ইংরেজিতে জীবনী সাহিত্য সম্পর্কে দুটি শব্দের প্রচলন দেখা যায়- 1. Hagiography বাংলায় যাকে বলা হয় জীবনী চরিত অর্থাৎ সাধুসন্ত বা কোনো দেবলোকের বাসিন্দাকে নিয়ে যে জীবনী রচিত হয়। 2. Biography বাংলায় জীবনী সাহিত্য, যা সাধারণের মধ্যে কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির জীবনাদর্শকে পরিস্ফুট করার জন্য রচিত।
বাংলা সাহিত্যে এই জীবনী সাহিত্যের আবির্ভাব ঘটেছিল মূলত মধ্যযুগে চৈতন্যের আবির্ভাবের পর। একমাত্র এই চৈতন্যদেবের ওপর নির্ভর করে যে সমস্ত পদকার বা কবিগণ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সেগুলিকে চৈতন্য জীবনী কাব্যরূপে আখ্যাত করা হয়েছিল। তবে চৈতন্যদেবের এই জীবনী কাব্যগুলি তাঁর জীবনচরিত গ্রন্থ হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। আর জীবনী সাহিত্য নামে যে শব্দটি প্রচলিত আছে তা সাম্প্রতিককালে সৃষ্টি। যার মূল বর্ণিতব্য বিষয় হল কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির কর্মাদর্শকে তুলে ধরা, কোনো রকম দৈবাধীন হয়ে নয় একেবারে নিস্পৃহ চিত্তে। এখন প্রশ্ন হল জীবনচরিত এবং জীবনী সাহিত্যের মূল লক্ষ্য যদি হয়ে থাকে জীবনের কর্মাদর্শকে তুলে ধরা তাহলে উভয়ের মধ্যে ব্যবধানটা কোথায়?
মধ্যযুগে ‘কড়চা’ নামে সাধু সত্তদের জীবনী নিয়ে যে সমস্ত গ্রন্থগুলি রচিত হয়েছিল। তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মহাকালের হাত থেকে ধর্ম, কর্ম, আদর্শ ইত্যাদিকে রক্ষা করার জন্যে তাকে গ্রন্থাকারে চিরস্থায়ী করা।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ভাষায়—“জীবন বৃত্তান্ত বা ঐতিহাসিক ঘটনাদির বিষয় যাতে রক্ষিত হয় বা ওইসকল বিবরণ ধ্বংস হতে রক্ষা করবার জন্য যাতে লিখিত হয়।” কিন্তু সাম্প্রতিককালের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে নিয়ে জীবনী সাহিত্য রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল কোনও মহৎ ব্যক্তি জীবনীকে লেখনীর দ্বারা এমনভাবে প্রকাশ করা যার দ্বারা সাধারণ মানুষ নব উদ্দীপনায় উজ্জীবিত হয়। তবে চরিত গ্রন্থ তথ্য সহযোগে রচনা শেষ করলে কোনো সমস্যা থাকে না। সে তুলনায় জীবনী সাহিত্য রচনা করতে গেলে খুব সতর্কভাবে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ—
১। বিশিষ্ট ব্যক্তিটির জীবনী অত্যন্ত সততার সঙ্গে রচনা করতে হবে। কোনো মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া চলবে না।
২। জীবনী যেহেতু সাহিত্য রূপে পরিচিতি পেয়েছে তাই এর মধ্যে সাহিত্য রস থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। কেবলমাত্র জীবনীপঞ্জী হলে চলবে না। স্ট্র্যাচির ভাষায় “A mass of notes and documents is no more a biography than a mountain of eggs is an omelette.”
