ইংরাজদের সঙ্গে নবাবের সমূহ যুদ্ধে বিরত থাকতে দলনী অন্তঃপুর ত্যাগ করে বাদী কুলসমকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে সেনাপতি এবং ভ্রাতা গুরগন খাঁর নিকট এসেছিলেন, কিন্তু গুরগন খাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি বুঝলেন সেনাপতি সম্প্রতি নবাবের সঙ্গে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন। সংবাদটি তিনি নবাবের নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্য দ্রুত দূর্গাভিমুখে ধাবিত হলেও গুরগনের নির্দেশে দ্বাররক্ষক ফটক বন্ধ করে দিয়েছিল। দলনী দূর্গমধ্যে প্রবেশ না করতে পেরে বিষম বিপদের সম্মুখীন হলেন এবং কুলসমকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে কালযাপনে সংকল্প নিলেন। অকস্মাৎ এক ব্রহ্মচারী অর্থাৎ চন্দ্রশেখরের সেখানে আবির্ভাব ঘটে এবং তিনি তাঁদের দুজনকে নিয়ে নিকটস্থ প্রতাপের বাসায় নিয়ে গেলেন। রাতটুকু অতিবাহিত করার জন্য। অতঃপর তিনি দলনী সম্পর্কিত সবিস্তারে লিখে নবাবকে পত্র লিখে কর্মচারী মারফৎ পাঠিয়ে দিলেন।
প্রতাপ সদ্যুবৃত্তি করে সেই রাতে শৈবালিনীকে ইংরাজ নৌকা থেকে উদ্ধার করে নিজের বাসায় এনে রেখেছিলেন। ইংরাজ এরই সমুচিত জবাব দিতে অতর্কিতে প্রতাপকে আক্রমণ করেন, এবং প্রতাপকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার সময় দলনীকে শৈবালিনী ভেবে তাঁকে ও কুলসমকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। পরদিন প্রাতে নবাবের কর্মচারীরা ব্রষ্মচারীকে চিঠির নির্দেশে দলনীকে নিতে এলো। শৈবালিনী দলনী সেজে নবাবের নিকট হাজির হলেন। শৈবালিনীর নিকট দলনীর অপহূতা হওয়ার ঘটনা নবাব সবিস্তারে শুনলেন, এবং ইংরাজদের প্রতি ক্রোধবশতঃ নবাব দলনীকে উদ্ধারের জন্য তকি খাঁকে নিযুক্ত করলেন। তকি খা ইংরাজদের সঙ্গে সদলবলে সংঘর্ষে লিপ্ত হলেন। অমিয়ট, জনসন প্রভৃতি ইংরাজ সায়েবকে যুদ্ধে পরাস্থ করে নিহত করার পরও যখন দলনীকে পেলেন না তখন তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। দলনী তখন লরেন্স ফষ্টরের নৌকাতে করে কলিকাতাভিমুখে ধাবমান হয়েছেন। সে নৌকার সন্ধান তকি খাঁ পাইনি বা তাঁর নাগালের বাইরে ছিল। তকি খ দলনীকে উদ্ধারে এসে ব্যর্থ হয়েছেন, সে ব্যর্থতা ঢাকতে মিথ্যার আশ্রয় নিলেন। নবাবকে পত্র লিখে জানালেন– দলনী এখন অমিয়টের উপপত্নী, তিনি কিছুতেই নবাবের নিকট আর ফিরতে চান না। তবুও তাঁকে জোর করে ধরে নিয়ে মুঙ্গেরে আটক করে রাখা হয়েছে নবাব যদি হুকুম করেন তবে নবাব সমীপে দলনীকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
ফষ্টরের নৌকাতে যেতে যেতে তাঁর দাক্ষিণ্যে দলনী মুক্ত হয়ে নির্জন নদীতীরে নৌকা থেকে একাকিনী অবতরণ করেছিলেন। কুলসম কিন্তু দলনীর সঙ্গে না নেমে ফষ্টরের নৌকাতে রয়ে গেল, তার উদ্দেশ্য বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। দলনী অবশ্য ব্রহ্মচারীর বা চন্দ্রশেখরের সাহায্যে মুর্শিদাবাদে নবাব সমীপে হাজির হতে যাত্রা করেন। এদিকে নবাব যখন তকি খাঁর নিকট পত্র মারফৎ জানলেন দলনীর ব্যাভিচারিতার কথা তখন তিনি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দলনীকে বিষপানে হত্যার জন্য তকি খাঁকে নির্দেশ দেন। দলনীর প্রতি ছিল তকি খাঁর গোপন আসক্তি। তিনি দলনীকে নির্দেশ দিলেন, মৃত্যুদণ্ড এখনই রদ হতে পারে, যদি দলনী এখনি তকি খাঁকে ভজতে সমর্থ হয়। ঘৃণায় ফুৎকারে তকি খাঁকে ভর্ৎসনা করে দলনী তাঁর নবাবরূপী প্রভুকে সম্মান জানাতে এবং আদেশকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে নিজ থেকেই দাসী মারফৎ বিষ সংগ্রহ করেন এবং অবিলম্বে বিষপান করে আত্মহত্যা করেন।
