীনতাকে বোঝাত (“Athenians call no man their master.”-Aeschylus)। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে স্ব-শাসন ও দৈনন্দিন অভাব-অভিযোগ থেকে মুক্তিকে বোঝাত। প্রাচীন এথেস নাগরিকদের স্ব-শাসনের ধারণা থেকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সৃষ্টি হয় এবং দৈনন্দিন অভাব অভিযোগ থেকে মুক্তি’ এই ধারণার ভিত্তিতে ক্রীতদাস ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক মনে করা হত। কারণ ক্রীতদাসদের কায়িক কার্যের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকগণ নিরবচ্ছিন্ন অবকাশ ও মুক্ত জীবন-যাপন করতে পারত। বস্তুত এথেনীয় ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে স্বীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যক্তির বাহ্যিক আচার-আচরণের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণবিহীনতাকে বোঝায়। পেরিক্লিস (Pericles)-এর মতানুসারে স্বাধীন বিকাশ ও রাজনীতিক দায়িত্ব পালনের মধ্যে নাগরিকদের পূর্ণতা। তিনি বলেছেন: “Freedom means advancement and political activity for full citizens.” অনেকের মতে আইনের প্রতি আনুগত্য এথেনীয় স্বাধীনতার অন্যতম অঙ্গ।
এরপর এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব প্রচারিত হওয়ার আগে পর্যন্ত স্বাধীনতা সম্পর্কিত আলোচনা কম হয়নি। স্টোয়িক ও রোমান দার্শনিক থেকে শুরু করে ম্যুর, হ্যারিংটন প্রমুখ দার্শনিকদের লেখায় স্বাধীনতা সম্পর্কে অল্পবিস্তর আলোচনা পরিলক্ষিত হয়।
স্টোয়িকদের ধারণা: জেনো (Zeno) কর্তৃক খ্রীস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে প্রচারিত দার্শনিক মতবাদ স্টোয়িকবাদ (Stoicism) হিসাবে পরিচিত। স্টোয়িকদের মতানুসারে ব্যক্তি মানুষের জীবনের পূর্ণতা মানবীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত পরিবেশের মধ্যেই হতে পারে। স্টোয়িক দার্শনিকগণ রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে পর্যালোচনা করার পক্ষপাতী। রোমক রাজনীতিক চিন্তার মধ্যে স্টোয়িকদের স্বাভাবিক আইন ও ন্যায় সম্পর্কিত ধারণার প্রভাব দেখা যায়। তবে রোমক চিন্তায় স্বাধীনতার থেকে আইন, সার্বভৌমিকতা, শৃঙ্খলা প্রভৃতি বিষয় অধিক গুরুত্ব পেয়েছে।
মধ্যযুগ: মধ্যযুগে প্রচলিত ধারণা হল এই যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণের মাধ্যমেই মানব-আত্মার মুক্তি। ভগবানের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নয়নের স্বার্থে মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতাকে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। বস্তুত ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণা মধ্যযুগে তেমন গুরুত্ব পায়নি। তবে এই যুগের সমাপ্তি পূর্বে ধর্মসংস্কার আন্দোলন ও নবজাগরণের মাধ্যমে বিবেকের স্বাধীনতার বিষয়টি গুরুত্ব অর্জন করে।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী: সপ্তদশ শতাব্দীতে মরে তাঁর সাম্যবাদের আদর্শ প্রচার করেন। হ্যারিংটন গণসার্বভৌমত্বের আলোচনা প্রসঙ্গে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। কবি মিলটনের মতানুসারে স্বাধীনতা হল ব্যক্তি ও জাতির জন্মগত অধিকার। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের রচনায় স্বাধীনতা সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট আলোচনা দেখা যায়। ইংরেজ দার্শনিক হবসের মতানুসারে আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ নয় এমন সকল ক্ষেত্রেই মানুষ স্বাধীন। তিনি বলেছেন: “Men are free in all those matters upon which the law is silent.” তবে প্রাকৃতিক অবস্থায় হর্ৎসের স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারের নামান্তর। লকের মতে প্রাকৃতিক অবস্থায় ন্যায়, বিবেক ও যুক্তির অনুশাসন ছিল। এ ছিল স্বাভাবিক আইন। স্বাভাবিক আইনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল সাম্য। ফলে সকলে ছিল স্বাধীন ও সমানাধিকারসম্পন্ন। রুশোর মতে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষ ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন ও মুক্ত। রুশো ‘সাধারণ ইচ্ছা’ (General will) তত্ত্ব প্রচার করে জনগণের সার্বভৌমিকতার কথা বলেছেন এবং রাষ্ট্রনৈতিক স্বাধীনতার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতানুসারে সাধারণ আইনের প্রতি আনুগত্যই হল স্বাধীনতা। তিনি বলেছেন: “Obedience to a law which we prescribe to ourselves is liberty.” ফরাসী বিপ্লব ও আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যক্তি-স্বাধীনতার আদর্শ অত্যন্ত গুরুত্ব অর্জন করে। তবে বিপ্লবের সমর্থকগণ স্বাধীনতার নেতিবাচক দিকটির উপরই গুরুত্ব বেশী দিয়েছেন। ফরাসী বিপ্লব ও আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম সাম্য ও স্বাধীনতার লক্ষ্যকে আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছে। তার ফলে স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়। এই সময় সুইস্ আইনবিদ্ দ্য লোমি (Jean De Lome) বলেছেন যে স্বাধীনতার উপলব্ধি আইনগত সাম্যের পরিবেশেই সম্ভব। তার কথায়: “Liberty means to live in a state where laws are equal for all and sure to be executed.”
