রবীন্দ্রনাথের লিরিকধর্মী ছোটোগল্প একরাত্রির পরিণতি ট্র্যাজিক তথা হতাশা ব্যঞ্জক। কাহিনিতে দেখি নায়কের সহচরী সুরবালা শৈশব থেকেই নায়কের ‘অবহেলার পাত্র’ হিসাবে গণ্য হয়ে এসেছে। সময় পরিবর্তিত হল। কৈশোর ও তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে নায়কের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রামীণ জীবনের ও সুরবালার পরিমণ্ডল অতিক্রম করে শহরাশ্রয়ী হয়ে উঠল। নায়ক তাদের গ্রামের গন্ডি পার হয়ে পিতামাতা, সর্বোপরি সুরবালার প্রভাবের গন্ডি অতিক্রম করে কলকাতায় এসে হাজির হল ও আরম্ভ করল বিদ্যালয়ের শিক্ষা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার বৃহৎ পরিসরে নায়কের দৃষ্টিকোণ পরিবর্তিত হল। সে দেশসেবায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিবেদন করে দিল ও নিজেদের কথামতো চাঁদার খাতা হাতে দরজায় দরজায় উপস্থিতি জোর কদমে শুরু হল।
নায়কের বয়স এখন আঠারো। পিতার হিসাবে বিবাহের বয়স প্রায় অতিক্রান্ত। সুরবালার সাথে স্থির হয় তার বিবাহের। কিন্তু নায়ক তখন দেশসেবার জন্য চাঁদা সংগ্রহে এতই ব্যস্ত যে বিবাহের ব্যাপার তার কাছে তুচ্ছতিতুচ্ছ মনে হল এবং সুরবালা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ল উকিল রামলোচনের সাথে। এতেও নায়কের অন্তরে কোনও হোলদোল উপস্থিত হল না। এরপরই শুরু নায়কের ভাগ্য বিপর্যয়। পিতার মৃত্যুতে লেখাপড়া সাঙ্গ হল। দেশসেবার চাইতে আপন পরিবারের অন্নসংস্থানের চিন্তা তাকে বেশি করে পেয়ে বসল। ফলে মফস্সলের স্কুলে একটি সেকেন্ড মাস্টারের চাকরি তাকে নিতে হল। এতদিন পর্যন্ত সুরবালার কোনও চিন্তা নায়কের মনে উদিত হয়নি। সুরবালার সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব নিজের হাতেই বাতিল করার পর তা ছিল নায়কের কাছে নেহাতই এক অতীতমাত্র। মগ্ন চৈতন্যে লুকিয়ে থাকা স্মৃতি সেদিন উন্মুক্ত হল যেদিন রামলোচনের বাড়ি নায়ক গিয়ে অনুভব করল সুরবালার চুড়ির টুংটাং, শাড়ির খসখস শব্দ ও মৃদু পদধ্বনি। অতর্কিতে নায়কের মনের ক্যানভ্যাসে নতুন করে ফুটে উঠল সুরবালার চিত্র। তখনই মনের কোণে কোথাও শুরু হল এক যন্ত্রণা যা ধীরে ধীরে হৃদয় বিদারক অসহ্য যন্ত্রণায় রূপ নিল। এ যন্ত্রণা নায়কের আপন কৃতকর্মের—আপন অবিমৃশ্যকারিতার। অবশেষে সে নিজেকে রামলোচনের সাথে তুলনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে সুরবালা তারই, তাকে বিবাহ করার কোনো অধিকারই রামলোচনের ছিল না। শৈশব স্মৃতির ওপরে তারুণ্যের চঞ্চলতা যে আবরণ টেনে দিয়েছিল মধ্যযৌবনের নিঃসঙ্গতায় সেই শৈশব স্মৃতি মগ্ন চৈতন্যের ভেতর থেকে আবার ফিরে এল। এর থেকে নায়কের মুক্তি নেই। মুক্তি হতও না, যদি না বিভীষিকাময়ী মৃত্যু প্লাবন তার ঘাড়ের কাছে এসে উষ্ম নিশ্বাস ফেলত। গল্পের শেষ পর্যায়ে নায়কের এই ব্যর্থ জীবনের হতাশা, অনুশোচনা সবই অন্তর্হিত হয়েছে। মহাপ্রলয়ের সন্ধিক্ষণে দুটি আত্মার একত্র সমাবেশ হয়ে উঠেছে গভীর ব্যঞ্জনাধর্মী। এই মৃত্যুরূপী মহাপ্রলয়ের মধ্যে জীবনের শাশ্বত রূপকে প্রত্যক্ষ করে নায়ক উপনীত হয়েছে চৈতন্যের শীর্ষ সীমায়।
গল্পের শেষে একটা বিচ্ছেদ বেদনা পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়। মিলন হল না নায়ক ও সুরবালার। সন্দেহ নেই এরজন্য সম্পূর্ণই দায়ী নায়ক। গল্পের প্রথম থেকেই সুরবালার প্রতি নায়কের ছিল তাচ্ছিল্য ও নিষ্ক্রিয়তা। সুরবালা সর্বদাই ছিল নায়কের অবহেলার পাত্রী। এমনকি যৌবনে যখন সুরবালার সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব তার কাছে এসেছিল তখনও সে ঝোঁকের বশবর্তী হয়ে সে প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিল। সুতরাং বলাই যায় কাহিনির এই পরিণতির জন্য অবশ্যই দায়ী নায়কের নিষ্ক্রিয়তা। কিন্তু মনে হয় না, এই কাহিনির নায়ক ভীরু। সে সুরবালার বিষয়ে নিষ্ক্রিয় ছিল এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই কিন্তু সে ভীরু নয়, তার ভীরুতার কোনও প্রমাণ আমরা পাই না। সুতরাং বলা যেতে পারে গল্পের এমন হতাশাব্যঞ্জক পরিণতির জন্য দায়ী নায়কের নিষ্ক্রিয়তা, ভীরুতা নয়।