উনিশ শতকের পটভূমিকায় বঙ্কিমচন্দ্র পাশ্চাত্য সমাজতন্ত্রবাদ বা সাম্যবাদের সঙ্গে কিছুটা পরিচিত ছিলেন। তখনও এদেশে মার্কসবাদ প্রচার লাভ করেনি। ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে একজন আদর্শবাদী মানুষে মানুষে যে সাম্যের বাণী প্রচার করে এসেছিলেন; বঙ্কিমচন্দ্র তাতে অনুরাগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ‘সাম্য’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করে এদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন, কিন্তু এই গ্রন্থের প্রথম মুদ্রণ নিঃশেষিত হলে তিনি এর প্রচারে বিশেষ উৎসাহিত বোধ করেননি বলে দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয়নি।
বঙ্কিমচন্দ্র সাম্যবাদের আদর্শগত দিকটির প্রতি বিশেষ উৎসাহ প্রদর্শন করেছেন, তার অন্যতম প্রমাণ ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের ত্রয়োদশ সংখ্যার ‘বিড়াল’ নামক দপ্তরটি। দপ্তরটিতে সাম্যবাদের স্বরূপ বর্ণনার মধ্য দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে কৌতুক রস সঞ্চার করায় রচনাটি বিশেষ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
কমলাকান্ত নৈশ আহারের পূর্বে তার শয়নকক্ষে চারপাই-এ বসে হুঁকো হাতে ঝিমোতে ঝিমোতে ভাবছিল, সে যদি নেপোলিয়ন হত তবে ওয়াটার্নর যুদ্ধে জিততে পারত। এমন সময়ে ‘মেও’ করে একটি শব্দ হতেই তার মনে হল, ওয়েলিংটন হঠাৎ বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হয়ে তার কাছে আফিম ভিক্ষা করতে এসেছে। কমলাকান্ত ভাবল, প্রথম উদ্যমে সে পাষাণের মতো কঠিন হয়ে বলবে, ডিউক মহাশয়কে ইতিপূর্বেই যথোচিত পুরস্কার দেওয়া গেছে, আর অতিরিক্ত পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে না, বিশেষতঃ অপরিমিত লোভ ভাল নয়। আবার ‘মেও’ শব্দ হতেই কমলাকান্ত ভালো করে তাকিয়ে দেখল, ডিউক অব ওয়েলিংটন নয়, একটি বিড়াল। প্রসন্ন তার জন্য দুধ রেখে গিয়েছিল, তা নিঃশেষ করে পান করেছে। দুধ কমলাকান্তের বাপের নয়, মঙ্গলা গাইয়ের, দুয়েছে প্রসন্ন; সুতরাং তাতে তার যে অধিকার, বিড়ালেরও তাই। সুতরাং সে রাগ করতে পারে না। তবে একটি চিরাচরিত প্রথা আছে যে বিড়াল দুধ খেয়ে গেলে তাকে মারতে যেতে হয়। সেই প্রথার অবমাননা করে কমলাকান্ত মানব সমাজে কুলাঙ্গাররূপে পরিচিত হবে, মার্জারীও মার্জার-কুলে তাকে কাপুরুষ বলে উপহাস করতে পারে—এটা বাঞ্ছনীয় নয়। সেইজন্য সে কাতরচিত্তে হুঁকো নামিয়ে অনেক অনুসন্ধানে একটা ভাঙা লাঠি আবিষ্কার করে সগর্বে বিড়ালে দিকে ধাবমান হল। বিড়াল ভীত হওয়ার কোনো লক্ষণ প্রকাশ করিল না, কমলাকান্ত অলৌকিক শ্রবণশক্তি প্রাপ্ত হয়ে বিড়ালের বক্তব্যগুলি বুঝতে পারল।
ধনীদের দ্বারা শোষিত সর্বহারা দরিদ্র শ্রেণীপ্রতিনিধিরূপে বিড়াল কমলাকান্তকে বলেছে : কমলাকান্ত ধনী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, তারা এই সংসারের ক্ষীর, সর, দুধ, দই, মাছ, মাংস প্রভৃতি সুখাদ্য খাবে, আর তারা দরিদ্ররা কিছু পাবে না কেন? কমলাকান্তেরা মানুষ অর্থাৎ ধনী, আর তারা বিড়াল অর্থাৎ দরিদ্র প্রভেদ তো এইটুকু। ধনীদের ক্ষুধাতৃষ্ণা আছে, দরিদ্রদের নেই? দরিদ্ররা খেলেই কোন্ শাস্ত্রানুযায়ী তারা লাঠি নিয়ে মারতে আসে তার কারণ বহু অনুসন্ধানেও পাওয়া যায় না। পরোপকারই পরম ধর্ম, কমলাকান্তের আহরিত দুধ পান করে বিড়ালের পরম উপকার হয়েছে, সুতরাং সে চুরি করুক আর যাই করুক, বিড়াল তার ধর্ম সঞ্চয়ের মূল কারণ। সুতরাং তাকে প্রহার না করে কমলাকান্তের প্রশংসা করাই উচিত। বিড়াল চোর বটে, কিন্তু সে কি সাধ করে চোর হয়েছে। খেতে পেলে কে চোর হয়। বড়ো বড়ো সাধু নামে পরিচিত ব্যক্তি যাঁরা চোরের নামে শিউরে ওঠেন, তাঁরা অনেকে চোর অপেক্ষাও অধার্মিক; চুরি করার প্রয়োজন নেই বলেই তারা চুরি করেন না। কিন্তু প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন থাকা সত্ত্বেও তাঁরা যে চোরের দিকে মুখ তুলে তাকান না, তার জন্যই চোর চুরি করে। প্রকৃতপক্ষে চোরের চুরি করায় অধর্ম কৃপণ ধনীর। চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তার থেকে শত গুণে দোষী। অথচ চোরের শাস্তি হয়, চুরির মূল কারণ কৃপণের শাস্তি হয় না।
বিড়াল প্রাচীরে প্রাচীরে ঘুরে বেড়ায়, কেউ তাকে একখানা মাছের কাঁটা পর্যন্ত ফেলে দেয় না। মাছের কাঁটা, পাতের ভাত নর্দমায় বা জলে ফেলে দেয়, তবু তাকে ডেকে দেয় না। ধনীরা এইভাবেই তাদের ভুক্তাবশিষ্টটুকু পর্যন্ত দরিদ্রদের দেয় না। ধনীদের পেট ভরা, তারা কী করে দরিদ্রদের পেটের ক্ষুধা জানবে, তাদের জন্য ব্যথিত হওয়া যেন তাদের পক্ষে অগৌরবের, লজ্জার কথা। যে কখনও অন্ধকে মুষ্টিভিক্ষা পর্যন্ত দেয় না, সেও একটা বড়ো রাজা সংকটে পড়লে উদ্বেগে রাত্রে ঘুমায় না, সকলেই পরের ব্যথায় ব্যথিত হতে রাজি। কিন্তু ছোটোলোকের দুঃখে কাতর হওয়া যে পরম লজ্জার! যদি অমুক শিরোমণি কী ন্যায়ালংকার এসে কমলাকান্তের দুধটুকু খেয়ে যেত, তবে সে কি লাঠি দিয়ে মারতে আসত? বরং জোেড় হাত করে বলত, আর একটু কি এনে দেব। কমলাকান্ত বলবে, তাঁরা অতি পণ্ডিত ও বড়ো মান্য লোক। পণ্ডিত বা মান্য বলে কি তার মতো দরিদ্র অপেক্ষা তাঁদের ক্ষুধা বেশি? তা নয়, তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ, দরিদ্রের ক্ষুধা কেউ বোঝে না। যে খেতে বললে বিরক্ত হয়, তার জন্য সকলে ভোজের আয়োজন করে, আর যে ক্ষুধার জ্বালায় বিনা আহ্বানে তাদের অন্ন খেয়ে ফেলে, চোর বলে তার দণ্ড বিধান করা হয়।
