মানুষের পরিবেশ-পরিমণ্ডল দূষিত হয় বিভিন্ন কারণে এবং বিভিন্ন ভাবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেদের পরিবেশ দূষণের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী। স্বভাবতই নিজেদের অপকর্মজনিত পরিবেশ দূষণের কুফল মানুষকেই দুর্ভোগের সম্মুখীন করে। পরিবেশ দূষণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘটে। তদনুসারে পরিবেশ দূষণের প্রকারভেদ পরিলক্ষিত হয়। পরিবেশ দূষণের শ্রেণীবিভাজন হলঃ
-
(ক) বায়ুদূষণ (Air pollution),
-
(খ) জলদূষণ (Water pollution),
-
(গ) মৃত্তিকা দূষণ (Soil pollution),
-
(ঘ) শব্দদূষণ (Sound pollution) এবং
-
(ঙ) তেজষ্ক্রিয় দূষণ (Pollution of radioactivity)।
এই সমস্ত ধরণের দূষণ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক।
(ক) বায়ুদূষণ
বায়ু দূষণের ধারণা:
বায়ু হল বিভিন্ন গ্যাসের এক মিশ্রণ। এই বায়ুর একটি পাতলা আস্তরণ পৃথিবীর সর্বদিকে বর্তমান। অধুনা বায়ুদূষণ বিশ্বব্যাপী একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। আগেকার দিনে বায়ুদূষণ বলতে ধোঁয়াদূষণকে বোঝাত। বর্তমানে বায়ুদূষণের ধারণা অত্যন্ত সুক্ষ্ম। বায়ুদূষণের কোন ভৌগোলিক বা রাজনীতিক সীমানা নেই। বায়ুদূষণ বলতে বোঝায় যে, চতুর্দিকের পরিমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাস, গ্যাসসমূহের মিশ্রণ ও অন্যান্য নির্দিষ্ট উপাদানসমূহের অস্তিত্ব, যেগুলি মানুষের কার্যকলাপের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এবং যেগুলি মানুষের স্বাস্থ্য, স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার প্রতিকূল। গাছপালা, জীবজন্তু ও মৃত্তিকার উপর বায়ুদূষণের প্রত্যক্ষ কার্যকরিতা ‘ইকোসিসটেম’ (ecosystem)-এর কাঠামো ও কার্যাবলীকে প্রভাবিত করে। আত্মনিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য ও ব্যবস্থাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারফলে জীবনযাপনের মানের হানি ঘটে। কলকারখানা, যানবাহন প্রভৃতি থেকে নির্গত গ্যাস, ধোঁয়া, ছাই, দূষিত জল প্রভৃতির সংস্পর্শে এসে বাতাস দুষিত হয়। অর্থাৎ বায়ু ও পরিবেশ-পরিমণ্ডল দূষিত হয়ে পড়ে যখন মানুষের দ্বারা সৃষ্ট অবাঞ্ছিত ও ক্ষতিকর কঠিন বর্জ্য পদার্থ ও বিষাক্ত গ্যাস বাতাসের সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়। শংকর রাও তাঁর Sociology of Indian society শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Air or atmospheric pollution refers to the contamination of the air by the addition of unwanted solid wastes or gases produced by human activities.” বায়ু দুষিত হয় দূষক (pollutant)-এর দ্বারা। দূষক বলতে উৎপাদিত বর্জ্যা বা বর্জিত অংশের দ্বারা প্রস্তুত দ্রব্যকে বোঝায়। এই বর্জ্যগুলি নির্গত হয়ে পরিবেশের মধ্যে এসে পড়লে পরিবেশ দূষিত হয়। সুতরাং উৎপাদিত বর্জ্য্যগুলি দূষক হিসাবে পরিবেশকে দূষিত করে। বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রীর উদ্ভাবন বা উৎপাদন সম্পর্কিত উদ্যোগ-আয়োজন অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বায়ুদূষকসমূহ অধিক মাত্রায় পরিবেশ পরিমণ্ডলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। তারফলে পরিমণ্ডলের গতিশীল ভারসাম্য নষ্ট হয়। এই অবস্থায় মানুষ ও তার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বায়ু দূষকসমূহ:
কলকারখানার চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে মিশে পরিমণ্ডলের বায়ুকে দূষিত করে। একথা ঠিক। কিন্তু বায়ুদূষণের জন্য অধিক মাত্রায় দায়ী হল বাস, ট্যাক্সি, ট্রাক, অটো প্রভৃতি যানবাহনের পাইপ থেকে বেরোনো ধোঁয়া। তবে শিল্পকারখানাগুলির ধোঁয়াও এক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বায়ু দূষক গ্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, তাছাড়া ধুলো-ধোঁয়া এবং সীসা (lead) উপাদানসমূহ। ডিজেল পেট্রল পুড়ে যানবাহনের পাইপ থেকে বেরোয় প্রচুর পরিমাণে কার্বন মনোক্সাইড। এই উপাদানটি অতিমাত্রায় বিষপূর্ণ। নির্গত ধোঁয়ায় নাইট্রোজেন অক্সাইডও থাকে। এই উপাদানটি বাতাসে বাদামী রঙের আস্তরণ সৃষ্টি করে। তেমনি আবার গ্যাসোলিন বাতাসে সীসার পরিমাণ বৃদ্ধি করে। কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাই, দিল্লি প্রভৃতি বড় বড় শহরগুলিতে যানবাহনগুলি প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত ধোঁয়া নির্গত করে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সমস্ত বড় শহরে প্রতিদিন স্বয়ংক্রিয় যানবাহণগুলি গড়ে এক কোটি কিলোগ্রাম বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে মিশিয়ে দেয়। বিশ্বব্যাপী বড় বড় শহরে ও শিল্পাঞ্চলে বায়ুদূষনের মান-মাত্রা ক্রমবৰ্দ্ধমান। স্বাভাবিক সহ্য সীমার বাইরে বায়ুদূষণের মধ্যে শহরের অধিবাসীদের বসবাস করতে হয়। তবে উন্নত দেশগুলি বিগত দু’দশকে বায়ুদূষণকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং বায়ুর গুণগত মানকে নিরাপদ করার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বায়ুদূষণের মান-মাত্রা বাড়ছে। তার কারণও আছে। কারণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল, ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন প্রক্রিয়া; ক্রমবর্দ্ধমান বিদ্যুৎ উৎপাদন; রাস্তাঘাটে মোটর গাড়ীর সংখ্যাধিক্য; গাড়ীগুলির দুর্দশার কারণে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া প্রভৃতি।
বড় বড় শহরে বায়ু দূষণ:
মুম্বাইয়ের মত ঘনজনবসতিপূর্ণ শিল্প-শহরে বায়ুদূষণের বিষয়টি বিশেষভাবে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই কারণে মুম্বাইয়ের অধিবাসীদের মধ্যে দশ শতাংশেরও অধিক সংখ্যক মানুষ সাধারণত হাঁপানি, কফ-কাশি, ব্রঙ্কাইটিস, মাথাধরা প্রভৃতি শারীরিক সমস্যাদি থেকে ভোগেন। নীরী (NEERINational Environmental and Engineering Research Institute) কলকাতায় একটি সমীক্ষা সম্পাদন করে। সংশ্লিষ্ট সমীক্ষা সূত্রে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড়ে ১২৯৯ দুষিত জিনিস কলকাতার বাতাসে সংযুক্ত হয়। এই পরিমণ্ডল দূষণের কারণে কলকাতার ষাট শতাংশ মানুষ ফুসফুসের বিবিধ রোগ থেকে ভোগেন। ‘নীরী’ (NEERI) কর্তৃক সম্পাদিত আর একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, আগ্রার তাজমহলের চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সরকারী মালিকানাধীন তৈল শোধনাগার থেকে প্রত্যহ চব্বিশ টন সালফার ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়। তারফলে তাজমহলের মত ভুবনবিখ্যাত সৌধের ক্ষতি হয়। ভূপালের গ্যাস দুর্ঘটনা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৪ সালের কথা। ভূপালের ইউনিয়ন কারবাইট কারখানায় দুর্ঘটনাজনিত কারণে মারণ গ্যাস লীকের ঘটনা ঘটে। দু’হাজার মানুষের জীবনাবসান ঘটে। হাজার হাজার মানুষ শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন শিল্পকারখানাই বিষাক্ত কেমিক্যাল নির্গত করে এবং বায়ুকে দূষিত করে। বিভিন্ন শিল্পে এটাই হল উৎপাদন প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক ধারা।
বায়ুদূষণের প্রতিকূল প্রভাব-প্রিতিক্রিয়া:
বায়ুদূষণের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া জীবজগতের মত উদ্ভিদ জগতের উপরও পড়ে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আবশ্যক।
(ক) বায়ুদূষণের কারণে শরীর-স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মহামারীর সমীক্ষা সূত্রে জানা যায় যে, বায়ুদূষণের হার হঠাৎ বৃদ্ধি পেলে তৎক্ষনাৎ মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। বায়ুদূষণের কারণে মানবদেহে বিবিধ ব্যাধি বাসা বাঁধে। বায়ুদূষণ জনিত রোগ-ব্যাধির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুসের রোগ, হৃদযন্ত্রে রোগ, পক্ষাঘাত, চোখের অসুখ, হাঁপানি, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস প্রভৃতি। এ সব রোগ অসুখের কারণে মৃত্যুও অস্বাভাবিক নয়।
(খ) বাতাসে সীসার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে মানুষের শরীরের উপর তা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিশেষত শিশুদের মস্তিষ্কের এবং স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ বিশেষভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। স্কুলে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বিঘ্নিত হয় এবং আচার-ব্যবহারে ত্রুটিবিচ্যুতি দেখা দেয়।
(গ) বাতাসে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়; হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন বহনের ক্ষমতা হ্রাস পায়। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াকর্মে বিপত্তির সৃষ্টি হয়। কার্বন মনোক্সাইড যুক্ত বাতাসের কারণে মাথাধরা, পক্ষাঘাত প্রভৃতির সৃষ্টি হয়।
(ঘ) বায়ুদূষণ গাছপালার স্বাভাবিক বৃদ্ধির উপর প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বায়ুদূষণের কারণে ইমারতের ক্ষয়ক্ষতি হয়, ধাতব জিনিসপত্রেরও অবক্ষয় ঘটে। ঘরবাড়ি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা কঠিন ও ব্যয়সাধ্য হয়ে পড়ে। চারুশিল্পকলার উপরও বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
