ভাষা নদীস্রোতের মতই চিরপ্রবহমান। এর গতিপথে যেমন ভিন্ন ভাষার্রোত এসে এর সঙ্গে উপনদীর মতাে মিশ্রিত হয় তেমনি ভিন্নতর শাখারূপেও এর অনেক শ্রােতােধারারও সৃষ্টি হয়ে থাকে। কখনাে বা নদীতে বাঁধ বেঁধে তার কিছু জলকে হ্রদের মতাে আবদ্ধ করে রাখা হয়, কিন্তু কোন বিপর্যয় না ঘটলে নদীর মূল ধারা শুধু এগিয়েই চলে-এর গতিপথ সরল না হতে পারে, কোথাও বাঁক ফিরতে পারে, অঞ্চল বিশেষে এই স্রোতােধারা ভিন্ন নামেও পরিচিত হতে পারে, কিন্তু মূল নদীটি অখণ্ডপ্রবাহে বয়ে চলতে থাকে যেখানে সে বাঁক ফিরেছে সেখানে ভিন্ন নামে পরিচিত হালেও ধারাটি কিন্তু অবিচ্ছিন্ন প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা তাই অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষায় যখন রূপান্তরিত হলাে, কালের বিচারে সে সময়টা আনুঃ খ্রীঃ পূঃ যষ্ঠশতক নামের বিচারে তাকে বলা হয় ‘প্রাকৃত’। এই মধ্য ভারতীয় আর্যভাষাও সুদীর্ঘকালে বিবর্তিত হতে হতে প্রায় দেড় হাজার পর বাঙলা নব্য ভারতীয় ভাষায় পরিণতি লাভ করে।
খ্রীঃ পূঃ পঞ্চদশ শতক থেকে খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক— এই সহস্রাব্দকাল বিস্তৃত প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা কালে প্রাকৃত তথা মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার রূপান্তরিত হবার পর তার স্থিতিকাল ছিল আরাে অন্ততঃ দেড় হাজার বছর। এই সুদীর্ঘ কালের ব্যবধানে ভাষাদেহে অনেক নতুন লক্ষণ প্রকটিত হওয়াতে ‘প্রাকৃত’ তথা ‘মধ্যভারতীয় আর্যভাষা’ (Middle Indo Aryan, M.I.A) অন্ততঃ তিনটি স্তরে বিবর্তিত হয়েছিল বলা যেতে পারে। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ট শতক থেকে খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত ‘আদিস্তর’, খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রীষ্টোত্তর দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত ‘ক্রান্তিকাল’ খ্রীঃ দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রীঃ ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত ‘মধ্যস্তর’ এবং খ্রীঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রীঃ দশম শতক পর্যন্ত ‘অন্ত্যস্তর’।
প্রাকৃতের আদিস্তরে ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায় ‘পালিভাষা’য় রচিত বৌদ্ধদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও কাহিনীতে এবং অশােকেরও সমসাময়িক কালে রচিত শিলালিপিতে। অশােকের সমকালেই যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতের বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তৎকালীন শিলালিপিগুলির ভাষা-বিচারে। উত্তরপ্রদেশের যােগীমারা গুহায় ‘শুতনুকা’ (সুতনুকা) নামে যে শিলালিপিটি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার ভাষাকে বলা হয়েছে ‘পূর্বীপ্রাচ্যপ্রাকৃত’। এই ‘সুতনুকা’ লিপির ‘প্রাচ্য প্রাকৃত’ থেকেই ব্রম-বিবর্তনে বাঙলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে এরূপ অনুমান করা হয়। এ ছাড়া অন্যান্য শিলালিপিতে অন্যান্য অঞ্চলের ভাষারূপ বিধৃত হয়েছে। তাদের ‘উদীচ্যা-প্রাকৃত’ ‘প্রাচ্যা-প্রাকৃত’, নামে অভিহিত করা হয়।
