জীবনের অপরিসীম শূন্যতা, অস্তিত্বহীনতা, ক্লান্তি, অবসাদ, মৃত্যুচেতনা আত্মহত্যাপ্রবণতা প্রভৃতি এক ধরনের নেতিমূলক মনোভাব থেকে অ্যাবসার্ড জীবনদর্শনের উদ্ভব। মনে হয়, এ জীবন অর্থহীন, এক নিত্য অভ্যাসের দাস মাত্র। জীবনে আশা নেই, আনন্দ নেই, শুধু গতানুগতিকতায় পর্যবসিত এক ‘বায়ুভূত নিরাশ্রয়’ সত্তা মাত্র। এই শূন্যতাবোধের, বিচ্ছিন্নতা বোধের অসহায়তা মানুষকে একপ্রকার আশা ও আনন্দবিহীন জীবনের কোনো নৈরাশ্যের, বিবিক্ততার ধূ-ধূ বালুকাময় অন্ধকার গহ্বরের মুখে টেনে নিয়ে যায়। তখন এ জীবন, এই পৃথিবীর সবকিছুই অর্থহীন মনে হয়। আত্মিক ও মানসিক অবসন্নতার চরম স্তরে উপনীত হয়ে মানুষ মৃত্যু-চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। “Absurd is that which is deviod of purpose…cut off from his religious, metaphysical, and transcendental roots, man is last; all his actions become senseless, absurd useless” (আয়োনেস্কো)। এই চেতনা প্রসঙ্গে ক্যামুর উক্তি—“This divorce between man man his life, the actor and his setting truely constitutes the feeling of Absurdity” বাংলার অ্যাবসার্ড নাট্যরীতির উদাহরণ বিশেষ নেই। তবে এখানে এ জাতীয়, কিছু কিছু রচনা বৈচিত্র্যের প্রকাশ ঘটেছে, তাও ঠিক। বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ পুরোপুরি অ্যাবসার্ড নাটক। তাঁর ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকেও অ্যাবসার্ডিটির লক্ষণ রয়েছে। এ নাটকে বাস্তব জীবনরসের পাশাপাশি অ্যাবসার্ড জীবনদর্শনও বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। সেই প্রসঙ্গটি এক্ষেত্রে আলোচনা করা যেতে পারে।
একটি বাংলা অ্যাবসার্ড নাটক : বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’
‘বাকি ইতিহাস’ নাটকের তৃতীয় অঙ্কে নৈরাশ্য, অবসাদ, অর্থহীনতা, আশাভঙ্গের যন্ত্রণার সুতীব্র প্রকাশ ঘটেছে। সীতানাথ আত্মহত্যা করেছে। সেই আত্মহত্যার কারণ বোঝাতে গিয়ে সে এই জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার যন্ত্রণাময় উপলব্ধির কথা শরবিন্দুকে ব্যাখ্যা করেছে। সীতানাথ শরবিন্দুর মতো নিয়মিত খবরের কাগজের কাটিং জমায়। সে জেনেছে, সেই কোন্ যুগ থেকে মানুষ মানুষের ওপর অপরিসীম শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার চালায়, তাদের ক্রীতদাস করে রেখে ফয়দা লোটে। সীতানাথের অ্যালবামে জমা হয়েছে যে সবকিছুর কাটিং, তা এরূপ : মহাভারতে দুঃশাসনের রক্তপান, চাবুকের আঘাতে জর্জরিত ক্রীতদাসরা পাথর টেনে তুলে পিরামিড তৈরি করছে; রোমান সম্রাটের নৌবিহারে দাঁড় টানছে গিঁটবাধা চামড়ার চাবুকের আঘাতে জর্জরিত ক্রীতদাসের দল; রোমের কলিসিয়মে সিংহদের দিয়ে ক্রীশ্চানদের খাওয়ানোর ছবি ; জোয়ান অব্ আর্ককে পুড়িয়ে মারার ছবি; সম্রাট নেপোলিয়নের জয়যাত্রার ছবিতে বেয়নেটে গাঁথা রয়েছে শত্রুসৈন্যের ছিন্ন শির; সাহারা মরুভূমির বাণিজ্যপথে শিকলে বাঁধা ক্রীতদাস চালান দেওয়া, অ্যালবামার তুলোর ক্ষেত্রে ক্রীতদাসদের ওপর নির্মম অত্যাচার, যার রক্তাক্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে