‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসের নায়িকা শৈবালিনী। এ চরিত্রটি জটিল অথচ বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল, অনন্যা। বলিষ্ট ব্যক্তি স্বাত্যন্ত্রই শৈবালিনী চরিত্রের কেন্দ্রিয় সত্য। শৈবালিনী কেবল স্বাতন্ত্র্যমর্মী নারীই নয়, সে অদ্ভুত গতিচঞ্চলা, দূরস্ত গতিশীলা শৈবালিনীর জটিল চরিত্রকে জটিলতর করে তুলেছে। তবে উপন্যাসের প্রথম থেকেই শৈবালিনীর কমনীয়তা চোখে পড়ার মতো। কামনাপদ্ম শত পাপনি বিকশিত করে তখনো পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়নি। অথচ মুদিত কলিকাটির মধুগন্ধ প্রথম হতে সকলের চিত্ত হরণ করে। সপ্রতিভ, চঞলা, কৌতুকের দীপ্তিতে উজ্জ্বল বালিকা শৈবালিনী প্রথম দর্শনেই আমাদের মুগ্ধ করে। ক্রমেই শৈবালিনীর চিত্তপদ্ম বিকশিত হল। আকস্মিক দর্শনে তিনি প্রতাপের প্রেমে পড়েননি। কৈশোর হতে যৌবন বিকাশের ছন্দে ছন্দে তার এই ভালোবাসা সমগ্র অস্তিত্বকে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে। অর্থাৎ শৈবালিনীর প্রেম বাল্য হতেই দৃঢ়তাপ্রাপ্ত হয়েছে।
প্রতাপের সঙ্গে শৈবালিনীর বিবাহ অনিশ্চিত হয় সামাজিক আত্মীয়তার কারণে। উভয়েই তাঁদের ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে ডুবে মরতে গেলেন। প্রতাপ ডুবলেন, কিন্তু শৈবালিনী ডুবতে পারলেন না। কারণ– “সেই সময়ে শৈবালিনীর ভয় হইল। মনে ভাবিলেন কেন মরিব? প্রতাপ আমার কে? আমার ভয় করে, আমি মরিতে পারিব না। শৈবালিনী ডুবিল না ফিরিল।” অর্থাৎ শৈবালিনী নিজের প্রাণের মায়ায় মরতে পারেননি, তার প্রেম স্থূলবাসনা সদৃশ, তাই তিনি এক্ষেত্রে নিন্দনীয়।
এই ঘটনার পর চন্দ্রশেখরের সঙ্গে শৈবালিনীর বিবাহ হয়ে গেছে। এবং দেখতে দেখতে আটবছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই বিবাহিত জীবনে যে স্বরূপ ফুটে উঠেছে, তাতে অনুমান করা চলে চন্দ্রশেখরের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে শৈবালিনী স্বামীর ঘর করতে আসেননি, কিছু উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিলেন। তিনি ও প্রতাপ এক বোঁটার দুটি ফুল, বোঁটা ছিঁড়ে চন্দ্রশেখর ফুল দুটিকে পৃথক করেছেন–বিবাহ সম্বন্ধে এটাই তাঁর মনোভাব। আখ্যায়িকার শেষের দিকে যোগবলের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে মনের এই গোপন কথা তিনি চন্দ্রশেখরের নিকট প্রকাশ করেছেন। মূলতঃ স্বামীর দিক হতে শৈবালিনীর মানসিক বিরূপতা দূর করবার চেষ্টামাত্র হয়নি, শৈবালিনীর অগাধ প্রেমপিপাসা অতৃপ্তই থেকে গেছে। এ সম্পর্কে চন্দ্রশেখরের