রোমান্টিক কবিদের প্রথম প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত হলেন ওয়ার্ডস ওয়ার্থ, কোলরিজ এবং সাঁদে। এঁদের মধ্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ হলেন সর্বপ্রধান, অর্থাৎ রোমান্টিক কাব্য আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ কবি ব্যক্তিত্ব হলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ। রোমান্টিক সাহিত্য পর্ব অনেক সময়ই ‘ওয়ার্ডস ওয়ার্থের যুগ’ বলে অভিহিত হয়ে থাকে। তাঁর জন্ম ১৭৭০-এর ৭ এপ্রিল কাম্বারল্যান্ডের ককারমাউথে। শৈশবে গ্রামের স্কুলে তিনি স্বপ্নভাবাতুর। তাঁর নিসর্গ প্রেম ও দর্শনের বীজ স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দাভিজ্ঞতার দ্বারা উদ্ভূত। এই স্বতঃস্ফূর্ততার মাঝে আবির্ভূত হত অপরিসীম আনন্দের অবিস্মরণীয় মুহূর্তগুলি যখন বস্তুপৃথিবী অকস্মাৎ এক অপার্থিব স্বপ্নলোকের রূপ পরিগ্রহ করত প্রথম কোকিলের কুহুতান শুনে ; কিংবা নক্ষত্রখচিত আকাশের নীচে নৌকা বেয়ে যাওয়ার সময় সুউচ্চ পর্বতশীর্ষ যখন বিপুল গাম্ভীর্যে তাঁর পাশ দিয়ে সরে যেত। ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রকৃতি বিষয়ক পুরাণ নির্মাণের শুরু তার দশ বছর বয়সেই। ক্রমে এই আনন্দানুভূতির সঙ্গে যুক্ত হল সূক্ষ্মতার ও গভীরতর এক সংবেদনশীলতা। এইভাবেই বিকশিত হতে থাকল এক বিশিষ্ট স্বজ্ঞা (in tuition) যা ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্যের নিজস্ব ধন।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ১৭৯৮ থেকে ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই দশ বছরেই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা রচনা করেন। ১৭৯৮ খ্রি. কোলরীজ এর সহযোগিতায় ‘The Lyrical Ballads’ প্রকাশিত হয়। মূলত এখান থেকেই রোমান্টিক যুগের সূচনা। তারপর প্রকাশ পায় The Prelude, The Recluse, The Excursion Prelude-এ তিনি কী করে বাল্যকাল থেকে প্রকৃতিকে ভালোবেসেছিলেন তার নিখুঁত বর্ণনা পাই, কখনো প্রকৃতি কঠোর শিক্ষক, কখনো বা কোমল। The Excursion গ্রন্থটি ছিল তাঁর পরিকল্পিত বিপুলায়তন দর্শন গ্রন্থ। এছাড়া একে একে প্রকাশিত হতে থাকল We are Seven, The Thorn, The Idiot Boy, Simon Lee নামক বিভিন্ন প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা। তাঁর প্রকৃতি বিষয়ক দর্শন বিশ্বাসের অসামান্য কবিতা হল Tintern Abbey । ব্যালাড বলতে যে ধরনের সহজ সাবলীল গাথা কবিতা বোঝায় সেই জাতীয় বিষয়গত ও নাটকীয়তার প্রসাদগুণের সমৃদ্ধ গাথা রচনায় ওয়ার্ডস ওয়ার্থের সহজাত দক্ষতার পরিচয় মেলে এইসকল গীতি কবিতায়।
