আবহবিকার (Weathering) শব্দটি এসেছে আবহাওয়া (Weather) থেকে। আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের (যেমন— উয়তা, আদ্রতা, বৃষ্টিপাত, এবং বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাস) সাহায্যে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তর যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চূর্ণবিচূর্ণ এবং রাসায়নিক পদ্ধতিতে বিয়ােজিত হলে, তাকে আবহবিকার (weathering) বলে।
আবহবিকার সংঘটিত হয়—যান্ত্রিক, রাসায়নিক ও জৈবিক পদ্ধতিতে। তাই আবহবিকারকে [1] যান্ত্রিক আবহবিকার, [2] রাসায়নিক আবহবিকার ও [3] জৈবিক আবহবিকার—এই তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়।
যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রক্রিয়াসমূহ
উয়তার পরিবর্তন, শিলাস্তরে চাপের হ্রাসবৃদ্ধি, আর্দ্রতার পরিবর্তন, জৈবিক কার্যাবলি প্রভৃতি কারণে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তর যান্ত্রিকভাবে চূর্ণবিচূর্ণ অথাৎ ভেঙে টুকরাে টুকরাে হলে, তাকে যান্ত্রিক আবহবিকার (Physical Weathering) বলে। যান্ত্রিক আবহবিকারে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়, কিন্তু শিলা খনিজের কোনাে মৌল পরিবর্তন ঘটে না। যান্ত্রিক আবহবিকার বিভিন্নভাবে ঘটে থাকে যথা-
(১) উষ্ণতার গরিবর্তনে যান্ত্রিক আবহবিকার: উষ্ণতার পরিবর্তনে বিভিন্নভাবে শিলার যান্ত্রিক পরিবর্তন ঘটে।
- প্রস্তরচাই খণ্ডীকরণ: শিলা তাপের কুপরিবাহী। দিনের বেলা প্রবল উয়তায় শিলার উপরিস্তর উত্তপ্ত হয়ে প্রসারিত হয় এবং রাত্রি বেলা তাপ বিকিরণ করে সংকুচিত হয়। কিন্তু শিলার নিম্ন স্তরে সংকোচন বা প্রসারণ ঘটে না। এইভাবে ক্রমাগত অসম সংকোচন ও প্রসারণের কারণে শিলাস্তরে অসংখ্য উল্লম্ব ও সমান্তরাল ফাটলের সৃষ্টি হয় এবং এক সময় এই ফাটল বরাবর টুকরা টুকরাে বিভিন্ন আকৃতির শিলাখণ্ড খুলে বেরিয়ে আসে। একেই প্রস্তরাই খণ্ডীকরণ (Block Disintegration) বলে। এভাবে আদি শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয় ও মাটির উৎপত্তি ঘটে।
- ক্ষুদ্রকণা বিশরণ: শিলা একাধিক খনিজের সমন্বয়ে গঠিত এবং খনিজগুলির বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও রং ভিন্ন। উয়তা বাড়া-কমার জন্য খনিজগুলি বিভিন্ন হারে প্রসারিত ও সংকুচিত হয়। এই কারণে শিলায় প্রবল পীড়নের (Stress) সৃষ্টি হয় এবং একসময় শিলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে পরিণত হয়। একেই ক্ষুদ্রকণা বিশরণ (Granular Disintegration) বলে। এই প্রক্রিয়ায় মূল শিলা থেকে প্রথমে বালুকা ও পরে জৈব পদার্থের সংযােজনে মাটি সৃষ্টি হয়।
