উনিশ শতকের দ্বিতীয়র্ধে যে সব মুসলিম লেখকগণ বাংলাভাষায় সাহিত্য রচনা করে আপনার যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন, মশাররফ হোসেন তাদের মধ্যে সব চাইতে শক্তিমান গদ্যলেখক।
১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর নদীয়া জেলার অন্তর্গত লাহিনীপাড়া গ্রামে মীর মশাররফের জন্ম হয়। পিতা মীর মুয়াজ্জম হোসেন, মা বিবি দৌলতন্নেসা। মশাররফ পিতার দ্বিতীয় পক্ষের প্রথম সন্তান। রাজকার্যে যোগ্যতা ও পারদর্শিতার জন্য তিনি ‘মীর’ উপাধি লাভ করেন। আসলে তাঁর বংশগত উপাধি ছিল ‘সৈয়দ’।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে যে সব মুসলিম লেখক বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করে অবস্মিরণীয় খ্যাতির অধিকারী হয়েছেন মীর মোশাররফ হোসেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক। তাঁর সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত হয় সংবাদপ্রভাকর পত্রিকায়। পরে তিনি ‘আজীবন নেহার’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মীরের জীবন সংগঠিত হয়। শৈশবে মুন্সী সাহেবের কাছে আরবি শিক্ষার এবং জগমোহন নন্দীর পাঠশালায় বাংলা পঠন-পাঠন শিক্ষার সূচনা হয়। বয়সকালে ফরাসি ভাষায় সঙ্গেও পরিচয় ঘটে। চোেদ্দ বছর বয়সে কুমারিখালি ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। কুমারিখালি স্কুলে স্বল্পকালীন অবস্থানের পর পদমদী নবাব স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সঙ্গ দোষে পড়াশুনো বেশিদূর এগোয় না। তারপর ভর্তি হন কুমারিখালি কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে। এখানে মাত্র সাত মাসের জন্য তাঁর অবস্থান ঘটে। কিন্তু তার প্রভাব হয় গভীরতর।। এখানকার হিন্দুয়ানী চাল চলন, হিন্দুয়ানী নামকরণ তাঁকে হিন্দুজীবন সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় পিতৃবন্ধু নবাজীর সাহেবের বাড়িতে স্থানান্তরিত হন। সেখানে নবাজীরের জ্যেষ্ঠা কন্যা লতিফ-উন-নিসার সঙ্গে প্রণয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার বিবাহ হয় লতিফের বোন আজীজ ঊন-নিসার সঙ্গে, যা তার ভবিষ্যৎ জীবনকে বিষময় করে তোলে। ১২৮০ খ্রিঃ তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ হয় কুলসমের সঙ্গে। এই বিবি কুলসমই মশাররফের উচ্ছৃঙ্খল জীবনকে সংযত ও সৃষ্টিশীল করে তোলেন। এই দ্বিতীয়া পত্নী কুলসমকে নিয়েই মীর তার সর্বশেষ গ্রন্থ ‘বিবি কুলসম’ রচনা করেন। কুলসুমের মৃত্যুবর্ষে এটি প্রকাশিত হয়। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে (কুলসমের মৃত্যুর দু’বছর পর) মীর সাহেব পরলোকগমন করেন।
মীর মশাররফ হোসেন একটি প্রহসনের (‘এর উপায় কি?’ ১৮৭৬) দ্বারা সাহিত্যক্ষেত্রে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। তবে প্রহসনটি বিশেষ সমাদৃত হয়নি। কিন্তু তাঁর ‘বসন্তকুমারী’ নাটক (১৮৭৩) এবং ‘জমীদা (ণ-এ (১৮৭৩) রচনাশক্তির পরিচয় লক্ষ করা যায়। এ ছাড়াও ‘গোরাই ব্রীজ’ (১৮৭৩), ‘সঙ্গীতলহরী’ (১৮৮৭), ‘হজরত ওমরের ধর্মজীবন লাভ’ (১৯০৫), ‘মদিনার গৌরব’ (১৯০৬), ‘মোস্লেম বীরত্ব’ (১৯০৭), গোরক্ষার জন্য প্রস্তাব’, ‘আমার জীবন’ (১৯০৮), এবং ‘বিবি কুলসম’ (১৯১০) প্রভৃতি রচনায় তিনি শুধু মুসলমান সমাজে নয়, হিন্দু সমাজেও অতিশয় আদরণীয় হয়েছেন। তিনি ‘আজীবন নেহার’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন।
মীর মশারফ বঙ্কিম বলয়ের অন্যতম প্রাবন্ধিক। তাঁর প্রবন্ধ সমাজ, ধর্ম, ইতিহাস ও জীবনচরিত নিয়ে লেখা। ‘গোজীবন’ (১৮৮৯), ‘আমরা জীবনী’ (১৯১০) ও হজরাত লালের জীবনী’ (১৯০৫) প্রভৃতি তাঁর প্রবন্ধ পুস্তক। সহজ সাবলীল গতি, ওজস্বিতা তাঁর রচনাকে স্বকীয় স্বাতন্ত্র্য ও বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। ভারতব্যাপী হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ও সংঘর্ষ দূরীকরণে তিনি বলিষ্ঠ বক্তব্য রাখেন, ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে মানবিক মূল্যবোধ ও বিচার সাম্যের এক দুর্লভ পরিচয় রয়েছে তার প্রবন্ধে। উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আদর্শ তুলে ধরেন।
মীর মশাররফ হোসেন এর রচনাসমূহ:
মশারফের রচনাগুলিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। (ক) নাটক (খ) উপন্যাস (গ) জীবনী গ্রন্থ এবং অন্যান্য গ্রন্থ।
তার নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বসন্তকুমারী’ (১৮৭৩) ‘জমিদার দর্পণ’ (১৮৭৩) এবং ‘এর উপায় কি’ (১৮৭৫) নামক প্রহসন। উপন্যাসের মধ্যে আছে ‘রত্নাবতী’ (১৮৬৯) ‘বিষাদ সিন্ধু’ (১৮৮৫-৯১) ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯০)।
এ ছাড়া যে জীবনী গ্রন্থ এবং অন্যান্য গদ্য রচনা লিখেছেন সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘গোরাই ব্রিজ’ (১৮৭৩) ‘সঙ্গীত লহরী’ (১৮৮৭), ‘হজরত মহম্মদের ধর্মজীবন লাভ’ (১৯০৫) ‘মদিনার গৌরব’ (১৯০৬) ‘মোল্লেম ভারত’ (১৯০৭) গো জীবন (১৮৮৯) ‘আমার জীবন’ (১৯০৮) ‘বিবি কুলসম’ (১৯১০)।