স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের ধারণা অনুযায়ী উত্থিত কোনাে ভূমিভাগের ক্ষয়কার্যের প্রাথমিক অবস্থা থেকে নির্দিষ্ট ক্রম অনুযায়ী কতকগুলি অন্তর্বর্তী পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছােনােকে ক্ষয়চক্র বলে। ভূমিভাগ পর্যায়ক্রমে যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্যের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হয়ে সময় ভূমিতে পরিণত হলে ক্ষয়চক্রটি সম্পূর্ণ হয়। ক্ষয়চক্র চলাকালীন সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান বা পতন হলে অথবা নদীর ক্ষয় করার ক্ষমতা হ্রাস অথবা বৃদ্ধি পেলে ক্ষয়চক্র নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই সম্পূর্ণ হয়ে যায় অথবা ক্ষয়চক্র সম্পূর্ণ হতে পারে না। ক্ষয়চক্রের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়। ক্ষয়চক্রের এইরূপ অবস্থাকে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের ব্যাঘাত বা বিঘ্ন বলে। সমুদ্রপৃষ্ঠের আপেক্ষিক পতন ঘটলে তাকে ক্ষয়ের শেষ সীমার ঋণাত্মক পরিবর্তন বলে। এর ফলে ক্ষয়চক্র পুনরায় শুরু হয়। আবার, সমুদ্রপৃষ্ঠের আপেক্ষিক উত্থান ঘটলে তাকে ক্ষয়ের শেষ সীমার ধনাত্মক পরিবর্তন বলে। এর ফলে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই ক্ষয়চক্র শেষ হয়ে যায়।
সমুদ্রপৃষ্ঠের পতন হলে অথবা অন্য কোনাে প্রাকৃতিক কারণে নদীর ক্ষয় করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে নদী তখন পুরােনাে ভূমিভাগের ওপর নতুন উদ্যমে নিম্নক্ষয় শুরু করে। এর ফলে পর্যায়িত বা সমপ্রায় ভূমিরূপের ওপর যৌবনচিত ভূমিরূপ অধ্যারােপিত হয়। একে ভূমিরূপের পুনর্যৌবন লাভ বলে। প্রকৃতিগত পার্থক্য অনুযায়ী ভূমিরূপের পুনর্যৌবনলাভকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়- [1] গতিময় পুনর্যৌবন লাভ, [2] ইউস্ট্যাটিক পুনর্যৌবন লাভ ও [3] স্থিতিশীল পুনর্যৌবন লাভ।
[1] গতিময় পুনর্যৌবন লাভ : মহীভাবক আলােড়ন অথবা গিরিজনি আলােড়নের কারণে সংলগ্ন অঞ্চলে ভূমিভাগের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে নদীর গতিপথের ঢাল বেড়ে যায়। নদীর ঢাল বেড়ে গেলে নদীখাতে জলপ্রবাহের পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যায় এবং নদী নতুন উদ্যমে নিম্নক্ষয় শুরু করে। ফলে, পূর্ববর্তী ভূমিরূপের ওপর যৌবনােচিত ভূমিরূপ অধ্যারােপিত হয়। এইভাবে পুনরুত্থিত ভূমিভাগ পুনর্যৌবন লাভ করে। একে গতিময় পুনর্যৌবন লাভ বলে। ভূমিভাগ সমুদ্রের দিকে হেলে উথিত হলে সমুদ্র অভিমুখে নদীর গতিপথ বরাবর তৎক্ষণাৎ নদীর নিম্নক্ষয় শুরু হয়। ভূমিভাগ যেদিকে হেলে উথিত হয়, নদীর গতিপথ তার আড়াআড়ি বিস্তৃত হলে, ভূমিভাগের উত্থানের প্রভাব তৎক্ষণাৎ লক্ষ করা যায় না। কারণ আড়াআড়ি অবস্থায় নদীর নিম্নক্ষয় অতি ধীর গতিতে হয়।
[2] ইউস্ট্যাটিক পুনর্যৌবন লাভ : পৃথিবীব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের অবনমন ঘটলে ভূমিরূপের ইউস্ট্যাটিক পুনর্যৌবন লাভ ঘটে। প্রধানত দুটি কারণে ভূমিরূপের এই রূপ পরিবর্তন হয়, যথা-
-
ভূ-আলােড়ন : ভূ-আলােড়নের ফলে সমুদ্রবক্ষ অবনমিত হলে অথবা সমুদ্রবক্ষ বিস্তৃত হলে সমুদ্রের জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ নীচে নেমে যায়। ভূমিরূপের আপেক্ষিক উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে নদীর নিম্নক্ষয় করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ভূমিভাগ পুনর্যৌবন লাভ করে। একে ভূবিপর্যয়জনিত পুনর্যৌবন লাভ বলে।
-
হিমযুগের প্রভাব : হিমযুগে সমুদ্রের জল বাষ্পীভূত হওয়ার পর ঘনীভূত হয়ে তুষার রূপে উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে সঞ্চিত হলে সমুদ্রের জলের পরিমাণ কমতে থাকে। নদীর মাধ্যমে যে পরিমাণ জল সমুদ্রে ফিরে আসে তা সমুদ্রের বাষ্পীভূত জলের পরিমাণের থেকে কম। তাই, হিমযুগে। সমুদ্রপৃষ্ঠের অবনমন ঘটে। ভূমির আপেক্ষিক উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায়, নদীর নিম্নক্ষয়ের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে, ভূমিরূপের পুনর্যৌবন লাভ ঘটে। একে হৈমিক ইউস্ট্যাটিক পুনর্যৌবন লাভ বলে।
[3] স্থিতিশীল পুনর্যৌবন লাভ : সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান ও অবনমন ছাড়াই নদীর নিম্নক্ষয় করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে ভূমিভাগ পুনর্যৌবন লাভ করে। একে স্থিতিশীল পুনর্যৌবন লাভ বলে। প্রধানত তিনটি কারণে ভূমিভাগের পুনর্যৌবন লাভ হয়।
-
নদী গ্রাস : কোনাে শক্তিশালী নদী মস্তক ক্ষয়ের মাধ্যমে অন্য কোনাে নদীকে গ্রাস করলে ওই নদীর জল শক্তিশালী নদীতে এসে পড়ে। ফলে নদীর জলপ্রবাহের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে যায়। ফলে নদী পূর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হয়ে নিম্নক্ষয় শুরু করলে ভূমিভাগে যৌবনের চিহ্ন ফুটে ওঠে।
-
নদীর বােঝা হ্রাস : নদীর বােঝা কমলে নদীর গতিশক্তি বেড়ে যায়। নদী তখন সমস্ত শক্তিই নিম্নক্ষয়ে ব্যয় করে। ফলে ভূমিভাগে পুনরায় যৌবনের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
-
জলবায়ুর পরিবর্তন : কোনাে নদী অববাহিকা অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তিত হলে (যেমন—মরু জলবায়ু থেকে আর্দ্র জলবায়ু) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বহুগুণ বাড়ে। ফলে নদীতে জলপ্রবাহের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং নদী নিম্নক্ষয়ের মাধ্যমে ভূমিভাগে যৌবনের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তােলে।