দেবী পার্বতী যখন শিবের সঙ্গে ঝগড়া করে সংসার ত্যাগ করতে মনস্থ করেন, তখন তার সখী পদ্মাবতী তাকে ভবিষ্যতে মর্ত্যলোকে কীভাবে তাঁর পূজা প্রচারিত হ’বে তার ইতিহাস শোনাচ্ছিলেন। তিনি বলেছিলেন-
‘প্রথম কলির অংশে জন্মাবে আবেটি বংশে মহেন্দ্রনন্দন নীলাম্বরি।
ছলিয়া অবনি আনি নিবে তার পুষ্প পানী
অবশেষে নিবে নিজ পুরে।।’
এখানেই আমরা প্রথম জানতে পারছি যে দেবীর ছলনায় ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর মর্ত্যলোকে আখেটি বা ব্যাধবংশে জন্মগ্রহণ করে দেবীর পূজা প্রচার করে আবার স্বর্গে ফিবে আসবে। তদনুযায়ী নীলাম্বর শাপগ্রস্ত হয়ে মর্ত্যলোকে ব্যাধ ধর্মকেতুর গৃহে নিদয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে এবং তার নাম হয় কালকেতু। নীলাম্বর পত্নী ছায়াও সহমৃতা হ’য়ে মর্ত্যলোকে ব্যাধকূলে জন্মগ্রহণ করে তার নাম ফুল্লরা। কালে কালকেতুর সঙ্গে ফুল্লরার বিবাহ হয়। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রথমাংশ—’আখেটিক খণ্ড কালকেতু-ফুল্লরার কাহিনী অবলম্বন ক’রেই রচিত হয়। অতএব কালকেতু কাহিনী থেকে ব্যাধ জীবনের একটি সামগ্রিক জীবনের পরিচয় অবশ্যই পাওয়া উচিত। এ ছাড়া আলোচ্য গ্রন্থে অন্যত্র ব্যাধজীবন নিয়ে অপর কোনো তথ্য নেই।
কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী ছিলেন মধ্যযুগের এক প্রতিভাসম্পন্ন কবি। তার অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি এবং সহহৃদয়তার সাহায্যে তিনি সমকালীন জীবনের অতিশয় বাস্তব ও বিশ্বাস্য চিত্র এই কাব্যে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। ব্যাধজাতি সে-সময় সম্ভবত গ্রামের প্রাস্তে পৃথক পল্লীতে বাস করতো (তু কিরাত নগরে বসি না মিলে ঊধার’)। কাজেই প্রতিবেশীরূপে কবিকঙ্কণ ব্যাধ জীবনের সঙ্গে সাধারণভাবেই বোধ হয় পরিচিত ছিলেন, খুব ঘনিষ্ঠভাবে নয়। যে জীবনযাত্রার সঙ্গে মুকুন্দ চক্রবর্তীর প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল, সেই জীবনযাত্রার চিত্রাঙ্কনে কোন ত্রুটি নেই। কিন্তু প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভাবে যাকে তিনি কল্পনায় ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন সেখানে চিত্রটি তত বিশ্বাস্য হয়ে উঠতে পারেনি। যেমন, কালকেতু-ফুল্লরার বিবাহ-কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে কবিকঙ্কণ বহু স্থলে এমন অনেক আচার-অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছেন, যাকে সমকালীন চিত্র হিসেবে বাস্তব মনে হলেও তা ব্যাধজীবনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলেই বিশ্বাস্য বলে মনে হয় না। যাহোক কবিকঙ্কণের অনুসরণে সে কালের ব্যাধজীবন কেমন ছিল, তার পরিচয় নেওয়া যেতে পারে।
দেবী চণ্ডী বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর ছদ্মবেশ ধারণ ক’রে ধর্মকেতু ব্যাধের পত্নী নিদয়ার গর্ভে নীলাম্বরের আত্মাকে সংস্থাপন ক’রে দিয়ে যান। নিদয়া গৰ্ভবর্তী হ’লে অপর সকল নারীর মতোই গর্ভ লক্ষণসমূহ মাসে মাসে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। নবম মাসে চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী ব্যাধরমণী নিদয়ার সাধভক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। দশম মাসে পূর্ণ গর্ভকালে নিদয়া পুত্রসন্তান প্রসব করে, পুত্রের কল্যাণ কামনায় ধর্মকেতু ব্যাধ স্নান ক’রে দ্বিজকে দশটি মৃগ দান করে।
সুতিকাগৃহে যথাবিধি আচারসমূহ অনুষ্ঠিত হল। চাল ফেঁড়ে ঘরে আগুন জ্বালানো হল; নাভি ছেদনকালে চণ্ডীর পূজা এবং দরজার ডানদিকে গোমুণ্ড স্থাপন করা হ’ল। ছয় দিনের দিন রাত জেগে ঘাটিয়ারা করা হয় এবং অষ্টম দিবসে অষ্ট কলাই ও নবম দিনে নবনত্তা অনুষ্ঠিত হয়। একুশ দিনের দিন হরিণ বলি দিয়ে সোমাই ওঝা ষষ্ঠীপূজা করেন। দু’তিন মাস পার হতেই ব্যাধনন্দন বিছানায় পাশ ফেরে, যষ্ঠ মাসে ছাগ মেষ বলি দিয়ে শিশুর অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময়ে দৈবজ্ঞ শিশুর নামকরণ করলো ‘কালকেতু’। দশ মাস বয়সে কালকেতু হামাগুড়ি দিতে শিখলো এহং দু’তিন বছর পার হতেই অন্য শিশুদের সঙ্গে কালকেতু ভালুক শরভের সঙ্গে খেলা করতে আরম্ভ করে। পঞ্চম বর্ষে কালকেতুর কর্ণভেদ অনুষ্ঠান হয়।
কালকেতু অল্প বয়সেই অতিশয় বলিষ্ঠ, স্বাস্থ্যবান এবং ক্রীড়ানিপুণ হয়ে ওঠে। পাবড়া ঢেলা নিয়ে সে খেলা করে, তার সঙ্গে কেউ এঁটে উঠতে পারে না। এ সময় শুভদিন দেখে কালকেতুর হাতে তীরধনু তুলে দেওয়া হ’ল। অল্পদিনের মধ্যেই কালকেতু ধনুর্বিদ্যায় অতিশয় নিপুণতা অর্জন করে। কাজেই অল্প বয়সেই সে পিতার সঙ্গে শিকারে যাবারও অধিকার লাভ করে।
‘ইচ্ছা হয় ঘেঁই দিনে যায় বীর পিতা সনে
আগে ধায় জিনিয়া পবনে।।’
ব্যাধরমণীরাই হাটবাজার করতো, কখনও কখনও পুরুষরাও সঙ্গী হ’ত। এইভাবেই একদিন হাটে নিদয়ার সঙ্গে কালকেতুকে দেখলো হীরা-ফুল্লরার মা কালকেতুকে দেখেই হীরা মনে মনে কন্যা ফুল্লরার জন্য একে বররূপে কামনা করে—
‘ফুল্লরা সেবিলা হর তবে মিলে এই বর
রূপে যেন মদন-মুরতি।’
পুত্রকন্যার বিবাহে ঘটক নিয়োগ করা হত। সোমাই ওঝা ছিলেন দুই ব্যাধকুলেরই পুরোহিত। ধর্মকেতু পুত্র কালকেতুর বিবাহের জন্য সোমাই ওঝার ওপর ভার অর্পণ করলে ওঝা ফুল্লরার কথা চিন্তা করে তার পিতা সঞ্জয়কেতুর কাছে গেল। সঞ্জয়কেতু ওঝার যথাবিহিত মর্যাদা দিয়ে তার কাছে বন্যা ফুল্লরার বিবাহ সম্বন্ধের কথা উত্থাপন করলে ওঝা কালকেতুর প্রসঙ্গ তুললো। সঞ্জয়কেতু সম্মত হয়ে পণের কথা জানালো, তখন ছিল কন্যাপণ-প্রথা।
‘পণের নির্ণয় কৈল দ্বাদশ কাহন।
ঘটকালি পাবে ওঝা তুমি চারিপণ।।
পাঁচ গণ্ডা ওয়া দিব গুড় পাঁচ সের।’
এর পর পাকা দেখার জন্য সঞ্জয়কেতু ভাবী জামাতা কালকেতুকে স্বগৃহে আমন্ত্রণ জানালে কালকেতু বন্ধুবান্ধব নিয়ে উপস্থিত হ’ল। মালা দ্বারা কালকেতুকে বরণ ক’রে সঞ্জয়কেতু সকলকে ভূরিভোজে আপ্যায়িত করে—
‘তিনটা পাতন কাঁড় দিল জামাতারে।’
বিবাহের জন্য পুরোহিত শুভদিন স্থির করলেন রেবতীনক্ষত্র যুক্ত ত্রয়োদশী তিথি।
বিবাহের দিন গোবর দিয়ে উঠোন নিকিয়ে সেখানে আলপনা দেওয়া হ’ল এবং ছাদনাতলা তৈরি করা হ’ল। ফুল্লরা হরিদ্রাবসন পরিধান করলো। তার মা সখীদের নিয়ে ঘরে ঘরে জল সইতে গেলো। পুরোহিত বেদমন্ত্র পাঠ ক’রে গণেশ আহ্বান ক’রে যথাশাস্ত্র পূজা-অর্চনা করলেন; ব্যাধের বিবাহ হ’লেও এখানে অনুষ্ঠানাদি উচ্চবর্ণের হিন্দু পরিবারেরই অনুরূপ। ষোড়শ মাতৃকাপূজা, বসুধারা দান, নান্দীমুখ, অধিবাস—সবই যথাবিধি সম্পন্ন হ’ল। আশঙ্কা হয়, কবি মুকুন্দ এই বিবাহানুষ্ঠান বর্ণনায় স্বগৃহে অনুষ্ঠিত ক্রিয়া-কর্মানিরই বিবরণ দিয়েছেন। অশুদ্ধ ব্যাধ-পরিবারে এ জাতীয় অনুষ্ঠান স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। যা হোক যথাসময় বরযাত্রীসহ কালকেতু বিবাহবাসরে উপস্থিত হ’ল। হীরা বরকে বরণ করলো যথাবিধি—
‘শিরে দিয়ে দুর্বাধান নিছিয়া ফেলিল পান।
গলে দিল বনফুল মালা।’
তারপর বর-কনের শুভদৃষ্টি হ’ল, বরকে যৌতুক আভরণ দেওয়া হ’ল—
‘যৌতুক ধনুকখান দিল বর তিন বাণ
জামাতারে করিল বহমান।’
ব্রাহ্মণ ওদের গাঁটছড়া বেঁধে দিলে বর-কনে অরুন্ধতী দর্শন করে লাজাহুতি দিয়ে হোম করে বাসরে প্রবেশ করলো এবং তথায় মাছ-মাংস দিয়ে অন্নভোজন করলো। বিদায় কালে—
‘পাথরে আমানি ভরি দিলা সঞ্জয়ের নারী
ফুল্লরা করিয়া কোলে কান্দে।’
বিবাহের পর কালকেতু বধূ ফুল্লরাকে নিয়ে ঘরে এলো, সঙ্গে এলো বন্ধুজন। পাঁচদিন সবাই এখানে রইলো, পরে সবাইকে যৌতুকসহ বিদায় দেওয়া হলো।
কালকেতু প্রতিদিন শিকারে গিয়ে ‘মৃগ খগ-বরা’ যে দিন যা পায়, তা নিয়ে আসে। নিদয়া কখন নিজে, কখন বধূ ফুল্লরার সাহায্যে হাটে কেনা-বেচা করে।—
‘নিদয়া বইসে ঘাটে মাংস নিয়া গিয়া হাটে
অনুদিন বেচয়ে ফুল্লরা।
শাশুড়ি যেমন ভণে তেমন বেচেন কেনে
শিরে কাখে মাংসের পশরা।।’
পুত্র-পুত্রবধূকে এইভাবে সংসারে প্রতিষ্ঠিত করে—
‘জায়া-সঙ্গে ধৰ্ম্মকেতু ভাবিয়া মুক্তির হেতু
বারাণসী করিল পরাণ।’
কালকেতু তাদের ভরণ পোষণের জন্য মাসে মাসে পাঠান সম্বল।
এই ঘটনাটিও ব্যাধ-জীবনে অবাস্তব বলেই মনে হয়। কালকেতু-ফুল্লরা বিষয়ে যে আলোচনা করা হ’ল, এটি থেকে ব্যাধজীবনের পরিচয় জেনে নিতে হবে, কারণ পৃথকৃভাবে ব্যাধজীবনের অপর কোনো পরিচয় গ্রন্থে নেই।
অতঃপর ব্যাধসস্তান কালকেতু যা শিকার করে আনতো ফুল্লরা হাটে পশরা দিয়ে তা’ বিক্রয় করতো। তাদের হাতেই সংসারের কর্তৃত্ব।
কালকেতুর ভোজন থেকে বোঝা যায়, অতিশয় পরিশ্রমী ব্যাধেরা প্রচুর পরিমাণে আহার করতো বাদ্যের কোনো গুণগত উৎকর্ষ ছিল না, ছিল পরিমাণগত প্রাচুর্য খাদ্য তালিকায় পাওয়া যাচ্ছে—হাঁড়ি হাঁড়ি আমানি, খুদের জাউ এবং মুসুরীর সুপ, ঝুড়ি ঝুড়ি আলু ওল পোড়া, সার কচু, আমড়া, করমচা এবং হরিণ ও নকুলের মাংস মাংসের ঝোল হ’ত, আবার পুড়িয়েও খাওয়া হ’ত।
ফুল্লরার বারমাস্যায় নিম্নবিত্ত গৃহস্থঘরের যে দারিদ্র্যলাঞ্ছিত চিত্র উপস্থাপিত করা হয়েছে, তাকে আমরা ব্যাধজীবনের একটি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্বাস্য চিত্র বলে গ্রহণ করতে পারি।
ব্যাধেরা থাকতো গ্রামের বাইরে কিরাত নগরে সেখানে সকলেই ব্যাধ, কারো গৃহে এমন সম্বল থাকে না যে, ধার দিয়ে বন্ধুজনের ভার লাঘব করা যায়। ওরা বাস করতো ভেরেণ্ডার থাম ও তালপাতার ছাউনি দেওয়া কুঁড়ে ঘরে—যা কালবৈশাখীর দাপট সহ্য করতে পারতো না। ব্যাধ রমণীরা দ্বারে দ্বারে মাংসের পশরা, বন্য ফলমূল এবং কাঠ ফিরি করতো, পরিবর্তে পেতো চাল-খুদ এবং অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী। ওদের পরিধানে থাকতো হেটো শাড়ি, যা দিয়ে মাথা ঢাকা যেতো না। বর্ষাকালে জলের মধ্যেই তাদের ঘুরে বেড়াতে হ’ত জোঁকের কামড় অবশ্যই থাকতো, হয়তো বা সর্পাঘাতও জুটতো কপালে। আশ্বিনে দুর্গাপূজার সময় অন্য রমণীরা নতুন বসন পেলেও ব্যাধরমণীদের সেই ভাগ্য ছিল না, তাদের উদরের চিন্তায় ব্যস্ত থাকতে হত। শীতকালে যদি বা তাদের আহারের জন্য চিন্তা করতে হত না—কিন্তু শীতের হাত থেকে ওদের পরিত্রাণ ছিল না। যদি বা হরিণের বদলে পুরানো খোসলা জুটতো, তাতে শীত নিবারণ করা যেতো না, তখন তাদের ভরসা করতে হ’ত ‘জানু- ভানু কৃশানু’র ওপর। ব্যাধের ঘরে মাটির পাত্র ছাড়া অপর কোন তৈজসপত্র ছিল না। মাটিতে গর্ত করে তাতে আমানি রাখতে হত। এককথায় বলা চলে, একান্ত দারিদ্র্যের মধ্য দিয়েই ব্যাধজীবন অতিবাহিত হত।
সমকালীন ব্যাধ-জীবন-সম্বন্ধে প্রধান জাতব্য তথ্য এই ব্যাযজাতি গ্রামের প্রান্তে পৃথক পল্লীতে বাস করতো। এরা সকলেই ছিল অতিশয় দরিদ্র, কুঁড়েঘরবাসী –একের বিপদে অপরের পক্ষে আর্থিক সহায়তাদানের মতো সংগতি তাদের ছিল না। এদের জীবিকা ছিল অরণ্যের খণ্ড শিকার এবং বন থেকে কাঠ-খড় বা বনজ ফল-মূল কুড়িয়ে এনে গৃহস্থ ঘরে অথবা হাটে বাজারে বিক্রয় করা। এরই সাহায্যে তাদের উদরান্নের সংস্থান করতে হ’ত। ব্যাধ-রমণীরাও হাটে পশরা নিয়ে বসতো এবং গ্রামের গৃহস্থ ঘরে মাংসানি ফিরি করতো। তাদের পোষাক পরিচ্ছদ ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম এবং মাংসাদির বিনিময়ে গৃহস্থঘর থেকেই তা সংগৃহীত হ’ত। দৈহিক পরিশ্রমের কারণেই তাদের আহার্য বস্তুর পরিমাণ হ’ত অপরিমেয়, গুণে নিকৃষ্ট। স্বচ্ছন্দ বনজাত শাক-সব্জী এবং ক্বচিৎ শিকারে লব্ধ মাংসই ছিল তাদের প্রধান খাদ্য।