জবানীতে আছে– “আমার যে বয়স, তাহাতে আমার প্রতি শৈবালিনীর অনুরাগ অসম্ভব অথবা আমার প্রণয়ে তাহার প্রণয়াকাঙ্ক্ষা নিবারণের সম্ভাবনা নাই। আমি তো সর্বদা আমার গ্রন্থ লইয়া বিব্রত। আমি শৈবালিনীর সুখ কখন ভাবি? আমার গ্রন্থগুলি তুলিয়া পাড়িয়া এমন নবযুবতীর কী সুখ? … এই সুকুমার কুসুমকে কি অতৃপ্ত মোচন তাপে দগ্ধ করিবার জন্যই বৃস্তচ্যুত করিয়াছিলাম?” স্পষ্টতই শৈবালিনী প্রতিনিয়ত পিপাসিত যৌবন তাপে দগ্ধ হচ্ছিলেন। কার্যত নিরাসক্ত স্বামীর জন্যই তিনি বাল্যপ্রণয়ীকে ভুলতে ক্ষণিকের জন্য ভুলতে পারলেন না।
ভীমা পুষ্করিণীতে স্নানকালে শৈবালিনীর মধ্যে যে লীলাচাঞ্চল্য দৃষ্টতা তা তাঁর গণ্ডীবদ্ধ জীবনের মাঝে ক্ষণিকের মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করার বটি প্রতীকায়িত হয়েছে। এরপর ফষ্টর কর্তৃক অপহূতা হয়ে তাঁর জীবনে আকস্মিক ভাবেই শুরু হয় পট পরিবর্তন। শৈবালিনী স্থূল ভোগবাসনার জগতের অধিবাসিনী ছিলেন না। ফষ্টর নিজের প্রতি শৈবালিনীকে আকৃষ্ট মনে করে তাকে অপহরণ করে ঠকিয়েছেন এরূপ স্বীকারোক্তি তিনি নবাবের সম্মুখে করেছেন। এমনকি উন্মাদ অবস্থায় চন্দ্রশেখরের নিকট শৈবালিনী বলেছিলেন– তিনি স্বেচ্ছায় ফষ্টরের সঙ্গে গিয়েছিলেন। কুলবধূ হয়ে তাঁর এমনভাবে বাইরে পা রাখার কারণ হল– শৈবালিনী তাঁর বিস্বাদ দাম্পত্য জীবন হতে মনেপ্রাণে মুক্তিকামনা করতেন। ফষ্টর যেন সেই মুক্তি এনে দিলেন। কখনোই তিনি ফষ্টরের প্রতি অনুরাগিনী ছিলেন না। প্রতাপের প্রতি অনির্বান প্রণয় আকর্ষণই তাঁকে গৃহবন্ধন ছিন্ন করতে প্রেরণা জুগিয়েছে। তাই অপহূতা হবার পর সুযোগ পেয়েও তিনি ঘরে ফিরে আসেননি।
গৃহের নিশ্চিন্ত আরাম ছেড়ে শৈবালিনী যে আনীশ্রিতের পথে যাত্রা করেছিলেন, তার মধ্যেই প্রকট, শৈবালিনী বিহঙ্গিনী জাতীয়া, নীড়ের সামান্য তৃপ্তির অভিলাসিনী তিনি নন। বাধামুক্ত আকাশের স্বপ্ন সুন্দর নীলিমার জন্য তাঁর সুতীব্র আর্তি। সেই অবন্ধন কামনীয় যদি বজ্রপাত নেমে আসে তাকেও তিনি বরণ করে নেবেন। ব্যথাদীর্ঘ সত্তাকে আপনার প্রণয়াস্পদের চরণে সমর্পণ করে দেবেন। প্রিয়তম প্রতাপকে কী করে পাওয়া যাবে তা তিনি জানেন না। অগ্রপশ্চাৎ ভেবে বিচার বিবেচনা করে, গত আটবৎসরে তিনি গৃহত্যাগ করতে পারেননি, এখনো পারতেন না। এ হেন অবস্থায় বাজপাখির মতো ফষ্টর তাঁকে নীড়ের বন্ধন হতে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। সমালোচকের ভাষায়– “বন্ধন ছিঁড়ল, মুক্তির স্বাদ পেয়ে শৈবালিনী বাজের চঞ্চুর আঘাতকেও তুচ্ছ মানল। উড়ে চলার নেশা জেগেছে ডানায়– কামনা কি সিদ্ধ হবে না?”