আদিস্তরের প্রাকৃতের বিবর্তিত রূপের পরিচয় পাই মধ্যস্তরের প্রাকৃত। মধ্যস্তরের প্রাকৃতের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় সংস্কৃত ভাষার রচিত বিভিন্ন নাটকে এবং প্রাকৃত কাব্য-মহাকাব্যে। সংস্কৃত নাটকের মহিলা চরিত্রের এবং অশিক্ষিত পুরুষ চরিত্রের মুখে বিভিন্ন প্রাকৃত ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণভাবে মধ্যস্তরের এই প্রাকৃত ভাষাকে বলা হয় ‘সাহিত্যিক প্রাকৃত’। নাটকে ব্যবহৃত প্রাকৃতগুলির মধ্যে রয়েছে—নারীমুখের ভাষায় ‘শৌরসেনী প্রাকৃত’ গীতের ভাষায় ব্যবহৃত ‘মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত’ এবং অশিক্ষিত পুরুষের মুখে মাগধী প্রাকৃত। মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে স্বাধীনভাবে কাব্য-মহাকাব্যদি রচিত হলেও কোন সাহিত্য পাওয়া যায়না। জৈনধর্মাবলম্বীগণ ‘অর্ধমাগধী’ প্রাকৃতে তাঁদের বহু শাস্ত্রগ্রন্থাদি রচনা করে গেছেন। পৈশাচী প্রাকৃতে গুণাঢ্য ‘বড্ডাকহা’ (বৃহৎকথা) নামে এক অতি বৃহৎ কাহিনী সংকলন রচনা করেছিলেন বলে জানা যায় কিন্তু গ্রন্থটি পাওয়া যায়নি। এই মধ্যস্তরের প্রাকৃতই আবার ক্রমবিবর্তিত হয়ে অন্ত্যস্তরে পরিণতি হয়েছে। এই মধ্যস্তরের মাগধী প্রাকৃত আদি স্তরের পূর্বী প্রাচ্যার প্রত্যক্ষ বংশধর, এই ভাষা থেকে অথবা সমকালের বৈয়াকরণ-কথিত ‘গৌড়ী প্রকৃত’ থেকে ক্রমবিবর্তনে বাঙলা ভাষার উদ্ভব।
অন্ত্যস্তরের প্রাকৃতের সাধারণ প্রচলিত নাম ‘অপভ্রংশ’ এবং ‘অপভ্রংশে’র অর্বাচীন রূপকে বলা হয় ‘অবহটঠ’ (অপভ্রষ্ট)। তাত্ত্বিক দিকে থেকে প্রতিটি প্রাকৃতেরই অপভ্রংশ রূপ স্বীকার করা হয় বলে ‘শৌরসেনী অপভ্রংশ’ ও ‘মাগধী অপভ্রংশের’ কথা বলা হয় কিন্তু কার্যতঃ শৌরসেনী ছাড়া অপর কোন অপভ্রংশ বা অবহটঠ ভাষার নিদর্শন বাস্তবে পাওয়া যায় না। শৌরসেনী অবহটঠ একসময় সমগ্র উত্তর ভারতে শিষ্টজনসম্মত সাহিত্যের ভাষারূপে প্রচলিত ছিল। এই অবহটঠভাষা থেকেই আনুমানিক খ্রীঃ দশম শতকের দিকে নব্য ভারতীয় আর্যভাষাসমূহের উদ্ভব ঘটে। অপর একটি অনুমান, বৈয়াকরণগণ বলেন, ঐ সময় ‘দেশী’ নামে একটি জনপদ ভাষা ছিল, সম্ভবত, এটি গৌড়ী অপভ্রংশ অথবা অর্বাচীন গৌড়ী প্রাকৃত-যা থেকে সরাসরি বাঙলা ভাষার উদ্ভব ঘটা সম্ভব। আচার্য সুকুমার সেন বলেন, “নব্য ভারতীয় আর্যের উদ্ভবের সময় ভাষাগুলির মধ্যে যে সাধারণ লক্ষণ ছিল সেইগুলির প্রতি লক্ষ রাখিয়া এই সময়ের ভাষাগুচ্ছকে একটি বিশিষ্ট ভাষার সন্তান বলিয়া গণ্য করিতে হয়, ভাষাতত্ত্বের দিক দিয়া আলােচনার সুবিধার জন্য এই কাল্পনিক ধাত্রী ভাষাটিকে বলা হইল প্রত্ব নব্য ভারতীয় আর্য (Proto-New Indo-Aryan)। অপভ্রষ্টের দ্বিতীয় বা শেষ স্তর হইল এই প্রত্ন নব্য ভারতীয়”।
প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার কথ্য রূপটি খ্রীঃ পূর্ব শতাব্দীতে যে সকল আঞ্চলিক প্রাকৃতে পরিণতি লাভ করে তাদের মধ্যে ছিল ‘শুতনুকা লিপিতে প্রাপ্ত পূর্বীপ্রাচ্যা’। লক্ষণ বিচারে দেখা যায় এই পূর্বাপ্রাচ্যই পরবর্তী পর্যায়ে ‘মাগধী-প্রাকৃত’ নামে সাহিত্যিক প্রাকৃতে এবং গৌড়ী প্রাকৃতে রূপ লাভ করে। অনুমিত হয়, এই মাগধী বা গৌড়ী প্রাকৃতই কালক্রমে গৌড়ী অপভ্রংশ ‘মাগধী অপভ্রংশ’ ও তা থেকে ‘মাগধী অবহট্টে’ পরিণত হয়। মাগধী বা গৌড়ী অবহটঠ যে প্রত্ন নব্য ভারতীয় আর্যভাষায় রূপান্তরিত হয়, সেটিই মালবে প্রাপ্ত শিলালিপির, ‘গৌড়ী’ ভাষা। এটি থেকেই পূর্ব ভারতীয় বাঙলা,অসমিয়া,ওড়িয়া এবং মৈথিলি, মাহী ভােজপুরিয়া-আদি বিহারী ভাষাগুলি উদ্ভব ঘটে। অতএব ধারাবাহিকতার বিচারে আমরা বাঙলা ভাষার কুলপরিচয় নির্ণয় করতে পারি নিম্নোক্ত ক্রমে। বৈদিক যুগের কথ্যভাষা পরবর্তী স্তরে ‘শুতনুকা লিপি’তে প্রাপ্ত ‘পূর্ব-প্রাচ্যার’ মধ্য দিয়ে মাগধী ও গৌড়ী প্রাকৃত, মাগধী বা গৌড়ী অপভ্রংশ ও মাগধী বা গৌড়ী অবহটঠের স্তর হায়ে প্রত্ন নব্য ভারতীয় গৌড়ীভাষা থেকে প্রাচীন বাঙলা ভাষার উদ্ভব ঘটে।