(ঙ) আবহাওয়ার উপরও বায়ুদূষণের প্রতিকূল প্রভাব পড়ে। বায়ুদূষণের কারণে আবহাওয়ার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ হ্রাস পায় এবং বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হয়ে পড়ে।
(চ) বায়ুদূষণের কারণে অনেক সময়, বিশেষত শহরাঞ্চলে ধোঁয়াশা পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হয়। তারফলে দৃশ্যমানতা হ্রাস পায়, গাড়ী চালাতে অসুবিধা হয়।
(খ) জলদূষণ
জীবনধারণের জন্য জল অপরিহার্য। পৃথিবীর প্রায় আশি শতাংশই জল। কিন্তু এই এত পরিমাণ জলের খুব সামান্য অংশই ব্যবহারযোগ্য। ব্যবহারযোগ্য এই সামান্য পরিমাণ জলই আবার ক্রমবর্ধমান দূষণের কারণে অব্যবহারযোগ্য হয়ে পড়ছে। ক্রমবর্দ্ধমান জনসংখ্যা এবং শিল্পায়নের বিকাশ ও বিস্তর ব্যবহার জল সরবারাহের উপর ক্ষতিকর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে।
জলদূষণের অর্থ:
জলদূষণ বলতে বোঝায় বিষাক্ত দূষকের সংস্পর্শে জল দূষিত হওয়াকে। জল দূষণ কোন কোন প্রাণীর বা সকল প্রাণীর জীবনকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। নর্দমায় নিষ্কাশিত আবর্জনা, সংক্রামিত ক্ষতিকর জল, বিষাক্ত রাসায়নিক, কলকারখানার দূষিত জল প্রভৃতির সংস্পর্শে এসে জল দূষিত হয়ে পড়ে। এইভাবে দুষিত জল কূপ, নদীনালা, বড় বড় জলাশয় এবং সাগরে গিয়ে পড়ে। তারফলে জল দূষিত হয়। বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী দারা (S.S. Dara) তাঁর A Text Book of Environmental Chemistry and Pollution Control শীর্ষক গ্রন্থ বলেছেন: “Any human activity that impairs the use of water as a resource may be called water pollution.” জন বিস্ফোরণ, ব্যাপক শিল্পায়ন, নগরায়ন, কৃষিকর্মে ব্যাপক হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, শহরাঞ্চলের নর্দমা ও কলকারখানার নিষ্কাশিত বিষাক্ত জল মানুষের ব্যবহার্য জলকে দূষিত করে। ১৯৮২ সালের এক সমীক্ষার পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, এ দেশে মোট প্রাপ্ত জলের সত্তর শতাংশ দূষিত।
নদ-নদী ও দরিয়ার জল দূষণ:
ভারতের বিভিন্ন নদী এবং হ্রদের মত বড় জলাধারগুলিকে আবর্জনার আঁস্তাকুড় হিসাবে ব্যবহার করা হয় ও হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী শিল্পকারখানাগুলিই এর জন্য দায়ী। বিষাক্ত রাসায়নিক, কলকারখানার বর্জ্য, কৃষি ক্ষেত্রের বর্জ্য, বিভিন্ন কীটনাশক ও অ্যাসিড নদী ও হ্রদ এসে পড়ে। কাপড় কল, কাগজ কল, লৌহ শিল্প, চর্মশিল্প প্রভৃতি প্রধান প্রধান শিল্পকারখানাগুলি তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জলের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। এই সমস্ত কল-কারখানা নদ-নদী থেকে জল নেয় এবং দূষিত ও গরম অবস্থায় নদ-নদীতে আবার পরিত্যাগ করে। তারফলে জল দূষিত হয়ে পড়ে। সমাজবিজ্ঞানী স্কারপিত্তি ও অ্যান্ডারসন (F. R. Scarpitti & M. L. Anderson) তাঁদের Social Problems শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলেছেন: “Pollutants that industries discharge into rivers and oceans are many and various solid wastes, sewage, non-degradable by-products, synthetic materials, toxic chemicals, and even redioactive substences. Added to this are the polluting effects of sewage systems of towns and large cities, detergents, oil spills, pesticide run-off from agricultural areas, and acid run-off from strip-mined lands and the enormity of the problem is even clearer.” সমুদ্রের জলও দূষিত হয় এবং হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মূল কারণ হল তেল। মোট জ্বালানি তেলের অর্ধেকের অধিক সমুদ্র পথে জাহাজ বা ট্যাঙ্কারে সরবরাহ করা হয়। চলকে পড়ে বা ছিদ্র দিয়ে সরবরাহ করা জ্বালানি তেলের একটা অংশ সাগরের জলে মিশে যায়। সাগরের জলের উপরিভাগে এই তেল একটা আস্তরণর সৃষ্টি করে। এই আস্তরণ সহজে নষ্ট হয় না, বরং বছরের পর বছর জুড়ে এই আস্তরণ বাড়তে থাকে এবং দরিয়ার জল দূষিত হয়।
নদী ও লেকের জলে দূষণ:
ভারতের অধিকাংশ নদীর জল দূষিত হয়ে পড়ে শিল্পকারখানার বর্জ্য বা নর্দমার জলে। গঙ্গা ও কাবেরি নদীর জল বিশেষভাবে, দুষিত। কলকাতার গা দিয়ে হুগলি নদী প্রবাহিত। এর তীরবর্তী উভয় দিকে একশ কিলোমিটারের মধ্যে সাড়ে তিনশ কলকারখানা আছে। এই কারখানাগুলির বর্জ্য্য হুগলী নদীকে কলুষিত করে। দুর্গাপুর ও আসানসোল এই দুটি বড় শহরে গড়ে উঠা সকল শিল্পকারখানা এবং বসবাসকারী সকল পরিবারের প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করা হয় দামোদর নদী থেকে। দুর্গাপুর ও আসানসোল এই দুই শহরের অন্তবর্তী অঞ্চলে আছে প্রায় সত্তরটি বড় শিল্পকারখানা এবং আড়াইশটি কয়লাখনি। এই সমস্ত কারখানা ও খনির দূষিত বর্জ্যের কারণে দামোদর নদীর জল প্রায় বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। শ্রীনগরের ‘ডাল’ ও ‘নাগিণ’ লেক, ওড়িশার ‘চিলকা’, মনিপুরের ‘লোকতাক’ বিভিন্ন ধরণের বর্জ্যে দূষিত হয়ে পড়েছে।
