ঐতিহাসিক উপন্যাসকে নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞায় বিভূষিত করা যায় না। তথাপি আমরা এর আঙ্গিক ও বিষয়ের উপর দৃষ্টি আরােপ করে ধারণাগত একটা সংজ্ঞা রচনা করতে পারি ইতিহাসের কাহিনি ও চরিত্রকে আশ্রয় করে তার লেখক যখন ইতিহাসের অন্তরলােকে উকি দিয়ে একটি বিশেষ যুগ ও তার কিছু ঘটনা এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, আশা নিরাশার কথা ফুটিয়ে তােলেন তখন তাকে বলা হবে ঐতিহাসিক উপন্যাস।
বস্তুত ইতিহাসের বিশাল পটভূমিতে পারিবারিক জীবনের ছবি আঁকা খুবই কঠিন। ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন দৈনন্দিন জীবনের সংযােগ সাধনের অনিবার্যতা বুঝে নেওয়াও অনেক সময় সহজ হয় না।
ঐতিহাসিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য:
একটা সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য কি কি হওয়া আবশ্যক তা সূত্রাকারে নিম্নে দেওয়া হল-
-
সমসাময়িক জীবনের বিষয় বস্তু বা বাস্তব চরিত্র সমূহের পরিবর্তে ঐতিহাসিক উপন্যাসে উপন্যাসকার বেছে নেন অতীত ইতিহাসের কোনও একটি বিশেষ সময় পর্ব।
-
উপন্যাসের বর্ণিতব্য যুগ তথা ঘটনা-কাহিনির প্রতি তাঁকে বিশস্ত থাকতে হয় সেই সময় কালের রীতি-নীতি, আচার ব্যবহার সংস্কার পােশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি সকল বিষয়ে লেখককে সচেতন থাকতে হয়।
-
ঐতিহাসিক উপন্যাসের নায়ক নায়িকা তথা প্রধান কুশীলব সকলেই হন ইতিহাসের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁরা কেউ আপন কীর্তির বলে কীর্তিমান আবার কেউ দরুণ।এইসব চরিত্রের রূপায়ণে ঔপন্যাসিকে ইতিহাসের প্রতি যথাসম্ভব বিশ্বস্ত থাকতে হয়।
-
ইতিহাসাশ্রিত চরিত্রগুলির ঐতিহাসিকতা যথাসম্ভব অক্ষুন্ন রেখেও তাদের যথেষ্ট প্রাণবন্ত করে তােলা ও উপন্যাসে জীবন ভাবনা ব্যক্ত করার ক্ষমতাই ঐতিহাসিক উপন্যাস কারের কাছ থেকে প্রত্যাশিত।
-
ঐতিহাসিক উপন্যাসের কারবার ঐতিহাসের বিশাল পটভূমিতে আবর্তিত জীবনের উত্থান পতন নিয়ে। ইতিহাসের সামাজিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত, আবেগ আলােড়ন এই জাতীয় উপন্যাসের প্রধান অবলম্বন।
-
ঐতিহাসিক উপন্যাসে থাকে মহাকাব্যিক বিস্তার ; একটি বিশেষ স্থান কালের সীমা অতিক্রম করে উপন্যাস পায় বিশ্বজনীন ব্যাপ্তি।
বঙ্কিমচন্দ্রের রাজসিংহ ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসটির কাহিনি, ভাষা ও গঠন কৌশল দেখে সহজেই সবাই ‘চন্দ্রশেখরকে’ ঐতিহাসিক উপন্যাসরূপে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র রাজসিংহ উপন্যাসের ভূমিকায় বলেছেন- “পরিশেষে বক্তব্য যে আমি পূর্বে কখনও ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখি নাই। ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ বা ‘চন্দ্র শেখর’ বা সীতারামকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাইতে পারে না। এই প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিলাম।”
উপকাহিনি (Sub-Plot) কাকে বলে? উপন্যাসের উপকাহিনি কীভাবে যুক্ত থেকে সাহায্য করে? তােমার পাঠ্য যে-কোনাে একটি উপন্যাসের উপকাহিনির গুরুত্ব বুঝিয়ে দাও।
যে কাহিনি মূল কাহিনিকে গতি দেয় সাধারণভাবে তাকে উপকাহিনি বলে। উপন্যাসের মূল আকর্ষণীয় বিষয় হল গল্প বা কাহিনি। কার্যকারণ ও কাল পারস্পর্যে উপন্যাসের কাহিনি সুসংবদ্ধতা অর্জন করলে তাকে যথাযথ প্লট বা কাহিনি বলে। এই প্লট বা কাহিনি যখন কোনও কারণে নিজস্ব গতি হারিয়ে ফেলে তখন আসে উপকাহিনি। কারণ একটি গাছকে তার শাখা প্রশাখা বাড়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে এখানে মূল কাহিনি গাছ আর তার উপকারিতা হল শাখা।
কাহিনির ঐক্যের বিচারে উপন্যাসের প্লট দুধরনের হয়- সরল ও যৌগিক। সরল প্লটে একটিমাত্র কাহিনি উপস্থাপিত হয়, যার সহায়ক অন্য কোনও কাহিনি সূত্রে থাকে না। যৌগিক প্লটে একটি প্রধান কাহিনির সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে একাধিক উপকাহিনি যুক্ত হয়ে ঐক্যতা বিধান করা। এই উপকাহিনি বা Sub-plot এর লক্ষ্য হল মূল কাহিনিকে গতি দেওয়া।