বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের ইতিহাসে গোপাল হালদার বিরল স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী । বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের প্রচলিত ধারা ছেড়ে গোপাল হালদার ভিন্নতর মননে ও মেজাজে সাহিত্যের আলোচনা করেছেন। এসব ক্ষেত্রে তাঁর দূরদর্শী প্রতিভা ও বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি নানান স্তর বিভাজনের মধ্য দিয়ে রূপায়িত হয়েছে। তাঁর ‘আধুনিক সাহিত্য’ নামক প্রবন্ধটিও এমনতর বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়েছে। এই প্রবন্ধে গোপাল হালদার আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর ধ্যান-ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন, সেই সূত্রে আধুনিক সাহিত্যের সংজ্ঞা স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্যের সুনির্দিষ্ট উন্মোচন ঘটিয়েছেন। আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে গোপাল হালদারের বক্তব্য এখানে ত্রিবিধ স্তর পরম্পরায় প্রকাশিত হয়েছে। যেমন :
১. প্রথম পর্ব—এই পর্যায়ে গোপাল হালদার আধুনিক সাহিত্যের স্বরূপ উদ্ঘাটনে ব্রতী হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি সাহিত্যের ঐতিহাসিক বিচারে প্রবৃত্ত হয়ে সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ও পরিবর্তনশীল সমাজ সত্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এই পরিবর্তনশীলতাকেই আধুনিক সাহিত্যের ভিত্তি বলে চিহ্নিত করেছেন।
২. দ্বিতীয় পর্ব—এই পর্বে আধুনিক সাহিত্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রাবন্ধিক আলোচনা করেছেন। এখানে মানুষকেই সাহিত্যের কেন্দ্রীয় আধার বলে লেখক মন্তব্য করেছেন। মানুষের জীবন আধুনিক সাহিত্যে শুধুমাত্র কথাবস্তু রূপে না থেকে ভাববস্তু রূপে গৃহীত হয়েছে।
৩. তৃতীয় পর্ব—এই পর্যায়ে প্রাচীন সাহিত্যে ব্যবহৃত মানুষ ও মানবতার সঙ্গে আধুনিক সাহিত্যে ব্যবহৃত মানুষ ও মানবতার পার্থক্য নির্ধারণে প্রবৃত্ত হয়ে প্রাবন্ধিক আধুনিক সাহিত্যের স্বরূপটিকে উদ্ঘাটিত করেছেন।
প্রাবন্ধিক গোপাল হালদার তাঁর ‘আধুনিক সাহিত্য’ প্রবন্ধে সর্বপ্রথম আধুনিক সাহিত্যের কাল ও স্বরূপ বিচারে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এই বিচারে বসে তিনি যুগ ধর্মের ওপর গুরত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে প্রত্যেক সাহিত্যের গায়ে ‘জন্মচিহ্ন’ লেগে থাকে। এই জন্মচিহ্ন দিয়ে সাহিত্যের কাল মাপা যায়। এই জন্মচিহ্ন হল যুগধর্ম—পরিবেশ ধর্ম। প্রাবন্ধিকের মতে এই যুগধর্মের পার্থক্যের সূত্রেই সাহিত্যে আধুনিকতা এসেছে। ব্যাপারটিকে একটি উদাহরণের সাহায্যে প্রাবন্ধিক সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন :
রামায়ণের আদর্শ চরিত্র রামচন্দ্রের জীবনের একটি ঘটনাকে এখানে উদ্ধার করা যায়। রাজত্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে রামচন্দ্র তার কারণ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়ে সিদ্ধান্ত করলেন শম্বুক নামক এক শূদ্রের বেদপাঠ দুর্ভিক্ষের কারণ। প্রজানুরঞ্জক রাজা সঙ্গে সঙ্গে শম্বুককে হত্যা করে তার বিহিত করলেন। এটা সে যুগের যুগধর্মে মানিয়েছিল বেশ। কিন্তু একালের দৃষ্টিতে এর জন্য রামচন্দ্রকে প্রচুর নিন্দাবাক্য কুড়াতে হয়েছে।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যুগধর্মের প্রভাবের ফলেই সাহিত্য তার পুরাতন মূল্যবোধকে খুলে ফেলে আধুনিকতায় উত্তরিত হয়েছে। কর্ণ ও কুম্ভীর সাক্ষাৎ ঠিক একই রকম ভাবে বেদব্যাসের মহাভারতে এবং রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’—এ ঘটেছে। কিন্তু কালের বিস্তর ব্যবধানে ও যুগধর্মের প্রভাবে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য আধুনিক হতে পেরেছে।