আহারাভাবে দরিদ্রদের উদর কৃশ, শরীরের অস্থিগুলি প্রকট, খেতে পায় না বলে অবিরাম আর্তনাদ করে। কালো চামড়া বলে ধনী শ্বেতাঙ্গ ইয়োরোপীয়রা এদেশের দরিদ্রদের ঘৃণা করে। এই পৃথিবীর মৎস্য মাংসে তাদের কিছু অধিকার আছে, ধনীরা খেতে না দিলেই চুরি করবে। দরিদ্রদের কালো চামড়া, শুষ্ক মুখ, ক্ষীণ সকরুণ আর্তনাদ শুনে কি ধনীদের দুঃখ হয় না, দরিদ্রের আহার সংগ্রহের দণ্ড আছে, কিন্তু ধনীর কৃপণতার দণ্ড নেই কেন? দরিদ্র তো চোর হয় ধনীর দোষেই, পাঁচশ’জন দরিদ্রকে বঞ্চিত করে একজন তাদের আহার্য সংগ্রহ করবে কেন, যদি করল তবে তার আহারের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা দরিদ্রকে কেন দেবে না? যদি না দেয় তবে দরিদ্র অবশ্যই তার কাছ থেকে চুরি করবে, কারণ, অনাহারে মরে থাকার জন্য এই পৃথিবীতে কেউ জন্মগ্রহণ করেনি।
কমলাকান্ত ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিরূপে বিড়ালের বক্তব্যের প্রতিবাদে যা বলে তা সমাজতন্ত্রের বিরোধীদের কণ্ঠে দীর্ঘকাল ধরেই উচ্চারিত হয়ে আসছে বিড়ালের এই কথাগুলি অত্যন্ত সোশিয়ালিস্টিক, সমাজ বিশৃঙ্খলার মূল; যদি যার যত ক্ষমতা, সে তত ধন সঞ্চয় করিতে না পারে, কিংবা সঞ্চয় করে চোরের জ্বালায় নির্বিঘ্নে ভোগ করতে না পায়, তবে কেউ আর ধন সঞ্চয়ে যত্নবান হবে না, তাতে সমাজের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি হবে না। কমলাকান্তের এই উক্তির প্রত্যুত্তরে বিড়াল শোষিত ও বঞ্চিত দরিদ্র সর্বহারা শ্রেণির জীবন ও মৌলিক মানবিক অধিকারের সত্যই প্রকাশ করে; সমাজের ধন বৃদ্ধির অর্থ ধনীদের ধন বৃদ্ধি, ধনীর ধন বৃদ্ধি না হলে দরিদ্রের কী ক্ষতি। কমলাকান্ত আবার ধনতন্ত্রের তথা ধনীদের ঐশ্বর্য সংগ্রহের অবাধ অধিকার সম্পর্কে বহুল উচ্চারিত যুক্তির পুনরাবৃত্তি করে সামাজিক ধনবৃদ্ধি ছাড়া সমাজের উন্নতি হয় না। বিড়াল তার উত্তরে যে কথা বলে, তাতে দরিদ্রদের সমাজে বেঁচে থাকার অধিকার সম্পর্কে চরম সত্যটিকেই আমরা উচ্চারিত হতে শুনি : সে যদি খেতেই না পেল, তবে সমাজের উন্নতি নিয়ে কী করবে। বিড়ালের এই বক্তব্য শুনে কমলাকান্ত ধনতন্ত্রের সমর্থনে একটি অসার যুক্তি দেয় : সমাজের উন্নতিতে দরিদ্রের প্রয়োজন না থাকতে পারে, কিন্তু ধনীদের বিশেষ প্রয়োজন আছে; সুতরাং চোরের দণ্ডবিধান কর্তব্য। বিড়াল তার উত্তরে বলে, কমলাকান্ত চোরকে ফাঁসি দিক, তাতেও তার আপত্তি নেই কিন্তু তার সঙ্গে তাকে আর একটি নিয়ম করতে হবে। চোরকে দণ্ডদানের আগে তার বিচারককে তিন দিন উপবাসী থাকতে হবে, তাতে যদি তাঁর চুরি করে খেতে ইচ্ছা না হয় তবে তিনি চোরকে ফাঁসি দেবেন। কমলাকান্ত তাকে মারার জন্য লাঠি তুলেছিল, সে আজ থেকে তিন দিন উপবাস করে দেখুক, সে যদি এর মধ্যে নসীরাম বাবুর ভাঁড়ার ঘরে ধরা না পড়ে, তবে তাকে যেন ঠেঙিয়ে মারে, সে আপত্তি করবে না।
বিড়ালের সমাজতন্ত্র তথা দরিদ্রদের ক্ষুধা দূর করে বেঁচে থাকার প্রাথমিক অধিকারের অকাট্য যুক্তির কাছে পরাজিত হয়ে কমলাকান্ত বিজ্ঞোচিত গভীর ভঙ্গীতে এই উপদেশ দিয়েছে, এ সমস্ত অত্যন্ত নীতিবিরুদ্ধ কথা, তাদের আন্দোলনেও পাপ আছে, এই সমস্ত দুশ্চিন্তা ত্যাগ করে বিড়াল যেন ধর্মাচরণে মন দেয়। ধনী শ্রেণির প্রতিনিধি কমলাকান্তের এই পরাজয়ে দরিদ্র শ্রেণির প্রবক্তা বিড়ালের বক্তব্য তথা সমাজতন্ত্রের মূল বক্তব্যই সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর অন্যান্য প্রবন্ধের মতোই ‘বিড়াল’ও রচনা সাহিত্যের অন্যতম রসোজ্জ্বল উদাহরণ। কমলাকান্তের আফিমের নেশাঘটিত ওয়াটার্লুর রণক্ষেত্রে নেপোলিয়নের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অভিনব রণকৌশলে ডিউক অব ওয়েলিংটনকে পরাজিত করার সম্ভাবনার হাস্যকর কল্পনায়, তার জন্য রক্ষিত দুগ্ধপানে পরিতৃপ্ত একটি বিড়ালকে সাম্যবাদের প্রবক্তারূপে সমাজের শোষিত দরিদ্র শ্রেণির ক্ষুধার জ্বালা এবং বেঁচে থাকার জন্মগত অধিকার সম্পর্কে ভাষণ এবং ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিরূপে কমলাকান্তের বিড়ালের বক্তব্য খণ্ডনের ব্যর্থ প্রয়াস—এই কল্পনায়, কৌতুক-পরিহাস ও মননশীলতার মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র যেভাবে সমাজতন্ত্রের মূল সত্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তা সত্যই মনোজ্ঞ, অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক।
কমলাকান্ত যখন তার আফিমের নেশার ঘোরে ওয়াটার্লুর রণক্ষেত্রে যুদ্ধজয়ের কল্পনায় বিভোর হয়েছিল, তখন একটি মেও শব্দ হতেই তার মনে হয়, ওয়েলিংটন বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হয়ে তার কাছে আফিম ভিক্ষা করতে এসেছে। সে পাষাণবৎ কঠিন হয়ে বলবে বলে মনে করল যে ডিউক মহাশয়কে ইতিপূর্বে যথোচিত পুরস্কার দেওয়া গেছে, এখন আর অতিরিক্ত পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে না। বিশেষত অপরিমিত লোভ ভালো নয়। নিজেকে বিজয়ী নেপোলিয়ন এবং তার চরণতলে বিড়ালরূপী ওয়েলিংটনের আফিম ভিক্ষা–কমলাকান্তের এই আত্মপ্রসাদস্ফীতি কল্পনা অত্যন্ত কৌতুকাবহ সন্দেহ নেই। আফিমের নেশার ঘোর কিছুটা কেটে যাবার পর সে বুঝতে পারে, ডিউক অব ওয়েলিংটন নয়, একটি বিড়াল, প্রসন্ন তার জন্য যে দুধ রেখে গিয়েছিল, পান করে নিজের তৃপ্তি প্রকাশ করার জন্যই মধুর স্বরে মেও বলে ডেকেছে। কমলাকান্ত নিজের মনে বিচার করে দেখে এই সত্য স্বীকার করে, দুধ তার বাপের নয়, মঙ্গলার, দুইয়েছে প্রসন্ন, সে দুধে তার যে অধিকার বিড়ালেরও তাই; সুতরাং যুক্তির দিক থেকে সে রাগ করতে পারে না। তবে চিরাচরিত একটি প্রথা আছে যে বিড়াল দুধ খেয়ে গেলে তাকে মারতে যেতে হয়, সেই প্রথার অবমাননা করে কমলাকান্ত মানব সমাজে কুলাঙ্গাররূপে পরিচিত হবে এটা বাঞ্ছনীয় নয়। এই মার্জারীও তার স্বজাতিমণ্ডলে কমলাকান্তকে কাপুরুষ বলে উপহাস করতে পারে। সুতরাং পুরুষের ন্যায় আচরণ করাই উচিত। এই স্থির করে, সকাতরচিত্তে হাত থেকে হুঁকো নামিয়ে অনেক অনুসন্ধানে একটা ভাঙ্গা লাঠি আবিষ্কার করে সে সগর্বে বিড়ালের প্রতি ধাবমান হয়েছে। কমলাকান্তের পৌরুষের এই আড়ম্বরপূর্ণ প্রদর্শনী মনকে হাস্যরসে প্লাবিত করে।