মিল ও বার্কার: পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সার্বভৌমিকতার ধারণার সঙ্গে স্বাধীনতার ধারণার বিরোধ দেখা দেয়। সার্বভৌমিকতা হল রাষ্ট্রের চরম, চূড়ান্ত ও অবাধ ক্ষমতা। অপরপক্ষে স্বাধীনতা বলতে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণবিহীনতাকে বোঝায়। সুতরাং উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ স্বাভাবিক। স্বাধীনতার ধারণার পরিবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সার্বভৌমিকতা ও স্বাধীনতার মধ্যে বিরোধ নিরসনের চেষ্টা করা হয়েছে। মিল স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণবিহীনতা হিসাবে কল্পনা না করে, মানুষের মৌলিক মানসিক শক্তির বলিষ্ঠ, বিভিন্নমুখী এবং অব্যাহত প্রকাশ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে ব্যক্তির এরকম স্বাধীনতার স্বার্থে ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিক কার্যে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ অকাম্য। মিল তাঁর Liberty শীর্ষক গ্রন্থে স্বাধীনতার স্বরূপ সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। বস্তুত তিনি নেতিবাচক স্বাধীনতার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন: “Over himself, over his own body and mind this individual is sovereign. বার্কার মিলের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীন হওয়া উচিত। তাই কোনো ব্যক্তিই অবাধভাবে স্বাধীন হতে পারে না।’ তাঁর মতে ‘মিল ছিলেন শূন্যগর্ভ স্বাধীনতার প্রবক্তা’।
আদর্শবাদীগণ: আদর্শবাদীগণ স্বাধীনতার নেতিবাচক দিকটিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছেন। তাঁদের মতে ব্যক্তির উচ্চতর সত্তার প্রকাশ বা আত্মোপলব্ধির সুযোগ-সুবিধাই হল স্বাধীনতা। হেগেলের মতে, রাষ্ট্র ব্যতিরেকে স্বাধীনতা বাস্তবে পরিণত হয় না। হেগেল বলেছেন: “Nothing short of the state is the actualisation of freedom.” গ্রীণের মতে মানুষের জীবন ও মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদনের ক্ষমতাই হল স্বাধীনতা। গ্রীণের কথায়: “Freedom consists in positive power of capacity of doing or enjoying something worth-doing or worth-enjoying.”
আধুনিক ধারণা: ল্যাস্কির মতানুসারে স্বাধীনতা বলতে এক বিশেষ পরিবেশকে বোঝায়, যে পরিবেশে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে। ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী কতকগুলি বাহ্যিক সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষণের দ্বারা এই পরিবেশের হয়। ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক এই সুযোগ সুবিধাগুলিকেই অধিকার বলে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক ধারণা অনুসারে অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণের দ্বারা ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের ব্যবস্থা করাই রাষ্ট্রের কর্তব্য।
মার্কসীয় ধারণা: মার্কসবাদী মতবাদও স্বাধীনতার নেতিবাচক ধারণার সম্পূর্ণ বিরোধী। আবার এই মতবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণারও বিরোধী। মার্কসবাদী দর্শন অনুসারে সর্বপ্রকার আর্থিক অসাম্য ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে মানুষের মুক্তির পথ বা স্বাধীনতা সৃষ্টি সম্ভব। এই মতবাদ অনুসারে সামাজিক, রাজনীতিক ও আর্থনীতিক স্বাধীনতা পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কযুক্ত। মার্কসীয় স্বাধীনতার তত্ত্ব একটি সামগ্রিক ধারণা। এই ধারণা কখনই সমাজব্যবস্থার নিরপেক্ষ হতে পারে না। স্বাধীনতা সামাজিক ও অর্থনীতিক পরিবেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার উপর প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় স্বাধীনতা অসম্ভব। ব্যক্তির সম্পত্তির উপর ভিত্তিশীল সমাজব্যবস্থা শোষণমূলক। এই শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার অবসান ঘটলে স্বাধীনতার উপলব্ধি সম্ভব ও সার্থক হবে।