মানবিক সম্পর্কের বিন্যাস এবং ব্যক্তি ও নীতির মধ্যে সামঞ্জস্যসাধনকারী:
বার্কার তাঁর Principles of Social and Political Theory শীর্ষক গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদে ‘ন্যায়ের চূড়ান্ত নীতি’ এই শিরোনামে আলোচনার অবতারণা করেছেন। এই আলোচনায় তিনি ন্যায়কে একটি সমন্বয়ী ধারণা ( term of synthesis) হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। ন্যায়ের ধারণাকে তিনি মানবিক সম্পর্কসমূহের সঠিক বিন্যাসের নীতি হিসাবে দেখিয়েছেন। ন্যায় হল রাষ্ট্রের মধ্যে ও সাহচর্যে মানবিক সম্পর্কসমূহকে স্বাধীনভাবে সুবিন্যস্ত করার এক নীতি (“It is….the general right ordering of human relation in, and by the association of the State.”)। ন্যায়ের এই ধারণা ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এবং নীতির সঙ্গে নীতির সম্পর্কেও সুবিন্যস্ত রাখে। আবার ন্যায়কে ব্যক্তি ও নীতির মধ্যে চূড়ান্ত সামঞ্জস্য সাধনকারী (final adjustments of persons and principles) হিসাবেও বার্কার ব্যাখ্যা করেছেন। বার্কারের অভিমত অনুসারে ন্যায়ের এই ধারণা আপাত বিচারে নিতান্তই তত্ত্বগত, বিমূর্ত ও অবাস্তব বলে প্রতিপন্ন হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। কারণ প্রত্যেকের মধ্যেই ন্যায়ের ধারণা বর্তমান। ন্যায়ের সঠিক স্বরূপ সম্পর্কে সকলেই কোন-না-কোনভাবে অবহিত। সুদীর্ঘকালের সামাজিক চিন্তার ঐতিহাসিক ধারায় ধীরে ধীরে ন্যায়ের ধারণা গড়ে উঠেছে। সুতরাং ন্যায়ের ধারণা হল একটি সাধারণ উত্তরাধিকার বিশেষ। এ হল একটি সামাজিক সত্য ও বাস্তব বিষয়। এ হল বাস্তব মনের বাস্তব বস্তু, কোন কাল্পনিক ধারণা। সুদীর্ঘকালের সামাজিক চিন্তাধারার প্রক্রিয়ায় ন্যায়ের ধারণা প্রতিফলিত হয়। স্বভাবতই ন্যায়-ধারণার একটি বাস্তব ভিত্তি বর্তমান। কারণ সামাজিক চিন্তাধারার একটি বাস্তব ভিত্তি আছে। বার্কার বলেছেন: “The idea of justice resides in all minds, and it has been created and developed through the ages by a process of historical social thought, which has made it a common inheritance… it is not an abstract conception but a social reality: an actual content of actual minds….”
ন্যায় ও নৈতিকতা:
বার্কারের মতানুসারে ন্যায়কে নৈতিকতা বলা যায় না। অনুরূপভাবে ন্যায়ের নিয়মাবলীকে নীতিশাস্ত্র বলা যায় না। ন্যায়ের আচরণবিধি অন্তর্জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে না। ন্যায় অন্তর্জীবনের নিয়মাবলী নয়। ন্যায় নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের বাহ্যিক জীবনকে সুসংগঠিত সমাজব্যবস্থার সদস্য হিসাবে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের জীবন বর্তমান। ন্যায় এই জীবনকেই নিয়ন্ত্রণ করে। অপরদিকে মানুষের অন্তজীবন ও উদ্দেশ্য প্রসঙ্গেই নৈতিকতা প্রযোজ্য। তবে বাস্তবে ব্যক্তির বাহ্যিক আচরণবিধি তার অন্তর্জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। আভ্যন্তরীণ নৈতিক জীবনের সঙ্গে বাহ্যিক সম্পর্কযুক্ত জীবনের নিয়মাবলীর ওতপ্রোত সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায় না। এইভাবে বার্কার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ‘ন্যায়’ নৈতিকতা নয়। এ কথা ঠিক। এতদসত্ত্বেও নৈতিকতার উপরই ন্যায় প্রতিষ্ঠিত। অনুরূপভাবে আবার ন্যায়ের নিয়মাবলী নীতিশাস্ত্র নয়। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে ন্যায়ের উৎপত্তি নীতিশাস্ত্র থেকেই। বার্কার বলেছেন: “If justice is not morality it is based upon it. If its code is not that of ethics, it is a code which, … in ultimately derived from ethics.”