আঙ্কল টম্স্ কেবিন গ্রন্থে ; প্রথম মহাযুদ্ধে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলতে থাকা একজন নিচু দরের সৈনিক; হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ও ইহুদিদের পুড়িয়ে মারার জন্য গ্যাস চেম্বার সোপনের গৃহযুদ্ধে মাদ্রিদের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার চিত্র ; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে দেশে দেশে বিধ্বংসী ক্ষতের ছবি ; আণবিক রোমায় বিধ্বস্ত হিরোসিমার ধ্বংসস্তূপ; ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনীর বীভৎস তাণ্ডব। সীতানাথের মতে— “এই তো ইতিহাস….মানুষের ইতিহাস। জীবনের ইতিহাস।” যুগে যুগে কালে কালে সমগ্র মানব সমাজের ওপর এই ধ্বংসাত্মক, শোষণমুখর যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার কালো ছায়া পড়ে চলেছে। আলাদা আলাদা মানুষের জীবনের ‘আলাদা আলাদা ইতিহাস হয়তো আছে। কিন্তু সমগ্র মানবসমাজের ইতিহাস তো সেটি নয়, মানুষের ওপর মানুষের নৃশংস অত্যাচার ও নিপীড়নের নৈরাশ্যময় ইতিহাস—‘বাকি ইতিহাস’।
সীতানাথের মতে, এই নৈরাশ্যময় অন্ধকার জীবন নিয়ে বেঁচে থাকবার কোনো সার্থকতা নেই। তাই মৃত্যুই এক্ষেত্রে শ্রেয়, তা এই যন্ত্রণা ও নৈরাশ্য থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। তাহলে কি মানুষ বেঁচে থাকতে চায় না ? অবশ্যই চায়। তার তেমনভাবে বেঁচে থাকা আত্মহত্যার সামিল। ‘তারা নিঃশব্দে নীরবে বাঁচা বন্ধ করে বসে আছে। মানুষের কাছে বাঁচা কিংবা মরা— এই দুটি পথ মাত্র খোলা আছে। এর যে-কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে। ‘মানুষ হয় বাঁচবে, না হয় মরবে। কিন্তু বেঁচে থাকা ও তো একপ্রকার মৃত্যু বিরুদ্ধ পরিবেশে, আশাহীন, স্বপ্নহীন জড়বৎ জীবনটুকু শুধু নিয়ে। সীতানাথের জীবনেও তো ঠিক তেমনি ঘটেছিল। ‘উনিশ বছর আগে পৃথিবী সুন্দর ছিল। মানুষ সজীব ছিল। জীবন মূল্যবান ছিল। উনিশ বছর আগে’।
তারপর তার বাবার মৃত্যুতে সীতানাথের জীবনের রং, রূপ-রস সব ধুয়ে মুছে গেল। একটি প্রাণীর কাছে সমস্ত দুনিয়াটা এক্কেবারে পালটে গেলে। নিশ্চিন্ত আরামের আশ্রয় ঘুচে গিয়ে তাকে উল্কার মতো তিরবেগে ছুটে বেড়াতে হল এক গ্রহ থেকে আর এক গ্রহের সন্ধানে। এমনিভাবে লেখাপড়া শিখে পরীক্ষায় পাস। ধার করা, ধারশোধ করে আরও ধার করা, একে একে অনেকগুলি পরীক্ষার স্তর পার হয়ে এম. এ. পাস। চাকরি, “তেরো বছর আগে জীবনের আরম্ভ। আর জীবনের শেষ। আবার নতুন অর্থে খোঁজে। আবার নতুন প্রতিজ্ঞা খোঁজা। নতুন জীবনের আরম্ভ।” ছাত্র পড়ানো, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। একই একঘেঁয়ে বক্তৃতা। তারপর তার জীবনে কণা এলো নতুন জীবনের অর্থবহন করে। কিন্তু সেই নতুন জীবনের স্বাদও একদিন বদলে গেল—“কণা তলিয়ে গেল। রাশি রাশি মিনিট ঘণ্টা দিনের অভ্যাসে জীবনের নতুন অর্থ তলিয়ে গেল।” নিত্য দিনের অভ্যাসে সজীব প্রাণের উৎস কণা শুকিয়ে যায়। তখন সে জীবনের সঙ্গী নয়, হয়ে ওঠে অভ্যাসের সঙ্গী। শরদিন্দু জানেনা যে, তার অবচেতন মনের গভীরে জমা হয়ে আছে এই নিত্য অভ্যাসের ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতার অবসন্নতা। সীতানাথের সঙ্গে মিটুকু সে এই মুহূর্তে অনুভব করে, যদিও চেতন অভাবে অনুভূতি দিয়ে সে তা স্বীকার করতেও চেষ্টা করে। এইভাবে—“জীবনের অর্থ এগারো বছরের অর্থহীনতায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। “এগারো বছর; এগারো শতাব্দী, এগারো হাজার বছর, রাশি রাশি বছরের অর্থহীনতার ইতিহাস। রাশি রাশি মানুষের রাশি রাশি কীটের অর্থহীনভাবে ইতিহাস।”