১৭৯৯ খ্রি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের লুসি (Lucy)-কে নিয়ে বহু পঠিত অনবদ্য কবিতাগুলি লেখেন। লুসি এক সাধারণ নিসর্গ কন্যা যাকে একগুচ্ছ অসাধারণ কবিতায় অমরত্ব দান করেছেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ। শান্ত, নির্জন প্রকৃতির কোলে লুসির বাস। কোলাহলের বাইরে, জনবিরল পথের পাশে সে ছিল সহজাত, অনাঘ্রাতা ফুলের মতো। সেই লুসি মৃত এবং সকলের অগোচরে করবে শায়িতা, তার কুঁড়ে ক্রীড়াকুঞ্জ, বাল্যলীলার অসংখ্য স্মৃতি এখন কবিমনকে আর্দ্র করে তোলে। The Solitary Reaper কবিতাটি পার্বত্য ভূমির শস্যখেতে একাকী কর্মরত এক কৃষক বালিকার মধুর গানে মুগ্ধ কবি চলে যাওয়ার সময়ও তাঁর হৃদয়ে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে গানের মূৰ্চ্ছনা, ১৮০২-এর সেপ্টেম্বরে ফ্রান্স যাত্রাকালে রচিত তাঁর চতুর্দশপদী কবিতা ‘Upon Westminster Bridge’ কাব্য দক্ষতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নবোদিত সূর্যের আলোকে উজ্জ্বল প্রাতঃকালীন লন্ডন শহরের বিশাল ও মুক্ত অস্তিত্বের কেন্দ্রে কবি অনুভব করেছিলেন এক গভীর প্রশান্তি।
স্কটল্যান্ডের Yarrow (ইয়ারো) নদী ও তার সন্নিহিত নিসর্গ প্রকৃতি সন্দর্শন ওয়ার্ডস ওয়ার্থের তিনটি কবিতার বিষয়, এবং কবিতাগুলি রোমান্টিক কাব্যভাণ্ডারের স্থায়ী সম্পদ- Yarrow unvisited (1803) Yarrow visited (1814) এবং Yarrow Revis ited (1831) ভগ্নী ডরোথীকে নিয়ে প্রথম স্কটল্যান্ড ভ্রমণকালে ইয়ারো দেখা হয়নি কবির, বলামায় প্রকৃত এই নদীর রূপ দেখা থেকে নিজেকে ও ডরোথীকে নিরস্ত করেছেন। পাছে ইয়ারোর দর্শন পেলেই তাঁদের মানসপটে চিত্রিত এই আশ্চর্য নদীর আদর্শ ছবিটি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, হালকা পরিহাসের ভঙ্গিতে লেখা এই কবিতা। অনেক বছরের ব্যবধানে রচিত Yarrow visited-এ চপলতা ও সরলতার বদলে পাওয়া যায় ধ্যান গাম্ভীর্য ও উপলব্ধির গভীরতা, তাঁর কল্পনার ইয়ারো মতো সুন্দর নয় প্রকৃত ইয়ারো। এরও বহু বছর পরে ইয়ারো পুনভ্রমণকালে ওয়ার্ডস ওয়ার্থ এই শান্ত সুন্দর নদীকে বর্ণনা করলেন ভবিষ্যৎ কবিকে প্রেরণাদাত্রী রূপে, Yarrow Revisited কবিকল্পনা ও নদী নিসর্গের পারস্পরিক সম্পর্ক বিবর্তনের একটি সুদীর্ঘ সময় পর্বকে এইভাবে পরিণতি দিল।
কাব্যিক বৈশিষ্ট্য :
(১) সার্থকতা ও সীমাবদ্ধতা : আনন্দ ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্য সাধনার সম্পর্ককে তিনি যেভাবে আবেগের তীব্রতা ও মনণের গভীরতায় অভিব্যক্তি দিয়েছেন তা ইংরাজি কাব্য সাহিত্যে আশা রহিত। তবুও ম্যাথু আর্নল্ডের সঙ্গে একমত হয়ে বলা যায় ১৮০৮-এর পর থেকে ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রতিভা সূর্য অস্তগামী। কবি হিসাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল যেমন—সরসতার অভাব, নাটকীয় উপদানের অভাব, কাহিনি বিন্যাসে ও কথনে দক্ষতার অভাব ইত্যাদি। কিন্তু এ সব কিছু ছাপিয়ে ওঠে গীতি কবিরূপে তাঁর অসামান্যতা, প্রকৃতিপ্রেম তথা প্রকৃতি ও মানুষ বিষয়ক দর্শনচিন্তা, অনন্য আত্মগরিমা এবং কাব্যশৈলী ও রূপের ক্ষেত্রে তাঁর বিচিত্রমুখী প্রতিভা।