শৈবালিনীর চিত্ত দেশে নৈতিক চেতনার কোনো দৃঢ়মূল ভিত্তি নেই, তাঁর কাছে সমাজ একটা বাইরের শক্তি মাত্র। তিনি ফষ্টরের নৌকায় সুন্দরীকে বলেছেন– “ইহার পর পাড়ার ছোটো মেয়েগুলো আমাকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিবে কিনা যে ওই উহাকে ইংরেজে লইয়া গিয়াছিল? ঈশ্বর না করুন। কিন্তু যদি কখনো আমার পুত্রসন্তান হয় তবে তাহার অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্রণ করিলে কে আমার বাড়ি খাইতে আসিবে? যদি কখনো কন্যা হয় তবে তাহার সঙ্গে কোনো সুব্রাষ্মণের পুত্রের বিবাহ দিবে?” এই সাহসিকতা রমণীর সমাজভীতির সীমা এইটুকু। তাঁর অন্তরের গোপন প্রদেশে সমাজবোধ অনুক্ষণ গুঞ্জরণ করে বলেনি, “তুমি যাহা করিতেছ তাহা পাপ, যাহা ভাবিতেছ তাহা অধর্ম।” মনে কোনোরূপ দ্বিধা থাকিলে শৈবালিনী নিজের আচরণ ও অনুভূতির ক্ষেত্রে এতখানি নির্দ্বন্দ হতে পারতেন না।
প্রতাপ কর্তৃক ফষ্টরের নৌকা হতে উদ্ধার হয়ে শৈবালিনী প্রিয়তমকে কাছে পেয়ে প্রেমোদ্বেগে তাঁর হৃদয়কে আবেগপূর্ণ ভাষায় প্রতাপের নিকট সমর্পণ করে বসলেন। কিন্তু বিনিময়ে প্রতাপ তাঁকে করলেন রূঢ় প্রত্যাখ্যান। প্রতাপ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাতা হবার পর শৈবালিনী নিজের কর্মের ফলাফল বিবেচনা করতে সচেষ্ট হয়েছেন। প্রণয়ী প্রতাপ তাঁকে গ্রহণ করবেন কিনা, তাও যে জীবনের সমস্যা হতে পারে তা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি। প্রতাপের সঙ্গে মিলিত হতে পারলেই তাঁকে পাওয়া যাবে তাঁর এই ধারণা ছিল। সমাজ শক্তি যে শুধু বেদগ্রামের নিন্দাকুৎসায় সীমাবদ্ধ নয়, তা সে সর্বত্রই ছড়িয়ে তিনি প্রথম বুঝলেন প্রতাপের ব্যবহারে। মনে পড়ে গেল তাঁর ফেলে আসা নিরাপদ আশ্রমের কথা। তিনি হয়ে উঠলেন কুজ্ঝটিকাকীর্ণ বিভ্রান্ত পথিকের মতো। তার এই অবস্থা যেন সংগ্রামক্লান্ত মোদ্দার মতো— তাঁর হৃদয়ের ওপর দিয়ে হঠাৎ যেন এক প্রলঙ্কর ঝড় বয়ে গেল।
কিন্তু মুহূর্তের পরে চিত্তের বিমূঢ়তাকে কাটিয়ে তিনি রোমান্সের নায়িকার মতো দুঃসাহস ও কর্মদক্ষতায় আত্মনিয়োগ করলেন। প্রতাপ সম্বন্ধে সমস্ত আশা বিসর্জন দিয়েও তিনি একটিবারের জন্য ভেঙে পড়েননি, আবার নুতন আশায় বুক বেধেছেন। ইংরাজ কর্তৃক ধৃত প্রতাপকে উদ্ধারের দুরূহ কর্মে তিনি সফল হয়েছেন। গঙ্গাবক্ষে সন্তরণকালে একদিকে মিলেছে তাঁর পরম পুরস্কার, অন্যদিকে চরম শাস্তি। প্রতাপের কথায় তিনি জানতে পেরেছেন- এই প্রিয়তমের অন্তরে তাঁর প্রতি কী গভীর প্রেম লুক্কায়িত। কিন্তু ধর্মবোধে প্রতিক্ষিত প্রতাপ সমাজবিধি লংঘন করেনা। অতএব দূরদৃষ্ট। শৈবালিনীকে সমাজের প্রতিকূল শক্তির কাছে পরাভব মানতে হল। প্রতাপের মুখের দিকে চেয়ে তিনি আপনার সুচির