জল দূষণের উৎস:
জল সরবরাহের উৎস এবং জল শোধনের প্রক্রিয়া যথেষ্ট উন্নত মানের হলেও জল দূষিত হয়ে পড়ার অশঙ্কা থাকে এবং দুষিত হয়ও। এর কারণ হিসাবে কতকগুলি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এই বিষয়গুলি হল: জল সরবরাহের পাইপ লাইনের ক্ষয়ফতি, পাইপ লাইনের জোড়মুখে ছিদ্র, পরিশ্রুত ও অপরিশ্রুত জলের পাইপ লাইনের মধ্যে সংযোগ প্রভৃতি। কিছু পরিমাণ জলদূষণ আপনাআপনি পরিশোধিত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু দূষণের হার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে স্বয়ংশোধন সম্ভব হয় না। জল দুষণের ব্যাপারে তিনটি প্রধান উৎসকে দায়ী করা হয়। জল দূষণের মূল তিনটি উৎস হল : (ক) নর্দমার অবর্জনা, (খ) শিল্পকারখানার বর্জ্য এবং (গ) কৃষিক্ষেতের বর্জ্য। জলদূষণের ব্যাপারে বর্তমানে শিল্পকারখানা-গুলিকেই প্রধানত দায়ী করা হয়।
দুষিত জল পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই:
দূষিত জলকে দূষণমুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। জল পরিশোধনের ব্যবস্থা ভারতে মোটেই সন্তোষজনক নয়। এ বিষয়ে ১৯৮৯-৯০ সালে একটি সমীক্ষা সম্পদিত হয়। ভারতে বড় শহরের মোট সংখ্যা ৩১১৯। তারমধ্যে মাত্র আটটি শহরে দুষিত জল পরিশোধনের ব্যবস্থা আছে। দুশ’নটি শহরে এব্যাপারে আংশিক ব্যবস্থা আছে। অবশিষ্ট ২৯০২ টি শহরে দূষিত জল পরিশোধনের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থাই নেই। স্বভাবতই এই সমস্ত শহরের দূষিত জল অপরিবর্তিত অবস্থায় বিভিন্ন নদীর জলের মধ্যে প্রবাহিত হয় এবং নদীর জলকে দূষিত করে।
দূষিত জলের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া:
জীব জগৎ এবং উদ্ভিদ জগতের উপর জলদূষণের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিমত অনুযায়ী ভারতে বিভিন্ন রোগের ষাট শতাংশের জন্য দায়ী করা হয় দূষিত জল পানকে। জল দূষণের কারণে মানুষের যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি পশুপক্ষী, মাছ, গাছপালা, শাকসব্জী প্রভৃতিরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
জলদূষণের কারণে নির্দিষ্ট ধরনের কিছু রোগ-অসুখের সৃষ্টি হয়।
-
(ক) দুষিত জলের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন ব্যাধির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: কলেরা, টাইফয়েড, জণ্ডিস, আমাশা প্রভৃতি। আগেকার দিনে ভারতে কলেরা ও টাইফয়েড রোগে বহু মানুষের মৃত্যু হত।
-
(খ) জল দূষিত হওয়ার কারণে মানুষের স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং হয়; মানুষ বিকলাঙ্গ হয়; এবং বিশেষত শিশুদের ক্ষতি বেশী হয়।
-
(গ) দূষিত জল মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীবনহানি ঘটায়।
-
(ঘ) গাছপালা, অন্যান্য উদ্ভিদ এবং অন্যান্য প্রাণীর বৃদ্ধি জল দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
-
(ঙ) পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজনে পরিশ্রুত জল প্রয়োজন। পরিশ্রুত জল অপ্রতুল হয়ে পড়লে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বিপন্ন হয়ে পড়বে।
-
(চ) জল দূষিত হলে জলপথে বৈদেশিক বাণিজ্য এবং অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সাম্প্রতিককালে আধুনক শিল্প প্রযুক্তির অনিবার্যতা অনস্বীকার্য। সুতরাং দূষণের অস্তিত্বও অনিবার্য। কিন্তু দূষণকে সাধ্যমত নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক। দূষণের মান-মাত্রা নির্ধারণ করে দেখা দরকার যে জীব জগৎ ও উদ্ভিদ জগতের ক্ষতি না করে কী পরিমাণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধন সম্ভব। পরিবেশ দূষণের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সম্যক মূল্যায়ন করা দরকার। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ‘বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা’ (WHO World Health Organisation) এ বিষয়ে কার্যকর কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
(গ) মৃত্তিকা দূষণ
মৃত্তিকা দূষণের ধারণা: মৃত্তিকা দূষণের বিষয়টিও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের মত কৃষিপ্রধান দেশে এই দুশ্চিন্তা আরও অধিক। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনধারার বহু ও বিভিন্ন বর্জ্যকে কিভাবে নষ্ট করে দেওয়া যায় তা অন্যতম পরিবেশ দূষণের সমস্যায় পরিণত হয়েছে। পরিবেশ দূষণের এই সমস্যা বিশ্বব্যাপী বর্তমান। সমগ্র ভারতে প্রতিদিন টন টন আবর্জনার সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত আবর্জনার মধ্যে থাকে কাগজ, কাঁচ, প্লাসটিক, বিভিন্ন ধাতু, খাদ্যাবশেষ, কাঠের টুকরো, পোড়া মাটি প্রভৃতি। বিশিষ্ট প্রকৃতি বিজ্ঞানী দারা তাঁর A Text Book of Environmental Chemistry and Pollution Control শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতের বড়বড় শহরগুলিতে দৈনিক ঘর গৃহস্থালির ও পৌর কঠিন বজাসমূহের মোট পরিমাণ বিশাল। মাথাপিছু এই পরিমাণ তিনশ থেকে ছশ গ্রাম। পরিবেশবিজ্ঞানী দারা মন্তব্য করেছেন: “The amount being spent in municipalities in India for solid waste management is estimated to be 805 to 1200 million rupees annually which accounts for about 10% of their total budgetary provisions.” এই সমস্ত বর্জ্য্য মূলত মাটিতেই মেশে এবং মাটি দূষিত হয়।
কঠিন বর্জ্য নিয়ে যে আবর্জনা তার মধ্যে থাকে খাদ্য-বর্জ্য, আজেবাজে বিভিন্ন রাবিশ বস্তুসমূহ, যেমন, ভাঙ্গা প্লাসটিক, কাঁচ, ধাতব সামগ্রী; ভাঙ্গাভাঙ্গির ধ্বংসাবশেষ যেমন, ইট, স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ, পাইপ, আবর্জনা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অবশিষ্টাংশ প্রভৃতি, পশুপক্ষীর মৃতদেহ, রাসায়নিক ও অন্যান্য বাতিল বহু ও বিভিন্ন সামগ্রী। প্রাত্যহিক বর্জ্যের পরিমাণ বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এই বিষয়গুলি হল শিল্পায়ন ও নগরায়নের মান ও মাত্রা, জীবন যাপনের মান ও ধারা, খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতি। পরিবেশ বিজ্ঞানী সেসাগিরি (N. Sheshagiri) তাঁর Pollution শীর্ষক গ্রন্থে মৃত্তিকা দূষণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভারতীয় পরিবারসমূহের দায় দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এই পরিবেশ বিজ্ঞানীর অভিমত অনুযায়ী ভারতে পরিবারের সংখ্যা একশ’ মিলিয়নের অধিক। এই সমস্ত পরিবার প্রতিদিন গড়ে পঞ্চাশ মিলিয়ন বালতি কঠিন বর্জ্য ফেলে। বছরে কুড়ি হাজার মিলিয়ন বালতি বর্জ্য ভারতীয় পরিবারগুলি ফেলে। সব সময় নির্দিষ্ট জায়গায় যে পরিবারগুলি ময়লা ফেলে, তাও নয়; যত্রতত্র ময়লা ফেলার ঘটনা আকচার ঘটে। তারফলে পরিবেশ ও মৃত্তিকা দূষণ ঘটে।
মৃত্তিকা দূষণের অর্থ:
মৃত্তিকা দূষণের বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, মৃত্তিকা দূষণ বলতে বোঝায় মানুষের তৈরী বস্তুসমূহের দ্বারা মৃত্তিকাকে কলুষিত করা। তারফলে মৃত্তিকার ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব বৈশিষ্ট্যসমূহের পরিবর্তন ঘটে। কঠিন বর্জ্য্যসমূহই অধিক পরিমাণে মৃত্তিকা দূষণ ঘটায়। কঠিন বর্জ্য্যসমূহের মধ্যে আছে কৃষি, পৌর সংস্থা ও শিল্প সংস্থাসমূহের বাতিল করা বহু ও বিভিন্ন কঠিন উপাদান। কঠিন বর্জ্যের মধ্যে আছে সেই সমস্ত বর্জ্য যা বাতিল করা হয়েছে পরবর্তী ব্যবহারের জন্য এবং যা জল দিয়ে ধুয়ে জলধারার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যাবে না বা পরিমণ্ডলের সঙ্গে সহসা মিশে যাবে না। পরিবেশবিজ্ঞানী দারা তাঁর A Text Book of Environmental Chemistry and Pollution Control শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Any unwanted or discarded material from residential, commercial, industrial, mining and agricultural activities that cause environmental problems may be termed as solid wastes.”
কঠিন বজাসমূহ এক জায়গায় জমতে থাকলে শরীর স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপদের কারণ সৃষ্টি করে। পচন ধরার পর এই সমস্ত আবর্জনা স্তুপে মাছির বংশবৃদ্ধি ঘটে। পচাগলা আবর্জনার স্তুপে কীটমুখিকাদি প্রানী আকৃষ্ট হয়। এই সমস্ত আবর্জনার গাদায় জীবননাশক বিবিধ ব্যাক্টিরিয়া জন্মায় এবং মাছি ও ধুলো-বাতাসের মাধ্যমে বাহিত হয়ে মানুষের খাদ্য সামগ্রীতে হাজির হয়। এখানে-সেখানে গাদাগাদা ময়লা জমে দুর্গন্ধময় নোংরা পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শংকর রাও তাঁর Sociology of Indian Society শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Studies have revealed that there is a correlation between improper disposal of solid wastes and incidence of vector-borne diseases.” কঠিন বর্জ্যসমূহকে অনেক সময় মাটিতে পুতে দেওয়া হয়, বা পোড়ান হয় বা পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করার ব্যবস্থা করা হয়। আবার নদীতে বা দরিয়ায় বর্জ্যগুলিকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করার প্রক্রিয়া অনুসৃত হলে অন্য কথা, অন্যথায় কঠিন বর্জ্যসমূহ বায়ু, জল ও মৃত্তিকাকে দূষিত করে।