- শল্কমােচন: শিলা তাপের কুপরিবাহী হওয়ায় শিলাস্তরের বাইরের অংশ দিনের বেলায় তীব্র উয়তায় প্রসারিত এবং রাতের বেলায় সংকুচিত হয়। কিন্তু ভিতরের অংশ প্রসারিত ও সংকুচিত হতে পারে না। শিলাস্তরের বাইরের অংশ ক্রমাগত সম্প্রসারণের কারণে স্তরগুলি পেঁয়াজের খােসার মতাে খুলে যায়। পরবর্তীকালে বায়ুপ্রবাহে খুলে যাওয়া অংশগুলি অপসারিত হয়ে শিলাস্তরটি গােলাকৃতি রূপ ধারণ করে। একেই শল্কমােচন বা গােলাকার আবহবিকার (Exfoliation) বলে। মরুভূমি ও শুষ্ক অঞ্চলের কেলাসিত শিলায় এই আবহবিকার ঘটে এবং মাটি গঠিত হয়।
(২) কেলাস গঠন: উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে উচ্চ অক্ষাংশের শীতল জলবায়ু অঞ্চলে দিনের বেলায় বরফ গলা জল শিলার ফাটলে প্রবেশ করে। রাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে নামলে ঐ জল বরফে পরিণত হয় এবং আয়তনে বেড়ে যায়। এর ফলে ফাটলের দু-পাশের দেওয়ালে প্রচণ্ড চাপ বাড়ে, আবার দিনের বেলা সেই বরফ গলে গিয়ে শিলাগাত্রে চাপ হ্রাস পায়। এভাবে দিন ও রাতে জলের ভৌত অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে ক্রমাগত শিলায় চাপ বাড়ে ও ফাটল বৃদ্ধি পায়। অবশেষে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়। এই তীক্ষ্ণ শিলা খণ্ডগুলিকে স্ত্রী বা ট্যালাস বলে। এগুলি পর্বতের পাদদেশে জমা হয়ে বালুকাপূর্ণ মাটি গঠন করে।
(৩) শিলাস্তরে চাপ হ্রাস: ভূগর্ভে গ্র্যানাইটজাতীয় শিলা ওপরের অন্য শিলাস্তুপ বা বিপুল পরিমাণ বরফের চাপে সংকুচিত থাকে। কিন্তু নানা কারণে ওপরের শিলাস্তূপ বা বরফ সরে গেলে নীচের ওই শিলা চাপ ও ভারমুক্ত হয়ে প্রসারিত হয়, ফলে শিলায় পীড়ন ও টানের সৃষ্টি হয়। এভাবে শিলায় ফাটল ধরে এবং আবহবিকার ঘটে ও পরে মাটির সৃষ্টি হয়।
(৪) জলের মাধ্যমে: জলের মাধ্যমে যান্ত্রিক আবহবিকার বিভিন্ন ভাবে ঘটে- জলস্রোতের ফলে সৃষ্ট বুদ্বুদের বায়ু শিলাফাটলে প্রবল চাপের সৃষ্টি করে এবং শিলায় আবহবিকার ঘটায়। শিলাছিদ্রে সঞ্চিত জল গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে যায় এবং বর্ষার সময় পূর্ণ হয়। আর্দ্রতা ও শুষ্কতার পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের ফলে শিলা ভেঙে টুকরাে টুকরাে (Flake) হয়ে যায়। মরু অঞ্চলে অতি উত্তপ্ত শিলার ওপর হঠাৎ বৃষ্টির জল পড়লে শিলা ঠাণ্ডা জলের সংস্পর্শে এসে সংকুচিত হয় এবং ফেটে যায়। এভাবে আদি শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মাটিতে পরিণত হয়।
(৫) অন্যান্য প্রক্রিয়া: উপকূল বরাবর পর্যায়ক্রমে জোয়ারভাটার প্রভাবে শিলা আর্দ্র ও শুষ্ক হয় এবং শিলা ফেটে যায়। একে কলিকরণ বা Slaking বলে। শিলাস্তরের ওপর সঞ্চিত আর্দ্র মৃত্তিকা-কণা (কলয়েড) শুকিয়ে যাওয়ার সময় মূল শিলা থেকে ক্ষুদ্রকণা উৎপাটন করে। একে কলয়েড প্লাকিং বলে। দাবানলের প্রভাবে শিলা প্রবলভাবে উত্তপ্ত হলে শিলা ভেঙে যায়। এই ধরনের আবহবিকার মাটি গঠনে সাহায্য করে।