ন্যায়ের ক্রিয়াবিধিমূলক ধারণা:
জাস্টিনিয়ান ইনস্টিটিউটস্ (Institutes of Justinian) অনুসারে ন্যায়ের ধারণা হল একটি মানসিক অনুভূতি এবং সঠিক, সাধারণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার এক সদিচ্ছা। এ ক্ষেত্রে ন্যায়ের বিবিধ ক্রিয়াবিধির কথা বলা হয়েছে। এগুলি হল নিজের অবস্থা অনুসারে জীবন যাপন করা, অপরের অবস্থার ক্ষতিসাধন না করা এবং প্রকৃতপক্ষে ও ইতিবাচকভাবে অপরের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টটলও তিন ধরনের ন্যায়ের কথা বলেছেন। এই তিন ধরনের ন্যায় হল : বণ্টনমূলক ন্যায় (distributive justice), সংশোধন-মূলক ন্যায় (corrective justice) এবং বিনিময়ভিত্তিক ন্যায় (commutative justice)। বণ্টনমূলক ন্যায়-ধারণা অনুসারে রাজনীতিক জনসম্প্রদায়ের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি তার যথাযোগ্য মর্যাদা ও প্রাপ্য অংশ পাবে। এর সঙ্গে জাসটিনিয়ান ক্রিয়াবিধির তৃতীয় ব্যাখ্যার সঙ্গে আংশিক মিল পরিলক্ষিত হয়। সংশোধনমূলক ন্যায় বলতে জনসম্প্রদায় ও ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আদান-প্রদানের প্রাক্কালে সামাজিক অবস্থা ও অধিকারের অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন ক্ষতি হয়, তা হলে তার সংশোধন। এর সঙ্গে জাসটিনিয়ান ক্রিয়াবিধির দ্বিতীয় ব্যাখ্যার সাদৃশ্য বর্তমান। বিনিময়ভিত্তিক ন্যায়ের উদ্দেশ্য হল বেচাকেনা বা লেনদেনের স্বেচ্ছামূলক আদান প্রদানের ক্ষেত্রে কোন দ্রব্য বা পরিষেবার বিনিময়ে অন্য দ্রব্য বা পরিষেবার অনুপাত নির্ধারণ।
ভারসাম্যের ধারণা:
‘ন্যায়’ কে ভারসাম্যের ধারক হিসাবেও প্রতিপন্ন করা হয়। মানব সমাজে স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের নীতিসমূহের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু সমাজব্যবস্থায় এই সমস্ত নীতির মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই বিরোধ বাধে। ন্যায়-ধারণা এই বিরোধের নিষ্পত্তি করে এবং উল্লিখিত নীতিগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে। বার্কারের অভিমত অনুসারে এই ভারসাম্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ন্যায়-ধারণা ব্যর্থ হলে সমাজজীবনে বিবাদ-বিসংবাদের আশংকা অনস্বীকার্য। বার্কার বলেছেন: “…justice holds in the balance both the claims of persons to rights and the claims of different principles to determine the distribution of rights, and she measures than both by the standard of the maximum development of the capacities of personality in the maximum number of persons.” জনসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ন্যায় বিভিন্ন অধিকারকে দাবি অনুসারে যথাযথ বণ্টনের ব্যবস্থা করে। পরস্পর-বিরোধী দাবির মধ্যে ন্যায়-ধারণা ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যবস্থা করে। বণ্টনের নীতিসমূহকে ন্যায় নিয়ন্ত্রণ করে। এইভাবে ন্যায় সমাজে ভারসাম্য বজায় রাখে। এদিক থেকে ন্যায়ের একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য মানবীয় রূপের কথা বলা হয়। এই মানবের হাতে একটি দাঁড়িপাল্লা এবং তার চোখ দুটি কাপড়ে বাঁধা। এ হল নিরপেক্ষতার প্রতীক। বার্কার বলেছেন: “…justice is the holder of a balance and the visual representations of the personified figure of justice accordingly show her with a balance in her hand and eyes blindfolded as a sign of her impartiality.”