মৃত্তিকা দূষণের কারণসমূহ:
বহু ও বিভিন্ন কারণে মৃত্তিকা দূষণের ঘটনা ঘটে। বিবিধ উৎস থেকে মৃত্তিকা দূষণের কারণসমূহের সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত উৎসগুলি হল:
-
(ক) শিল্প বর্জ্য,
-
(খ) গৃহস্থালির বর্জ্য,
-
(গ) রাস্তাঘাটের বর্জ্য,
-
(ঘ) বাজারের বর্জ্য,
-
(ঙ) কৃষি ক্ষেত্রের বর্জ্য এবং
-
(চ) তেজস্ক্রিয় বর্জ্য।
(ক) শিল্প-বর্জ্য: মৃত্তিকা দূষণের একটি বড় কারণ হল শিল্প বর্জ্য। শিল্প কারখানাগুলিই মৃত্তিকাদূষণের কারণস্বরূপ বিবিধ উপাদানকে বর্জ্য হিসাবে বাতিল করে। এক্ষেত্রে দায়ী শিক্ষসমূহের মধ্যে বিশেষভাব উল্লেখযোগ্য হলঃ রাসায়নিক কারখানা, সার কারখানা, সিমেন্ট কারখানা, রবার কারখানা, কাপড়কল, কাগজ কল, চিনিকল প্রভৃতি। এই সমস্ত কলকারখানার চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া ও ছাই মৃত্তিকা এবং বায়ু ও জলকে দুষিত করে।
(খ) গৃহস্থালির বর্জ্য: ঘরগৃহস্থালীর বর্জ্যও মৃত্তিকা দূষণের অন্যতম উৎস। এ ধরনের বর্জ্যের মধ্যে বহু ও বিভিন্ন উপাদান বর্তমান। উদাহরণ হিসাবে উনুন বা আঁচের ছাই; ছেড়া-ফাটা ফুটো কাগজ, কাপড়, কাঠের টুকরো, ভাঙ্গা কাঁচ, ধুলো-ময়লা প্রভৃতি রাবিশ; এটোকাটা, আনাজের খোসা, অন্যান্য জৈব উপাদান প্রভৃতি আবর্জনা উল্লেখযোগ্য। কঠিন বর্জ্যের সঙ্গে এসব যুক্ত হয়।
(গ) রাস্তাঘাটের বর্জ্য: দুষণের অন্যতম উৎস হিসাবে রাস্তাঘাটের বর্জ্যের বিষয়টিও কম ভাবনার নয়। রাস্তাঘাট পরিস্কার করতে গিয়ে শহরাঞ্চলের পৌর সংস্থাসমূহ এবং গ্রামাঞ্চলের পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন বাতিল জিনিসপত্র জড়ো করে। এই সমস্ত জড়ো করা জিনিসপত্রের মধ্যে থাকে খড়কুটো, গাছের পাতা, ছেড়াফাটা কাগজপত্র, ফুটোফাটা প্লাসটিক, গরুর গোবর প্রভৃতি।
(ঘ) বাজারের বর্জ্য: বাজার-হাটের আবর্জনার বিষয়টিও অবহেলার নয়। এক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের হাটের থেকে শহরাঞ্চলের দৈনিক বাজারের আবর্জনার বিষয়টি অধিকতর চিন্তার বিষয়। পৌর কর্তৃপক্ষসমূহ বাজার পরিস্কারের ব্যবস্থা করে। তার থেকে যা পাওয়া যায়, তার মধ্যে থাকে শাকসব্জীর পাতা, ফলমূলের খোসা, মাছের আঁশ-কাঁটা, মুরগীর নাড়ীভুড়ি, দোকানের ঠোঙ্গা, প্লাসটিক ব্যাগ, প্যাকিং বাক্স প্রভৃতি।
(ঙ) কৃষিক্ষেত্রের বর্জ্য: কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি প্রযুক্ত হয়েছে। আধুনিক কৃষিতে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। তাছাড়া খামার বাড়ীতেও অন্যান্য আবর্জনার সৃষ্টি হয়। বিশেষত বিবিধ রাসায়নিক সার ও কীটনাশকসমূহ মৃত্তিকাকে ভীষণভাবে দূষিত করে এবং কালক্রমে চাষবাসের অনুপযোগী করে তোলে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হওয়া আবশ্যক, অন্যথায় মৃত্তিকা দূষণ তথা পরিবেশ দূষণ রোধ করা মুস্কিল হয় পড়বে।
(চ) তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য: তেজষ্ক্রিয় বর্জ্যও মৃত্তিকা এবং পরিবেশের মধ্যে দূষণের সৃষ্টি করে। তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য সৃষ্টি হয় আণবিক বিস্ফোরণের ফলে, আণবিক শক্তি উৎপাদনকারী প্লান্ট থেকে এবং তেজষ্ক্রিয় উপাদান ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে। তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নিদারুণ।
মৃত্তিকা দূষণের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া:
মৃত্তিকা দূষণের ক্ষতিকর ফলাফল ভয়াবহ। জীবজগৎ এবং উদ্ভিদ জগৎ উভয়ের উপরই মৃত্তিকা দূষণের প্রতিকূল প্রভাব প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়।
-
(১) মৃত্তিকা দূষণ মানুষের এবং পশুপক্ষীর স্বাভাবিক জীবনধারাকে বিপন্ন করে তোলে। খাদ্যশস্য, শাকসব্জী, ফলমুল প্রভৃতি সর্ববিধ চাষআবাদে অধুনা ব্যাপকভাবে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্ত কীটনাশকের অনেকটাই জমতে থাকে। তেমনি জমতে থাকে কাঁড়ি কাঁড়ি আবর্জনা। তারফলে মানুষের এবং প্রাণীকূলের শরীর-স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কীটনাশকের বিযে গাছ-পাতা বিষাক্ত হয়। বিষাক্ত গাছ-পাতা জীবজন্তু খায়। এই সমস্ত বিষাক্ত শাকসব্জী, ফলমূল এবং জীবজন্তুর মাংস মানুষ খায়। তারফলে শরীর-স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
-
(২) রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতি প্রয়োগের কারণে আবাদি জমির উর্বরতা হ্রাস পায়। আবাদি জমি অনুর্বর হয়ে এক সময় চাষবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
-
(৩) মৃত্তিকা দূষণের কারণে মাটির স্বাভাবিক ক্ষমতাসমূহের হানি ঘটে। তারফলে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়।
-
(8) পচাগলা আবর্জনার স্তুপ মশা-মাছি-আরশোলা ও পোকামাকড়ের আদর্শ আবাস ও বংশবৃদ্ধির সহায়ক স্থানে পরিণত হয়। রোগ-অসুখের কারণ স্বরূপ বিভিন্ন ব্যাকটিরিয়া জন্মায়।
-
(৫) মৃত্তিকা দূষণের কারণে প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়। মানুয়ের ও অন্যান্য জীবজন্তুর সুস্থ বসবাসের উপযোগী বাসভূমিতে টান পড়ে।
(ঘ) শব্দদূষণ
শব্দদূষণের আলোচনা আধুনিক কালের। অতি সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞানীরা শব্দদূষণ বিষয়টিকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছেন। শব্দ দূষণের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে মানুষকে তাঁরা সতর্ক করছেন। এই শ্রেণীর বিজ্ঞানীরা পরিবেশ বিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন। আধুনিককালের জীবনযাত্রায় হৈচৈপূর্ণ বিরক্তিকর শব্দ সৃষ্টির আধিক্য অনস্বীকার্য। এ রকম অবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত শ্রুতিকটু শব্দের কারণে শব্দদূষণ ঘটে। শব্দদূষণ মানুষের শরীর-স্বাস্থ্য, বিশেষত মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। মানুষের পরিবেশ-পরিমণ্ডলের মধ্যে হৈ হল্লা ও গোলমাল মানুষের পক্ষে পীড়নমূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। মানুষের বসবাসের পরিবেশ ক্রমান্বয়ে অধিকতর বিরক্তিকর শব্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আধুনিককালের জনজীবনে শব্দের আধিক্য অনস্বীকার্য। শ্রুতি কটু শব্দের আধিক্যের কারণে সৃষ্টি হয় শব্দ দূষণের । মানবসভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শব্দদূষণের সৃষ্টি হয়েছে এবং শব্দদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিমান বন্দরের বা বৃহৎ কোন শিল্পকারখানার কাছাকাছি বসবাস করলে বোঝা যায় শব্দদূষণ কী এবং কেমন। আধুনিক সমাজের অন্যতম নতুন ঘাতক হল শব্দদূষণ।
শব্দদূষণের অর্থ:
শব্দদূষণ বলতে সঠিক কী বোঝায় সে বিষয়ে অল্পবিস্তর মত পার্থক্য বর্তমান। এক জনের কাছে যা হৈ হল্লা অন্যজনের কাছে তা প্রীতিপ্রদ হতে পারে। অর্থাৎ হৈ হল্লার ধারণাটি বিষয়গত (Objective) হওয়ায় পরিবর্তে বিষয়ীগত (Subjective) হয়ে পড়ে। সাধারণভাবে বলা হয় যে, ‘অবাঞ্ছিত শব্দ’ ই হল ‘হৈ চৈ’। হৈ চৈ-এর এই সংজ্ঞা বহুলাংশে বিষয়ীগত। সুতরাং ‘হৈ হল্লা’ বা ‘গণ্ডগোল’ ধারণাটিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার।
হৈ হল্লা মানে অবাঞ্ছিত শব্দ। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই অবাঞ্ছিত শব্দটি বেঠিক জায়গায় এবং বেঠিক সময়ের হতে হবে। সুতরাং হৈ চৈ হল ‘ভুল জায়গায় ভুল সময়ে ভুল শব্দ’ (“Wrong sound in the wrong place, at the wrong time”)। সাধারণত অতি জোরের দীর্ঘস্থায়ী শব্দই হৈচৈ (noise) হিসাবে পরিগণিত হয়। হৈচৈ হল আধুনিক মানব সমাজের ক্রিয়াকর্মের পার্শ্বফসল। দীর্ঘকালীন চড়া শব্দ হৈ হল্লা হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। সাধারণত বিমান, ট্রেন, যানবাহণ, শিল্পকারখানা, লাউডস্পীকার প্রভৃতি উচ্চস্বরের শব্দের উৎস হিসাবে পরিচিত। হৈ হল্লা অনভিপ্রেত। কিন্তু তা অর্থবহ হতে পারে, অথবা অর্থহীন হতে পারে। হৈচৈ মানুষের মধ্যে এক ধরনের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মানুষের মনের উপর চাপ সৃষ্টি করে। স্বভাবতই হৈ হল্লা দূষণ হিসাবে পরিগণিত হয়। অর্থহীন ও দায়িত্বহীন হৈ হল্লা বিরক্তি ও রাগের সৃষ্টি করে।
শব্দদূষণের উৎসসমূহ:
বহু ও বিভিন্ন উৎস থেকে শব্দ দূষণের সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত উৎসের মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উচ্চশব্দের মূল উৎসগুলি হল বিমান পোত, বৃহদাকৃতির কলকারখানা, বাস-ট্রাকের মত যানবাহন, লাউডস্পীকর প্রভৃতি। রেডিও, ট্রানজিস্টার, টেলিভিশন প্রভৃতি গণমাধ্যমসমূহ থেকেও ঘরে উচ্চস্বরের শব্দের সৃষ্টি হতে পারে এবং হয়ও। এ সব থেকেও প্রত্যহিক জীবনে শব্দদূষণের সৃষ্টি হয়। জনজীবনের বিশেষ কতকগুলি ক্ষেত্র থেকে অধিক মাত্রায় শব্দ দূষণের সৃষ্টি হয়। এই ক্ষেত্রগুলি হল বিমান বন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টারমিনাস, অতিব্যস্ত ট্রাফিক প্রভৃতি। এই সমস্ত ক্ষেত্রের কাছাকাছি অঞ্চলে অবস্থান করলে শব্দদূষেণের শিকার হতে হবে। যানবাহনের ইলেকট্রিক হর্ণ, যাত্রা-থিয়েটার প্রভৃতি বিনোদনমূলক ক্রিয়াকর্মে লাউড স্পীকারের তারস্বরে আওয়াজ, দুর্গোৎসবের মত উৎসব অনুষ্ঠানে বিবিধ বাজনার কানফাটান আওয়াজ শব্দদূষণের সৃষ্টি করে। বিশেষত রাত্রিবেলা এ ধরনের শব্দদূষণ মারাত্মক হয়ে উঠে।