লালিত প্রণয়ানুভবের কণ্ঠরোধ করলেন। তিনি প্রতাপের নিকট প্রতীজ্ঞাবদ্ধ হলে— “আজি হইতে তোমাকে ভুলিব। আজ হইতে আমার সর্ব সুখে জলাঞ্জলি। আজি হইতে আমি মনকে দমন করিব। আজি হইতে শৈবালিনী মরিল।” শৈবালিনী মরলেন আমাদের মনে হয়, প্রতাপকে বিস্মরণের যে কঠিন শপথ তিনি উচ্চারণ করলেন তা অবোধ ঝোঁকের বশেই উচ্চারিত তা তাঁর অন্তর এর প্রাণের কথা নয়। অন্তত পরবর্তী ঘটনা ধারাই তা প্রমাণ দেয়।
কামনার অতি প্রবলতা এবং তার শোচনীয় ব্যর্থতাই শৈবালিনীর ট্র্যাজেডিকে ত্বরান্বিত করেছে। যে সজল মেঘের শ্যামল শোভায় মুগ্ধ হয়ে তিনি নীড় ছেড়েছিলেন, সেই মেঘ আচম্বিতে বজ্রপাতনে তাঁর পক্ষ বিদীর্ঘ করলো- মরীচিকা মরুপথে তাঁকে ছুটিয়ে শেষে প্রাণটুকু ছেঁকে নিল। প্রতাপই সমাজশক্তির নীতিবিধির প্রতিভূ হয়ে তাঁর বিকচ হৃদয়পদ্মকে দলিত করলো। শৈবালিনীর শূন্যচিত্তে নরকযন্ত্রণায় ভরে গেল, পাপবোধের পীড়নে ক্ষতবিক্ষত রক্তাত্ব হতে লাগলেন। শৈবালিনীর এই নরকদৃশ্য বর্ণনাপ্রসঙ্গে সমালোচক ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করলেন– “শৈবালিনীর উৎকট প্রায়শ্চিত্তের যে-চিত্র দেওয়া হয়েছে সাধারণ মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের দিক দিয়া তাহার মূল্য কত বলা সুকঠিন। এত বড়ো একটা যুগান্তরকারী পরিপূর্ণ অনুভূতির জন্য শৈবালিনীর চিত্রক্ষেত্র ঠিক প্রস্তুত কিনা তাহাও সন্দেহের বিষয়।” প্রতাপের নির্মম প্রত্যাখ্যানে, তাঁর চিন্তা পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়ার অঙ্গীকারের প্রতিক্রিয়ায় শৈবালিনীর মানসিক বিকার অসম্ভবনা হতে পারে। কিন্তু মানস প্রায়শ্চিত্ত আর যোগবলের প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁর চরিত্রের আমূল পরিবর্তন দেখানো সম্ভব হয়নি। সম্ভব যে হয়নি, প্রতাপের সঙ্গে শৈবালিনীর অন্তীম কথোপকথনে তার প্রমাণ আছে। শৈবালিনী প্রতাপকে একান্তে ডেকে বলছেন– “আমি সুখি হইব না, তুমি থাকিতে আমার সুখ নাই–।” এর কারণস্বরূপ তিনি ব্যাখ্যা দিলেন—“স্ত্রীলোকের চিত্ত অতি অসার ; কতদিন বশে থাকিবে জানি না। এ জন্মে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও না।” এ থেকে মনে হয়, তাঁর স্বামীধ্যান, প্রতাপকে হৃদয়লোক থেকে সরিয়ে দিয়ে চন্দ্রশেখরের পূজা করা অস্বাভাবিক এবং অবিশ্বাস্য। কাজেই যেদিন প্রতাপের নৌকা থেকে শৈবালিনী সকলের অলক্ষে নেমে গেলেন, সেই সর্বশূন্যতায়—মরুময় দাম্পত্য জীবনপথে—বেদনামূৰ্চ্ছিতা নারীর অর্থহীনমাত্রাই এই চরিত্রের শেষ পরিচয়। অর্থাৎ সহজেই অনুমান করা চলে– সমালোচ্য শৈবালিনীর দুটি বিরুদ্ধ মন্তব্যের পশ্চাতে যথার্থকরণ নিহিত ছিল। সে কারণগুলি শৈবালিনীর স্বরূপকে উদ্ঘাটনের বিশেষ সহায়ক।