বাঙলা ভাষাও হাজার বৎসরে অনেকখানি পরিবর্তিত হওয়ায় ভাষায় পরিবর্তন অনুযায়ী তাকে আদিযুগ, আদি-মধ্যযুগ অন্ত-মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ এই চারটি পর্বে বিভক্ত করা হয়। প্রতি পর্বেই ভাষাগত পরিবর্তন লক্ষণীয়।
বাঙলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন ‘চর্যাপদ’- আনুমানিক খ্রীঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত হয়। এই কালটিকে বলা হয় বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের আদিযুগ। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ সদ্য-উদ্ভূত বাঙলা তাঁদের সাধন-ভজন বিষয়ক তত্ত্বাদি এই গ্রন্থে বিভিন্ন পদের আকারে রচনা করেছিলেন চর্যাপদ ধর্মীয় সাহিত্য। খ্রীঃ ত্রয়ােদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর অর্ধাংশ পর্যন্ত ছিল ক্রান্তিকাল। একালে রচিত কোন রচনার নিদর্শন সুলভ নয়। এরপর ১৩৫০ খ্রীঃ থেকে ১৪০০ খ্রীঃ পর্যন্ত বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যযুগ। এর মধ্যে আবার ১৫০০ খ্রীঃ পর্যন্ত আদিমধ্যযুগ বা চৈতন্য-পূর্ব যুগ। এই যুগের উল্লেখযােগ্য সাহিত্য বডু চণ্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বিদ্যাপতির ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ কিছু অনুবাদ সাহিত্য এবং কয়টি প্রধান মনসামঙ্গল কাব্য। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাঙলা সাহিত্য ও সমাজে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে। ফলে, বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের গুণগত এবং পরিমাণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল অনেকখানি। অন্ত্য-মধ্যযুগে তথা চৈতন্যোত্তর যুগে জীবনী সাহিত্য, পদাবলী সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য, বিভিন্ন ধারার মঙ্গলকাব্য ও নানাজাতীয় লােক সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। ১৮০০ খ্রীঃ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে গদ্য-সাহিত্যের উদ্ভব এবং তার পরই পাশ্চাত্ত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাঙলা সাহিত্যে যে বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়, তাকেই বলা হয় ‘আধুনিক যুগ’। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যও বিভিন্ন পর্যায়ে যুগােপয়ােগীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
বৈদিক যুগ থেকে এক অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে ভাস্রোত একাল পর্যন্ত চলে এসেছে—মাঝে মাঝে এর রূপান্তর লাভের সঙ্গে সঙ্গে নামেরও পরিবর্তন ঘটেছে। তাই ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে বলা যায় যে সংস্কৃত ভাষা হােল সাহিত্যিক ভাষা যা পরে মাতৃভাষা হয়ে গিয়েছিল। ফলে জীবন্ত ভাষার মত তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এবং তা থেকে কোন ভাষার জন্ম হয়নি। বস্তুত বৈদিক ভাষাই ছিল জীবন্ত ভাষা। এরই যে কথ্য ভিত্তি ছিল তারই বিবর্তনের ধারায় মধ্যবর্তী স্তর হয়ে বাংলা প্রভৃতি নব্যভারতীয় আর্যভাষাগুলির জন্ম হয়েছে। সুতরাং জন্মসূত্র বিচারে বৈদিক ভাষাকেও বাংলা ভাষার জননী বলা যায় না। জন্ম উৎস বিচারে বলতে হয় বৈদিক ভাষার কথ্যরূপ থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম।