খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে সপ্তম শতক নাগাদ গ্রিসে এক নতুন ধরনের রাষ্ট্রীয় কাঠামাের প্রসার ঘটে। এই নতুন কাঠামােয় প্রাচীন বৃহৎ রাজতন্ত্রের স্থলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের উত্থান ঘটে, যেগুলি পলিস নামে পরিচিত হয়। পলিসগুলির রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় ক্রমে নানা ধারাবাহিক বিবর্তন ঘটতে থাকে।
[1] গ্রাথমিক পর্বে পলিস: প্রাথমিক পর্বে পলিসপুলিতে মােটামুটিভাবে একই ধরনের রাষ্ট্রীয় কাঠামাে প্রচলিত ছিল। প্রথম দিকে রাজার শাসন চালু থাকলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন অভিজাত পরিবারগুলির সমন্বয়ে গঠিত একটি গােষ্ঠীর দ্বারা পলিসগুলি পরিচালিত হতে থাকে। যুদ্ধ, বিচার, শাসননীতি নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়ে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
[2] কাঠামােগত ব্যবধানের সূচনা: পরবর্তীকালে পলিসে ধারাবাহিক বিবর্তনের মাধ্যমে অভিজাততান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক এইরূপ বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় কাঠামাের বিকাশ – ঘটতে থাকে। একে একে এথেন্সের মতাে গণতান্ত্রিক, স্পার্টার মতাে অভিজাততান্ত্রিক এবং সিরাকিউজের মতাে স্বৈরতান্ত্রিক পলিসের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এথেন্সের গণতন্ত্রে সাধারণ নাগরিকদের যৌথ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও স্পার্টায় রাজা, অভিজাত এবং সাধারণ নাগরিকদের সমন্বয়ে মিশ্র শাসন কাঠামাে গড়ে উঠেছিল।
[3] অনুন্নত রাষ্ট্রীয় কাঠামো: বিভিন্ন উন্নত পলিসের ধারাবাহিক অগ্রগতি ঘটলেও কিছু কিছু অনুন্নত পলিস ছিল যেখানে এই অগ্রগতি স্তব্ধ ছিল। এইসব পলিসের নাগরিকদের কাছে স্থলে বা জলের দস্যুতাবৃত্তি আদৌ অন্যায় বা অসম্মানের কাজ বলে বিবেচিত হত না।
খ্রিক পলিসপুলি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে পারস্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারলেও খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে ম্যাসিডনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। ফলে এই শতকে পলিসপুলির পতন ঘটে। পলিসগুলির পতনের বিভিন্ন কারণ ছিল—
[1] সেনাপতিদের দায়িত্ব: খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে অর্থনৈতিক দুর্বলতার ফলে এথেন্সের মতাে বৃহৎ পলিসও তার সেনাপতিদের সম্পূর্ণ আর্থিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই পেশাদার সেনাপতিরা অর্থনৈতিক প্রয়ােজনেই নিজেদের পলিসের পাশাপাশি বিদেশি শক্তিরও সেবা করতে বাধ্য হত। সেনাপতিদের এই দ্বিধাবিভক্ত দায়িত্বের ফলে আর সুযােগ্য সেনাপতি তৈরি হয়নি।
[2] নৌবছরের দুর্বলতা: অর্থনৈতিক দুর্বলতার প্রভাবে পলিসের নৌবহরের দুর্বলতাও প্রকট হয়ে পড়েছিল। এথেন্সের নৌবহরের আর্থিক দায়িত্ব যে ১২০০ ধনী পরিবার পালন করত তারা ক্রমে এই দায়িত্ব থেকে সরে যেতে চাইছিল। আর্থিক দুর্বলতার কারণে স্বেচ্ছায় নাবিকের পেশায় আশা যুবকের সংখ্যা কমে আসছিল।
[3] সামরিক ত্রুটি: গ্রিসের অধিকাংশ সৈন্য ছিল অপেশাদার ও কৃষক। তাই কৃষিকাজে যুক্ত হওয়ার জন্য তারা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চাইত না। তা ছাড়া গ্রিসের সৈনিকরা ঢাল, তরােয়াল নিয়ে যুদ্ধে দক্ষ হলেও বিপৎসংকুল পার্বত্য অঞ্চলের যুদ্ধে তারা দক্ষতা দেখাতে পারেনি। আবার স্থলযুদ্ধে স্পার্টার শ্রেষ্ঠত্বের ফলে তাদের সীমাহীন আত্মতৃপ্তি তাদের ক্ষতি করেছিল।
[4] ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী মানসিকতা: খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রিক সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের অত্যধিক প্রকাশ লক্ষ করা যায়। পলিসের আদর্শ বা সর্বজনীন বিষয়ের চেয়ে পলিসবাসী নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। ডায়ােজিনিসের “আমি একজন বিশ্বনাগরিক” উক্তি থেকে প্রমাণ হয় যে, তার কাছে ব্যক্তিই ছিল মুখ্য, সমাজ গৌণ।
[5] সংঘর্ষ: গ্রিসে বাণিজ্যের উন্নতি ঘটলে বিভিন্ন পলিসের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এর পরিণতিতে বিভিন্ন পলিসের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে যা পলিসগুলির শক্তি ও ঐক্য ধ্বংস করে।
[6] ম্যাসিডনের সামরিক দক্ষতা: পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ম্যাসিডন সামরিক শক্তিতে যে দক্ষতা দেখিয়েছিল গ্রিক পলিসগুলি তা পারেনি। ম্যাসিডনের শাসক দ্বিতীয় ফিলিপ যে বাহিনী নিয়ে গ্রিস আক্রমণ করে তা ছিল সুদক্ষ এবং নতুন যুদ্ধকৌশলে অভিজ্ঞ। গ্রিক পলিসগুলির সামরিক দক্ষতা যুগােপযােগী না হওয়ায় তারা ম্যাসিডনের সুদক্ষ বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়।