শব্দদূষণের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া:
শব্দদূষণের ক্ষতিকর ফলাফল অবহেলা করার নয়।
-
(১) মানুষের উপর শব্দদূষণের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া অনস্বীকার্য। শব্দদূষণ মানুষের শ্রবণ সামর্থ্যের হানি ঘটায়। শোনার ক্ষমতা কমতে থাকে। মানুষ কালা হয়ে যেতে পারে।
-
(২) শব্দ দূষণের কারণে মানুষের স্বাভাবিক আয়ু হ্রাস পেতে পারে।
-
(৩) শব্দদূষণের কারণে মানুষের মানসিক শান্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষের আবেগ-অনুভূতির বিপর্যয় ঘটতে পারে।
-
(৪) জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীর উপরও শব্দদূষণের প্রতিকূল প্রভাব পড়ে। প্রাণীদেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং কর্মক্ষমতারও হানি ঘটতে পারে।
-
(৫) শব্দদূষণের কারণে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেতে পারে।
-
(৬) শব্দদূষণের কারণে উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে।
(ঙ) আণবিক তেজষ্ক্রিয় দুষণ
আধুনিক সভ্যতার আর এক অভিশাপ হল তেজস্ক্রিয় দূষণ। আণবিক তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রাক্কালে স্বতস্ফূর্তভাবে ‘ইলেকট্রন’ electron) নামে পরিচিত অংশসমূহ এবং ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক’ (electromagnetic) রশ্মি নির্গত হয়। এই সমস্ত কণা বা রশ্মি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু এগুলি জীবদেহে প্রবেশ করে। তার ফলে সংশ্লিষ্ট জীবদেহের ক্ষতি সাধিত হয়। একেই বলে আণবিক তেজষ্ক্রিয় দূষণ। শংকর রাও তাঁর Sociology of Indian Society শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Radioactive Pollution results out of atomic radiation during which there is a spontaneous emission of particles (electrons) and rays (electromagnetic).”
তেজষ্ক্রিয় দূষণের উৎস:
আনবিক তেজস্ক্রিয়তার কারণে পরিবেশ দূষিত হয়। আণবিক তেজস্ক্রিয় পরিবেশ দূষণের প্রধান উৎস হিসাবে আণবিক শক্তি প্ল্যান্ট (Nuclear Power Plant) গুলির কথা বলা হয়। এই প্লান্টগুলি প্রচুর পরিমাণে আনবিক বর্জ্য উৎপাদন করে। এই সমস্ত আণবিক বর্জ্যের তেজস্ক্রিয়তা হাজার হাজার বছর ধরে সক্রিয় থাকে। আণবিক তেজষ্ক্রিয় কণাসমূহ জল, বায়ু বা মৃত্তিকার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন ও প্রত্রিয়াকরণের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই আশঙ্কা যদি সত্য হয়ে দাঁড়ায় তা হলে ভায়াবহ পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হবে। আণবিক বর্জ্যগুলিকে সঞ্চিতভাবে সংরক্ষণ করা যায় না। কারণ ছিদ্র দিয়ে তা বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। উন্নত সম্পদশীল দেশগুলি তাদের আনবিক বর্জ্য্যসমূহকে মুখআঁটা ধারণপাত্রে ভরে গভীর সমুদ্রে ফেলে দেয়।
আণবিক তেজষ্ক্রিয় দূষণের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া:
আণবিক তেজষ্ক্রিয় দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া এক কথায় ভয়াবহ। এক্ষেত্রে কতকগুলি আশঙ্কা দুর্ভাবনার সৃষ্টি করে।
-
(১) আনবিক বিস্ফোরণের ফল মৃত্যুর মিছিল ও অভাবিত ক্ষয়ক্ষতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকার আণবিক বোমা বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এখনও মানুষকে শিহরিত করে। সাবেককালের সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল-য়ে আণবিক শক্তি উৎপাদকারী প্ল্যান্ট (Nuclear Reactor Plant)-য়ে ছিদ্র হয়ে যায়। ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসা তেজষ্ক্রিয়তার কারণে বহু মানুষের জীবনাবাসন ঘটে।
-
(২) দীর্ঘকালীন ও পুনঃ পুনঃ আণবিক তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এলে ক্যনসার রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
-
(৩) মানুষ বা যে কোন প্রাণীর জঠরে অবস্থিত ভ্রুণ তেজষ্ক্রিয়তার প্রতি অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর।
-
(৪) উচ্চমাত্রায় তেজষ্ক্রিয়তা দিলে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।
-
(৫) কম মাত্রায় দিলেও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। শরীরবৃত্তের স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিঘ্নিত হতে পারে।