এদিকে নবাব গুরগন খাঁ ও তকি খাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরাজদের সঙ্গে কাটোয়ার যুদ্ধে পরাস্থ হয়েছেন। আগামী যুদ্ধে হাল ধরার মতো যোগ্য ব্যক্তি তার নেই। গুরগন খাঁ, তকি খাঁ এখন তাঁর পরম শত্রু। এইসময় কুলসম হেস্টিংসের সঙ্গে সাক্ষাত করে ফষ্টরের যাবতীয় কুকর্মের সাক্ষ্য দিতে নবাবের সমীপে হাজির হন এবং নবাবকে অবগত করেন- মীরকাসেম বাংলার নবাব হলেও তিনি মূর্খ। কারণ, দলনীর মতো সতীসাধ্বী স্ত্রীকে তিনি বিনাদোষে প্রাণদণ্ড দিয়েছেন। অতঃপর নবাব শুনলেন কুলসমের কাছে– নবাবের জন্য দলনীর প্রচেষ্টা, উৎকণ্ঠা, সাধনা এবং কীভাবে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে নিজেকে শুচিশুদ্ধ রূপে প্রতিস্থাপন করেছেন প্রভৃতি কাহিনি। নবাব বুঝলেন দলনীর এমনভাবে অকালে চলে যাওয়ার পশ্চাতে দুজন দায়ী– লরেন্স ফক্টর ও তকি খাঁ। তিনি হুকুম জারি করলেন ফষ্টরকে ধরে আনতে সেইসঙ্গে সত্য ঘটনা উদ্ঘাটনে শৈবালিনী ও ব্রহ্মচারীরূপী চন্দ্রশেখরকে দরবারে হাজির করাতে নির্দেশ দিলেন।
কিন্তু নবাব পরমুহূর্তে আরও বিস্মিত হন। যখন তিনি শুনলেন স্বসৈন্যে গুরগন খাঁ ফৌজসহ উদয়নালায় যাত্রা করেছেন, অর্থাৎ নবাবের সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষত চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন। সেনাপতির এমন বিশ্বাসঘাতকতায় কার্যত নবাব ভেঙে পড়লেন, দলনীর প্রতি কৃতকর্মে তিনি নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকলেন– “তখন নবাব রত্নসিংহাসন ত্যাগ করিয়া উঠিলেন, হীরক খচিত উষ্মীষ দূরে নিক্ষেপ করিলেন- মুক্তার হার কণ্ঠ হইতে ছিঁড়িয়া ফেলিলেন- রত্নখচিত বেশ অঙ্গ হইতে দূর করিলেন। তখন নবাব ভূমিতে অবলুণ্ঠিত হইয়া দলনী! দলনী! বলিয়া উচ্চৈস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন।”
লেখক নবাব মীরকাসেমের দলনী সম্পর্কে এই ভাবাত্তরের বর্ণনা দিতে গিয়ে বললেন– “এ সংসারে নবাবি এইরূপ।” আক্ষরিক অর্থে তিনি বোঝাতে চাইলেন, সিংহাসনে আসীন থাকাকালীন যে কোনো নবাবের কত না প্রতিপত্তি। তিনি দেশের তথা সমগ্র মানুষের বিচারকর্তারূপে অধিষ্ঠিত হতে থাকেন। কিন্তু সেই নবাবের যখন ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় আসন্ন হয়ে আসে তখন শাসনকর্তা থেকে ঘটে তার অতি সাধারণে অবতরণ। কেউ তাঁকে ভূক্ষেপ করেন না। নবাব মীরকাসেমের ক্ষেত্রেও তদ্রূপ বিষয় লক্ষিত হয়। তিনি নবাবের মতোই সার্থক বিচারের দ্বারা আপন প্রিয়তম পত্নীকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন যথার্থ প্রমাণের অপেক্ষা না রেখে। কিন্তু যখন তিনি জানলেন সেনাপতির চক্রান্তে তিনি অবিলম্বে সিংহাসনচ্যুত হতে চলেছেন, এবং দলনী সম্পূর্ণরূপে নিষ্পাপ, এক তীব্র ঝড়ে বাতি নিভে যাবার মতো মীরকাসেমের মধ্যেকার নবাবীই ধারা তিরহিত হয়ে সাধারণের মতো ভবিষ্যৎ দুর্দশার কথা ভেবে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। এটাই হল এ সংসারের নবাবি বৈশিষ্ট্য।