রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল সামাজিক বিজ্ঞান। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনাক্ষেত্রের পরিধি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেনি, যুগ ও সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তিত হয়েছে। তাই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার পরিধিকে ‘সতত পরিবর্তনশীল” বলে আখ্যা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােনাক্ষেত্রকে কয়েকটি ভাগ ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন一
[1] রাষ্ট্র, সরকার, আইন এবং বিচারব্যবস্থা: প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, মানুষ ভালােভাবে বাঁচতে চায়। মানুষের এই প্রয়ােজন পূরণের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। মানুষের জীবন রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। ফলে রাষ্ট্রই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান আলােচ্য বিষয়। কিন্তু রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয় সরকারের মাধ্যমে। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যপূরণের জন্য সরকার আইন প্রণয়ন ও প্রয়ােগ করে। আইনের ব্যাখ্যা করা ও আইনভঙ্গকারীদের শাস্তিবিধানের জন্য বিচারব্যবস্থার প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। কাজেই রাষ্ট্রের সঙ্গে সরকার, আইন এবং বিচারব্যবস্থা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
[2] রাজনৈতিক মতবাদ: রাজনৈতিক চিন্তা এবং মতবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার একটি ঐতিহ্যশালী দিক। প্লেটো, অ্যারিস্ট, ম্যাকিয়াভেলি, হবস, লক, রুশাে, জন স্টুয়ার্ট মিল, কার্ল মার্কস ও অন্যান্য দার্শনিক যে চিন্তাভাবনা ব্যক্ত করেছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তার গুরুত্ব অপরিসীম।
[3] আন্তঃবিষয় আলােচনা: রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞানের একটি শাখা। তা সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। আমরা জানি, আন্তঃবিষয় আলােচনা একে অপরকে সমৃদ্ধ করে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় আন্তঃবিষয় সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে।
[4] প্রতিনিধিত্ব, রাজনৈতিক দল ও জনমত: জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে পরােক্ষ বা প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রের প্রবর্তন ঘটেছে। পরােক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে দলব্যবস্থা ওতপ্রােতভাবে জড়িত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমতও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। কারণ, ক্ষমতায় কোন্দল আসীন হবে তা জনমতই নির্ধারণ করে। কাজেই প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক দল এবং জনমত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় স্থান করে নিয়েছে।
[5] আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও প্রতিষ্ঠান: বর্তমানে কোনাে দেশই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রকেই নিজস্ব প্রয়ােজনে কোনাে-না-কোনাে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি মেনেই এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নামও উল্লেখ করতে হয়। সুতরাং, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আইন ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলােচনা করে।
[6] মূল্যমান: রবসন, গ্রিভস প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বক্তব্য হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান কেবল কী আছে অর্থাৎ সমসাময়িক বিষয়গুলি নিয়েই কেবল আলােচনা করে না, কী হওয়া উচিত সে বিষয়েও আলােচনা করে। একারণেই বলা যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা মূল্যমান-নিরপেক্ষ নয়।
[7] তুলনামূলক রাজনীতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জনকল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছেন। এ কাজে তাদেরকে অতীত, বর্তমান এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে আলােচনা করতে হয়। সুতরাং, তুলনামূলক রাজনীতির আলােচনাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় স্থান করে নিয়েছে।
[8] আচরণবাদীদের অভিমত: বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে গ্রাহাম ওয়াক্স, আর্থার বেন্টলে, চার্লস মেরিয়াম, এইচ লাসওয়েল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর আচরণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার ক্ষেত্রে আধুনিকতা নিয়ে আসেন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও সংখ্যায়নের প্রয়ােগ ঘটিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনাকে এঁরা মূল্যমান-নিরপেক্ষ করে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। এঁদের চিন্তাধারাই আচরণবাদ নামে পরিচিত।
[9] মার্কসবাদীদের অভিমত: মার্কসবাদীদের অভিমত অনুযায়ী, সমাজের চরিত্র নির্ধারিত হয় উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা। শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় মালিক শ্রেণি শােষণ ও শাসনকে অব্যাহত রাখার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের অনুকূলে রাখার চেষ্টা করে। অন্যদিকে, শ্রমিক শ্রেণি শােষণ থেকে মুক্তির জন্য বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ফলে শ্রেণিসংগ্রাম, বিপ্লব, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে।
[10] বিশ্বায়ন: বর্তমানে বিশ্বায়নের প্রভাবকে কোনাে রাষ্ট্রই অস্বীকার করতে পারে না। বিশ্বায়নের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে বাণিজ্যের সম্প্রসারণের চেষ্টা চলছে। কাজেই বিশ্বায়ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় স্থান করে নিয়েছে।
উপসংহার: অধ্যাপক ল্যাঙ্কি বলেছেন “সংগঠিত রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে মানবজীবনের আলােচনাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান। আমরা আলােচ্য বিষয় থেকে মানবজীবনকে প্রভাবিত করে, এমন কোনাে কিছুই বাদ দিতে পারি না।” বস্তুত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা কোনাে সুনির্দিষ্ট সূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। যে সমাজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান তার রসদ সংগ্রহ করে, তা অত্যন্ত গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনাক্ষেত্রের পরিধি অপরিবর্তিত থাকা সম্ভব নয়৷