আধুনিকতার এমন সংজ্ঞার্থ নির্ধারণের পর প্রাবন্ধিক আধুনিক সাহিত্যের বিষয়বস্তুর আলোচনায় নিমগ্ন হয়েছেন। এখানে তিনি স্পষ্ট করেই মানুষের প্রাধান্যের কথা বলেছেন : “আধুনিক সাহিত্য মানুষের সাহিত্য—এই হল আধুনিক সাহিত্যের সম্বন্ধে প্রধান কথা। মানব সত্য নিয়েই আধুনিক সাহিত্য”।
আসলে মানুষের ব্যক্তিত্বের মূল্যকেই আধুনিক সাহিত্য গুরুত্ব দিয়েছে বলেই লেখকের অভিমত, পুরানো সাহিত্যের তুলনায় আধুনিক সাহিত্যে ব্যক্তি স্বরূপের দাবি বড়ো হয়ে উঠেছে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিগত মননশীলতার মূল্য এ সাহিত্যে অনেক বেশি। এখানে প্রাবন্ধিক রামায়ণের পত্নীত্যাগী রাম ও শেকসপিয়রের সিংহাসনত্যাগী উইন্ডসর-এর উদাহরণ এনেছেন। প্রথম জন সিংহাসন ও সমাজের দাবির কাছে প্রেমকে বলি দিয়েছেন— পত্নীকে ত্যাগ করেছেন। দ্বিতীয়জন সিংহাসন ত্যাগ করে পত্নীকে গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তি মূল্যের এই পরিবর্তনকেই প্রাবন্ধিক গোপাল হালদার আধুনিক সাহিত্যের বিষয়বস্তুর কেন্দ্রবিন্দু ধরেছেন।
এই সূত্রে প্রাচীন সাহিত্যের সঙ্গে আধুনিক সাহিত্যের মানবতাদের তুলনামূলক আলোচনায় নিমগ্ন হয়েছেন প্রাবন্ধিক। কেন না, প্রাচীন সাহিত্যেও মানুষ ছিল। তীক্ষ্ণ যুক্তি ও বিশ্লেষণধর্মিতার সাহায্যে গোপাল হালদার বলেছেন সে যুগের মানুষ ছিল অধ্যাত্মাশ্রিত। সমাজে মানুষের সম মর্যাদা ছিল না। একালের মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই মর্যাদায় ভূষিত। এইখানেই গোপাল হালদার মূল্যবোধের পরিবর্তনের প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। নতুন মূল্যবোধে মানুষের উত্তরণ-ই সাহিত্যে আধুনিকতার মর্মকথা এমন বিশ্বাসে প্রাবন্ধিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তাঁর মন্তব্য : “অন্তত তিনটি প্রধান দিকে মানুষের মূল্যবোধ আজ নতুন——প্রথমত, মানুষের মর্যাদাবোধ, দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিসত্তার মুক্তি, আর মানুষের বিপ্লবী নিয়তিতে বিশ্বাস।”
—প্রাবন্ধিকের মতে প্রাচীনকালেও মানবিকবোধ ছিল তা আধ্যাত্মিক মানবিকতাবোধ। আর একালে মানবিকতাবোধের পরিবর্তে এল মানবতাবাদ। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন ও বঙ্কিম এই মানবতাবাদ ও মানবিক অধিকারের আনয়ন করে আধুনিকতার প্রবর্তন করেছিলেন। গোপাল হালদারের মতে এমনটি ঘটতে পেরেছে সামাজিক পরিবর্তনশীলতার মানদণ্ডের জন্যই। এখানে ইতিহাসের বিশ্লেষণ করে প্রাবন্ধিক আধুনিকতার ক্রমবিকাশ ও স্বরূপকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে ইতিহাসের তিনটি বড়ো রকমের সমুখানের মধ্য দিয়ে আধুনিকতার সূচনা ও বিকাশ ঘটেছে। লেখকের মতে—ইউরোপীয় রেনেসাঁস উদ্বোধন ঘটেছে মানুষের মহিমাবোধের, ফরাসি বিপ্লবে ঘটেছে মানুষের অধিকারের ব্যক্তিগত ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা, আর সোভিয়েত বিপ্লবে ঘটেছে মানুষের বিপ্লবী যাত্রার সূচনা।
মানুষের এই স্বীকৃতি, এই মানবসত্য ব্যক্তি মহিমার ও জাতীয় স্বাধীনতার এই প্রত্যয়ী প্রতিষ্ঠা সাহিত্যে আধুনিকতা এনেছে। সমাজ, সমাজের মানুষ তাদের পরিবর্তনশীলতা ও মূল্যবোধের রূপান্তরের ইতিহাসকে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের আধুনিকতার এই যে স্বরূপটি গোপাল হালদার উন্মোচিত করেছেন তা স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ও যুক্তিযুক্ত।