ভারতের ব্রিটিশবিরােধী জাতীয়তাবাদ, গণ-আন্দোলন, বিপ্লবী কার্যকলাপ প্রভৃতি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে কুখ্যাত রাওলাট আইনে বিভিন্ন ধারা যুক্ত করা হয়।
[1] প্রচারকার্য দণ্ডনীয়: সরকার-বিরােধী যে-কোনাে প্রচারকার্য দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।
[2] বিনা পরােয়ানায় গ্রেপ্তার: সন্দেহভাজন যে-কোনাে ব্যক্তিকে বিনা পরােয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে। গ্রেপ্তারের পর বিনা বিচারে তাদের অনির্দিষ্টকাল আটক রাখা বা নির্বাসন দেওয়া যাবে।
[3] বাড়ি তল্লাশি: সরকার বিনা পরােয়ানায় যে-কোনাে ব্যক্তির বাড়ি তল্লাশি করতে পারবে।
[4] বিচারকার্য: বিশেষ আদালতে সন্দেহভাজন অপরাধীর বিচার হবে। বিচারকগণ কোনাে জুরির সহায়তা এবং কোনাে সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই বিচার করতে পারবে।
[5] সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধ: কোনাে সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারবে না।
[6] নিষেধাজ্ঞা: রাওলাট আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনীতি, শিক্ষা বা ধর্মসংক্রান্ত কোনাে কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। তা ছাড়া এই আইনে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির মুক্তির জন্য অর্থ জমা দিতে হত।
[7] মুক্তির জন্য অর্থদণ্ড: রাওলাট আইনে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির মুক্তির জন্য অর্থ জমা দিতে হত।
[8] আপিলে নিষেধাজ্ঞা: রাওলাট আইনের দ্বারা যে-সব বিচার-কার্য সম্পন্ন হবে, সেই বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে কোনাে উচ্চতর আদালতে আপিল মামলা দায়ের করা যাবে না।
নগ্ন দমনমূলক রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে ভারতে সর্বত্র তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ঐতিহাসিক এইচ. এইচ. ডডওয়েল বলেছেন যে, “এক সংকটজনক মুহূর্তে কুখ্যাত রাওলাট আইন ভারতে সর্বজনীন প্রতিরােধ গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।”
[1] নেতৃবৃন্দের প্রতিবাদ: কুখ্যাত রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কেন্দ্রীয় আইনসভার সকল বেসরকারি সদস্য রাওলাট আইনের বিরােধিতা করেন। নরমপন্থী হিসেবে পরিচিত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই আইনের প্রতিবাদ করেন। বােম্বাই হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার নারায়ণ চন্দ্রভারকার এই আইনকে ‘অনাবশ্যক’ ও ‘অসংগত’ বলে অভিহিত করেন।
[2] গান্ধিজির ভূমিকা: গান্ধিজি অত্যাচারী রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন যে, যে সরকার শান্তির সময় এই ধরনের নির্মম আইনের আশ্রয় নিয়েছে, সেই সরকার কখনােই নিজেকে সভ্য সরকার বলে দাবি করতে পারে না। তিনি এই আইনকে ‘উকিল নেহি, দলিল নেহি, আপিল নেহি’ বলে মন্তব্য করেন। এই আইনের প্রতিবাদে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেন।
[3] আইন পরিষদ ত্যাগ: রাওলাট আইনের প্রতিবাদে মহম্মদ আলি জিন্না, মদনমােহন মালব্য এবং মাজহার-উল-হক আইন পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। জিন্না বলেন যে, যে সরকার দেশে শান্তির সময় এরূপ নির্যাতনমূলক আইন পাস করেছে সেই সরকার নিজেকে কখনােই ‘সভ্য সরকার’ বলে দাবি করতে পারে না। লালা লাজপৎ রায় বলেন যে, এই আইনের ফলেই আবার নতুন করে বিপ্লবী কার্যকলাপ শুরু হবে।
[4] সংবাদপত্রের প্রতিবাদ: বিভিন্ন সংবাদপত্র রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ ‘হিন্দু’, ‘দ্য নিউ ইন্ডিয়া’, ‘বােম্বাই ক্রনিক্যাল’, ‘কিশােরী’ প্রভৃতি সংবাদপত্রে এই আইনের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। রাওলাট আইনকে অমৃতবাজার পত্রিকা ‘এক ভয়াবহ ভ্রান্তি’ (A Gigantic Blunder) ও ‘কেশরী পত্রিকায় উৎপীড়নের দানবীয় যন্ত্র’ বলে অভিহিত করে।
[5] জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড: কুখ্যাত রাওলাট আইন ও অন্যান্য কয়েকটি ঘটনার প্রতিবাদে ১৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে সাধারণ মানুষের একটি শান্তিপূর্ণ জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশের নিরস্ত্র জনতার ওপর সরকারের পুলিশ মাইকেল ও ডায়ারের নেতৃত্বে নির্বিচারে গুলি চালালে অন্তত এক হাজার মানুষের মৃত্যু ও প্রচুর মানুষ আহত হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরকারের দেওয়া নাইট’ উপাধি ঘৃণাভরে ত্যাগ করেন। ড. বিপান চন্দ্র লিখেছেন যে, এই আন্দোলনের মাধ্যমে “সারা দেশে যেন বৈদ্যুতিক তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল। ভারতীয়রা আর বিদেশি শাসনের কাছে নতি স্বীকার করতে রাজি নয়।”