এতো ব্যক্তি মানুষের ইতিহাস। তাতেও আছে ক্লান্তিকর অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি, অবসাদ, বিষণ্ণতা, ছিন্নবোধের, অর্থহীনভাবে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। ব্যক্তি মানুষের এই অভিজ্ঞতা ছাড়াও রয়েছে সমগ্র মানবসমাজের যন্ত্রণা কাতর অর্থহীনতার অস্তিত্বের নিরর্থকতার মর্মান্তিক ইতিহাস—“হ্যা বাকি ইতিহাস, মহাযুদ্ধের ইতিহাস। রাশি রাশি বছরের হত্যা নির্যাতন যন্ত্রণার ইতিহাস ! কুরুপাণ্ডব, সিকন্দর, নীরো, চেঙ্গিস খাঁ, নেপোলিয়ন, হিটলারের ইতিহাস। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস পিরামিডের পাথরে, কলোসিয়ামের বালিতে জালিয়ানওয়ালাবাগের দেয়ালে, হিরোশিমার পোড়া মাটিতে লেখা রয়েছে। হাজার হাজার বছরের বাকি ইতিহাস।” মানুষকে এই শোষণ বঞ্চনা, লাঞ্ছনার প্রতিকার আমরা কেউ কিছু করতে পারি না। কেউ কিছু করতে পারে না, – “নির্যাতন হত্যা দাঙ্গা যুদ্ধ—সবকিছু চলতে, সবকিছু মানুষই করবে,— তবু মানুষের কিছু করবার নেই।” আর ব্যক্তি মানুষ ?—“এরা সবাই জীবনের এক একটি অর্থ খুঁজে নিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করছে।” কিন্তু এভাবে বাঁচা তো সত্যিকারের বাঁচা নয়, বাঁচবার ভান মাত্র। এই বাঁচাতো সমগ্র মানব সমাজের সামূহিক কল্যাণের সঙ্গে সংযুক্ত হয়নি, ব্যক্তি মানুষের চাওয়া পাওয়ার চার দেয়ালের মধ্যে প্রাত্যহিক অভ্যাসের জালে আবদ্ধ এক বন্দি জীবন মাত্র— “বাঁচবার ভান করছে। অর্থ যখন থাকছে না, তখন অভ্যাস সম্বল করে বাঁচবার ভান করছে। যেমন আমি করেছিলাম। যেমন তুমি করছো।”
মানুষ আশা নিয়ে বেঁচে থাকে। জীবনের এক অর্থ ফুরিয়ে গেলে নতুন অর্থ তার জীবনে আশা জাগায়। তখন সে নতুন করে বাঁচতে শেখে। কিন্তু আশা ফুরিয়ে গেলে, অস্তিত্বের পালতোলা নৌকার নোঙর ছিঁড়ে গেলে মানুষ জীবনের গতিপথ হারিয়ে ফেলে, বিশৃঙ্খল সামুদ্রিক তরঙ্গে আবর্তে পাক খেতে খেতে একদিন তলিয়ে যায়। সীতানাথের আত্মহত্যা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল এভাবে—“জীবনের অর্থ ফুরোলে ভাবে একদিন অর্থ ফিরবে। বেঁচে থাকা শেষ হলে ভাবে— একদিন আবার শুরু হবে, তাদের আশা আছে।” “না আমার আশা ছিল না। আমার অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সব একাকার হয়ে গিয়েছিল।” অবসন্নতা, অর্থহীনতা, মৃত্যুচেতনায় ভাস্বর সীতানাথের প্রভাব সংক্রমিত হয়েছিল শরদিন্দুর মধ্যেও। তবে সে শেষ পর্যন্ত নতুন আশার আলোয় উদ্দীপিত হয়ে জীবনের পথে ফিরে এসেছে। তাই বাকি ইতিহাস, শেষ পর্যন্ত কবোশ্ম জীবনের ইতিহাস হয়ে উঠেছে। তবে অবক্ষয়ী চেতনাও এ নাটকে একটা বিশেষ স্থান করে নিয়েছে তা বলা যায়।