৩। জীবিত বা মৃত ব্যক্তি যাকেই নিয়ে জীবনী সাহিত্য রচনা করা হোক না কেন, তা যেন সযত্নে লালিত হয়, কোনোরূপ মিথ্যার আশ্রয় নিলে-উদ্দিষ্ট ব্যক্তির ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে।
৪। একটি জীবনকে যথাযথ ভাবে পরিস্ফুট করা সম্ভব পারিপার্শ্বিক অন্যান্য সঙ্গী সাথীদের আলাপচারিতার দ্বারা। কাজেই সহকারী যে সমস্ত ব্যক্তিদের পরিচয় দেওয়া হবে সেগুলিও যেন সত্যের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, নইলে তা বিফলে পর্যবসিত হবে।
৫। অনেক সময় উদ্দিষ্ট জীবনীর মধ্য দিয়ে কোনো ন্যায় নীতি আদর্শ লেখক প্রকাশ করে থাকেন, তবে সেখানে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। দেখতে হবে ব্যবহৃত, ন্যায় নীতি, আদর্শ আলোচ্য ব্যক্তির পরিপন্থী কিনা।
যদিও ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি, জীবনী সাহিত্য সাম্প্রতিককালের রচনা তবুও নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে সার্থকতম জীবনী সাহিত্য বাংলায় আজও রচিত হয়েছে বলে মনে হয় না। তবু অসংখ্য জীবনীকারদের সযত্নে রচিত জীবনী সাহিত্য এমন ভাবে বাংলা সাহিত্যকে সমাদৃত করেছে তাতে বিস্মৃত না হয়ে পারা যায় না। বাংলা গদ্য সাহিত্যে বোধহয় জীবনী সাহিত্যের সর্বপ্রথম পদচারণা শুরু হয় ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর। এই কলেজের অধ্যাপক মুন্সীরাম বসু কর্তৃক রচিত ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ গ্রন্থটি আধুনিক জীবনী সাহিত্যের আদি নিদর্শন রূপে গ্রহণ করা যেতে পারে। এর পর বহু লেখক রাজা প্রতাপাদিত্যকে নিয়ে জীবনী সাহিত্য রচনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, যেমন প্রতাপচন্দ্র ঘোষের ‘বঙ্গধিপ পরাজয়’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ ইত্যাদি। এর পর যিনি জীবনী সাহিত্য রচনা কৃতিত্ব রেখে গেছেন তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তিনি কবিওয়ালাদের জীবনী বা ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের জীবনী রচনা করে আমাদের সম্মুখে বহু অজানা তথ্য হাজির করেছিলেন।
অতঃপর যত দিন যেতে লাগল বাংলা জীবনী সাহিত্য তত সমৃদ্ধ হতে শুরু করল। রচনাকাররা প্রবল উৎসাহে একে একে নতুন জীবনী সাহিত্য রচনা করে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করতে থাকেন। আজ পর্যন্ত জীবনী সাহিত্যের প্রণেতা রূপে ভাস্বর হয়ে আছে তাদের মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকজন হলেন- অজিত কুমার চক্রবর্তীর-‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর’। নগেন্দ্রনাথ সোমের ‘মধু স্মৃতি’। যোগীন্দ্রনাথ বসুর ‘মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত’। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রামমোহন রায়’, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিদ্যাসাগর চরিত’। সাম্প্রতিক কালে শুধুমাত্র জীবনী সাহিত্যের প্রবল আলোড়ন ওঠেনি সঙ্গে সঙ্গে সম্ভ জীবনীকে অবলম্বন করে চরিত গ্রন্থ রচনা দ্বারা কয়েকজন বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। এদের মধ্যে যাদের নাম সর্বাগ্রে মনে আসে তা হল-শিশির কুমার ঘোষের—’অমিয় নিমাই চরিত’ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের-‘পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ’, ‘পরমাপ্রকৃতি সারদামণি’ ও ‘বীরেশ্বর বিবেকানন্দ’, এছাড়া ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সাহিত্য সাধক চরিত মালার? প্রত্যেকটি অংশ এই গোত্রের বিশিষ্ট অঙ্গ।
যাইহোক, জীবনী সাহিত্যের দ্বারা আধুনিককালের আদর্শবাদী মানুষজনের সঠিক স্বরূপ উদ্ঘাটিত হলেও এর দ্বারা সবসময় যে সত্য প্রকাশ পায় তা কখনোই নয়। অনেক সময় রচনাকার তার কল্পনা শক্তির দ্বারা বিশেষ ব্যক্তির জীবনীকে অতিরঞ্জিতভাবে ফুটিয়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, তার জন্য আসল বিষয়টি ঢাকা পড়ে গিয়ে অসার বিষয়কে নিয়ে পাঠক চিত্ত আনন্দ উপভোগ করতে থাকে। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছেন-“এদেশ কর্তা ভজার দেশ। এখানে অসাধারণ শক্তি সম্পন্ন মানুষ পেলেই অল্পদিনের মধ্যেই তাকে আমরা অতিমানব বানিয়ে তুলি, ফলে বিবিধ ত্রুটি ও যেসব মানবিক দুর্বলতার পরিচয়ে একটি মানুষ রক্ত-মাংসের সজীব মানুষ হয়ে উঠতে পারেন সেই দুর্বলতা ত্রুটির পরিচয় জীবনী লেখক দিতে পারেন না। ফলে পাশ্চাত্য জীবনী সাহিত্যের সঙ্গে এ দেশের জীবনী সাহিত্যের পার্থক্য ফুটে ওঠে। তবে স্বীকার করতেই হয় পাঠকের দুর্বল মানসিকতার জন্যেই অনেক সময় জীবন সাহিত্যের আদর্শ বিফলে পর্যবসিত হয়।