ভূপৃষ্ঠের কোনাে অংশ দিয়ে ভূগর্ভস্থ জলের স্বাভাবিক নির্গমনকে প্রস্রবণ বলে। প্রস্রবণ প্রবহমান জলের স্রোতরূপে ভূপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়। জল নির্গমনের প্রকৃতি অনুযায়ী প্রশ্রবণকে প্রধানত 5টি ভাগে ভাগ করা যায়— [1] অবিরাম প্রস্রবণ, [2] সবিরাম প্রস্রবণ, [3] উয় প্রস্রবণ, [4] শীতল প্রস্রবণ ও [5] গিজার।
[1] অবিরাম প্রস্রবণ : যেসব প্রস্রবণ থেকে ভূগর্ভস্থ জল সারাবছর বিরামহীনভাবে নির্গত হয় সেইসব প্রস্রবণকে অবিরাম প্রস্রবণ বলে। অপ্রবেশ্য ও প্রবেশ্য শিলাস্তরের সংযােগস্থলে স্থায়ী সংপৃক্ত স্তর অবস্থান করলে এবং তা ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত হলে অবিরাম প্রস্রবণ সৃষ্টি হয়। এই ধরনের প্রস্রবণের ক্ষেত্রে স্থায়ী সম্পৃক্ত স্তর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত হয় এবং ক্রমাগত পরিপূরিত হয়। ছত্তিশগড় রাজ্যের অমরকন্টকে শােন নদীর উৎস সােনামুড়া প্রস্রবণটি অবিরাম প্রস্রবণের উদাহরণ।
[2] সবিরাম প্রস্রবণ : কোনাে কোনাে প্রস্রবণ থেকে ভূগর্ভস্থ জল সারাবছর নিরবচ্ছিন্নভাবে নির্গত হয় না। সাময়িক সম্পৃক্ত স্তরগুলি বর্ষার জলে পরিপূরিত হলে তখন ওই সময়ে প্রস্রবণগুলি থেকে পুনরায় ভূগর্ভস্থ জল নির্গত হতে শুরু করে। সাময়িকভাবে চলমান এধরনের প্রস্রবণকে সবিরাম প্রস্রবণ বলে। শুষ্ক ঋতুতে সাময়িক সম্পৃক্ত স্তরে জলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে অথবা জলপীঠ সাময়িক সম্পৃক্ত স্তরের নীচে চলে গেলে প্রস্রবণগুলি শুকিয়ে যায়। বৃষ্টি হলে তা আবার সচল হয়ে ওঠে। ঝাড়খণ্ডের চাইবাসা জেলার লুপুগুটুর প্রস্রবণমালার কয়েকটি প্রস্রবণ বর্যাশেষে শীতের প্রারম্ভে শুকিয়ে যায়।
[3] উষ্ণ প্রস্রবণ : বৃষ্টির জল বা ভৌমজল ভূত্বকের দারণ বা ফাটলের মধ্য দিয়ে ভূত্বকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে তা ভূ-অভ্যন্তরস্থ তাপীয় শক্তির প্রভাবে উত্তপ্ত হয়ে ভূপৃষ্ঠের কোনাে দুর্বল অংশ দিয়ে উষ্ণ জল প্রবাহরূপে বেরিয়ে এলে তাকে উয় প্রস্রবণ বলে। এই জলের উয়তা ভূপৃষ্ঠীয় জলের উয়তা অপেক্ষা অনেক বেশি হয়। যেসব মালভূমি ও পার্বত্য অঞ্চলের ভূত্বকীয় তাপ বেশি সেসব অঞ্চলের প্রস্রবণগুলি সাধারণত উষ্ণ হয়। পশ্চিমবঙ্গের বক্রেশ্বর, ঝাড়খণ্ডের রাজগির, হিমাচল প্রদেশের সিমলার নিকট তাতাপানি, বিপাশার উপনদী পার্বতীর পূর্ব তীরে মণিকরণের প্রশ্রবণগুলি উষ্ণ প্রস্রবণের উদাহরণ।
[4] শীতল প্রস্রবণ : যেসব প্রস্রবণের জলের উয়তা ভূপৃষ্ঠীয় জলের উয়তা অপেক্ষা কম বা এর সমান, সেসব প্রস্রবণকে শীতল প্রস্রবণ বলে। উত্তরাঞ্চলের দেরাদুনের সহস্রধারা একটি শীতল প্রস্রবণের উদাহরণ।
[5] গিজার : গিজার একটি আইরিশ শব্দ। এর অর্থ গর্জন। যেসব প্রস্রবণ দিয়ে ভূগর্ভে সঞ্চিত অত্যুয় জল ও বাম্প নিয়মিতভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে গর্জন করতে করতে প্রবল বেগে সংকীর্ণ উপপৃষ্ঠীয় পথে ভূপৃষ্ঠের ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হয়, সেসব উয় প্রস্রবণকে গিজার বলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের পার্বত্য অঞ্চলে ইয়েলােস্টান পার্কের ওল্ড ফেথফুল গিজার পৃথিবী বিখ্যাত। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি বা সদ্যমৃত আগ্নেয়গিরি বর্তমান, সেসব অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠ থেকে নীচে অল্প গভীরতায় জল উয় হয়ে ওঠে। খুব বেশি গভীরতায় প্রবেশ করলে ম্যাগমা চেম্বারের সংস্পর্শে এসে জল উত্তপ্ত হয়। উত্তপ্ত জল বাষ্পে পরিণত হয়ে ভূ-অভ্যন্তরে আবদ্ধ বায়ুতে সংযুক্ত হলে, আবদ্ধ বায়ুর চাপ বাড়ে। যখন আবদ্ধ বায়ুর চাপ বায়ুমণ্ডলের চাপ অপেক্ষা বেশি হয়, তখন গহ্বরের মুখ দিয়ে আবদ্ধ বায়ু, জল ও বাষ্প গর্জন করতে করতে ফোয়ারার মতাে বেরিয়ে এসে গিজার সৃষ্টি হয়। জল ও বাষ্প বেরিয়ে এলে আবদ্ধ বায়ুর চাপ কমে। ফলে, কিছুক্ষণের জন্য শান্ত অবস্থা বিরাজ করে। আবার ধীরে ধীরে বায়ুর চাপ বৃদ্ধি পেয়ে সংকটসীমা অতিক্রম করলে পুনরায় জলের উৎক্ষেপণ ঘটে। এইভাবে পর্যায়ক্রমে জলের উৎক্ষেপণ ও শান্ত অবস্থা চলতে থাকে।