(২) প্রকৃতি ও মানুষ : সামগ্রিক বিচারে প্রকৃত প্রেমিক ও পূজারি ওয়ার্ডসওয়ার্থের পরমারাধ্যাই প্রকৃতি। প্রকৃতির বাহ্যিক আকর্ষণ নয়, তার আত্মিক শক্তিই কবির অন্বেষার লক্ষ্য। যদিও প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তিনি ইন্দ্রিয়াতীত অধ্যাত্মজগতে উপনীত হওয়ার মানসব্রতে ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁর সমস্ত রচনাতেই বৃষ্টিস্নাত অথবা রৌদ্রোজ্জ্বল মেঘাবৃত অথবা নক্ষত্রখচিত আকাশ-মাটি নদী সাগরের উন্মুক্ত, উদার সৌন্দর্যের নিবিড় পর্যবেক্ষণ বিশেষ মনোগ্রাহী। ফুলের বর্ণ ও ঘ্রাণ, পাখিদের কলকাকলী, রাখাল বালক ও কৃষক বালিকার লীলা চাপল্য ইত্যাদির চমকপ্রদ অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার জগৎ।
(৩) গীতিকবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ : গীতি কবিতা আত্মগত ভঙ্গিতে লেখা কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভবের প্রকাশ, সে কাজরূপের আত্মমগ্ন রোমান্টিক কবিমানস খুঁজে পেয়েছিল স্বাভাবিক স্মৃতি। ভাবগম্ভীরতা ও অধ্যাত্ম দর্শন ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্য কবিতাকে ধারণ করে রেখেছিল এবং সে কারণেই শেলীর গীতিময় উচ্ছ্বাস ওয়ার্ডসওয়ার্থের রচনায় ধরা পড়ে না, তবু নিসর্গ প্রকৃতির লীলাময়তা ও লাবণ্যে যেভাবে তাঁর ব্যক্তিত্বে স্পর্শে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তা গীতিকবিতাকে এক অনন্য মহিমাময়তায় উত্তীর্ণ করেছে।
(৪) মহিমময় অহমিকা : ওয়ার্ডসওয়ার্থের অহমিকা তথা আস্মিতবোধ অনন্য। জবাথী ও মেরীর সান্নিধ্যে এবং কোলরীজের সাহচর্যে এক একান্ত নিজস্ব বলয়ে গ্রহণ করেছিলেন অপরিসীম মর্যাদায় ও গুরুত্বে তাঁর সমস্ত রচনাতেই তিনি স্বয়ং উপস্থিত থেকেছেন সর্বাপেক্ষা জোরালোভাবে।
তাই বলতে হয়, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছিলেন প্রকৃতির পূজারি। অশৈশব প্রকৃতিই তাঁর কাছে দীপ হয়ে জ্বলে উঠেছে এবং সুর হয়ে বেজে উঠেছে। তাঁর প্রত্যেকটি কবিতায় প্রকৃতির উপর ঐকান্তিক বিশ্বাসের অভিব্যক্তি। প্রকৃতি, যুগপৎ, আশা, আনন্দ, ভয় এবং বিস্ময় উদ্রেক গাঁথা। করেছিল তাঁর জীবনে। তাইতো প্রকৃতিকে তিনি এমন নিবিড়ভাবে ভালোবাসতে পেরেছিলেন। প্রকৃতির কেন্দ্রে রয়েছে নরদেবতা, ঈশ্বর, প্রকৃতি এবং মানুষ একই সূত্রে এ ধারা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে প্রয়াসী হয়েছে তার যথাযথ রূপ কবিতায় সন্নিবেশিত করতে। এখানেই তাঁর সার্থকতা।