পরিহাস-কৌতুকে এই ভূমিকা রচনার পরই কমলাকান্ত তার আফিমের নেশার দৌলতেই বিড়ালকে সাম্যবাদের প্রবক্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শোষিত ও বঞ্চিত দরিদ্র সর্বহারা শ্রেণির মর্মজ্বালাকে ব্যক্ত করতে শুনেছে। বিড়াল যখন বলে, সে সাধ করে চোর হয়নি; খেতে পেলে কে চোর হয়, চোরের চুরি রূপ অধর্মের জন্য কৃপণ ধনীই দায়ী, পাঁচশ’ দরিদ্রকে বঞ্চিত করে একজন পাঁচশ লোকের আহার্য কেন সংগ্রহ করবে, যদি করে তবে সে তার আহারের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তা দরিদ্রকে কেন দেবে না, যদি না দেয়, তবে দরিদ্র অবশ্যই তার কাছ থেকে চুরি করবে, কারণ অনাহারে মরে যাওয়ার জন্য কেউ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেনি তখন আমরা তীক্ষ্ণ মননশীলতায়ই শুধু নয়, সর্বহারা দরিদ্র শ্রেণির প্রতি লেখকের গভীর সহানুভূতির আবেগে ও সমাজতন্ত্রের মূল সত্যকে, দরিদ্র শ্রেণির মানুষদের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত মানবিক প্রত্যয়কে প্রকাশিত হতে দেখি। কমলাকান্তের কল্পনার সূত্রেই আমরা রচনাটির ভূমিকা অংশের কৌতুক পরিহাসরস থেকে সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত এই আলোচনার মননশীলতা ও হৃদয়াবেগের অংশে পৌঁছে যাই, কোথাও কোন অসঙ্গতি অনুভব করি না।
কোনো ব্যক্তি যদি তার ক্ষমতা অনুযায়ী ধন সঞ্চয় করতে অথবা ধন সঞ্চয় করে চোরের জ্বালায় ভোগ করতে না পারে, তবে কেউ আর ধন সঞ্চয়ে যত্নবান হবে না, তার ফলে সমাজের ধন বৃদ্ধি হবে না ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিরূপে এই অত্যন্ত দুর্বল ও অক্ষম যুক্তিতে বিড়ালের সমাজতন্ত্রের বক্তব্য খণ্ডন করতে গিয়ে কমলাকান্ত তার কাছে পরাজিত হয়েছে। বিচারে পরাজিত হলে গভীরভাবে উপদেশ দান করবে, বিজ্ঞ লোকের এই মত অনুযায়ী সে বিড়ালকে বলেছে, এ সমস্ত অত্যন্ত নীতিবিরুদ্ধ কথা, তার আন্দোলনেও পাপ আছে; সে যেন এই সমস্ত দুশ্চিন্তা ত্যাগ করে ধর্ম আচরণে মন দেয়। কমলাকান্ত তার জ্ঞানোদয়ের জন্য নিউম্যান ও পার্কারের গ্রন্থ দিতে পারে, আর ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ পড়লেও তার কিছু উপকার হতে পারে। আর কিছু না হোক সে আফিমের অসীম মহিমা বুঝতে পারবে। প্রসন্ন কাল কিছু ছানা দেবে বলেছে, জলযোগের সময় দুজনে ভাগ করে খাবে। আজ বিড়াল যেন কারো না হাঁড়ি খায়, ক্ষুধায় নিতান্ত অস্থির হলে আবার যেন আসে, তাকে সে এক সরিষাভোর আফিম দেবে। আফিম বিশেষ প্রয়োজন নেই, তবে হাঁড়ি খাওয়ার কথা ক্ষুধা অনুসারে বিবেচনা করা যাবে—একথা বলে বিড়াল বিদায় গ্রহণ করে, একটি পতিত আত্মাকে অন্ধকার থেকে আলোকে এনেছে ভেবে কমলাকান্তও অত্যন্ত পুলকিত হয়। উপসংহারের এই কৌতুকরসও নিঃসন্দেহে উপভোগ্য, বিড়ালের সমাজতন্ত্র-সম্পর্কিত বক্তব্য যে অখণ্ডনীয়, কমলাকান্তের এই আত্মপ্রসাদের হাস্যরসের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র তারই ইংগিত দিয়েছেন।
এই অভিনব রচনাভঙ্গির জন্যই ‘বিড়ালে’র বক্তব্য বিষয় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের হৃদয়মনকে আকৃষ্ট করে রাখে।