গিরিখাত ও ক্যানিয়ন : স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের যৌবন পর্যায়ে নদীর ঢাল বেশি থাকে। তাই নদী দুরন্ত গতিতে নিম্নক্ষয় করেএগিয়ে চলে। ফলে নদী-উপত্যকা সংকীর্ণ ও গভীর হয়। উপত্যকাটি ‘I’ আকৃতির রূপ নেয়। আবহবিকার, ধস ও জলপ্রবাহের ফলে এই ‘I’ আকৃতির উপত্যকার দুই পাড় বিস্তৃত হয়ে ‘V’ আকৃতির উপত্যকা গঠন করে।
নদী উপত্যকা ভীষণ গভীর ও সংকীর্ণ হয়ে গিরিখাত সৃষ্টি করে। এই পর্যায়ে নদীর ঢাল অত্যন্ত বেশি থাকে বলে এর পার্শ্বক্ষয় অপেক্ষা নিম্নক্ষয় বেশি হয়। ক্রমাগত নিম্নক্ষয়ের ফলে এই অঞ্চলে খাড়াপাড়যুক্ত গভীর গিরিখাত সৃষ্টি হয়। শুষ্ক অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী অত্যন্ত গভীর ও সংকীর্ণ গিরিখাত সৃষ্টি করে, একে ক্যানিয়ন বলে। শুষ্ক অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের অভাবে পার্শ্বক্ষয় বিশেষ হয় না, কিন্তু নিম্নক্ষয় হয় সর্বাধিক। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের শুঙ্ক অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কলােরাডাে নদী পৃথিবীর গভীরতম ক্যানিয়ন গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সৃষ্টি করেছে।
শৃঙ্খলিত বা আবদ্ধ শৈলশিরা : পার্বত্য অঞ্চলে শৈলশিরাগুলি উপত্যকার দিকে নেমে এলে নদী শৈলশিরার বাধা এড়িয়ে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। তাই মনে হয় শৈলশিরাগুলি শৃঙ্খলিত বা আবদ্ধ অবস্থায় আছে। একে আবদ্ধ শৈলশিরা বলে। দার্জিলিং হিমালয়ে বহু শৃঙ্খলিত শৈলশিরা দেখা যায়।
জলপ্রপাত : নদীর গতিপথে জলতলের আকস্মিক উল্লম্ব বা প্রায় উল্লম্ব পতনকে জলপ্রপাত বলে। এই পর্যায়ে নদী-ঢালের পরিবর্তনের ফলে প্রবল জলরাশি খাড়া ঢালের নীচে নেমে এলে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ আমেরিকার সাল্টো অ্যাঞ্জেল (980 মি) পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাত। প্রবল জলধারা বা নদী পরপর কয়েকটি জলপ্রপাত সৃষ্টি করে নীচের দিকে নেমে এলে তাকে শ্রেণিবদ্ধ জলপ্রপাত বা ক্যাটার্যাক্ট বলে। একাধিক ছােটো ছাটো জলপ্রপাত সৃষ্টি করে নদী প্রবাহিত হলে যে সারিবদ্ধ ক্ষুদ্রাকার জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়, সেগুলিকে ক্যাসকেড বা নিপর বলে। নদীর স্বাভাবিক গতির চেয়ে সামান্য তীব্রগতিতে সিঁড়ির মতাে ছােটো ছােটো ধাপে নীচের দিকে নেমে এলে তাকে র্যাপিড বা খরস্রোত বলে।
মন্থকূপ বা পটহােল : নদীর গতিপথে কোমল শিলা অবস্থান করলে নদীবাহিত কঠিন শিলাখণ্ডের আঘাতে ঐ কোমল শিলায় গর্তের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন আকৃতির শিলাখণ্ডসহ জল ওই গর্তে আবর্তিত হয়ে গভীর গর্তের সৃষ্টি করে। নদীগর্ভে এইরূপ গর্তবিশিষ্ট ভূমিরূপকে মন্থকূপ বা পটহােল বলে। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লাইড নদী উপত্যকার তলদেশে অনেক মন্থকূপ দেখা যায়।
[1] প্লাবনভূমি ও স্বাভাবিক বাঁধ : এই পর্যায়ে নদীর ঢাল ভীষণভাবে কমে যায়। ফলে নদীর বহন ক্ষমতাও কমে যায়। তাই নদীবাহিত পদার্থসমূহ দীর্ঘদিন ধরে নদীখাতে সঞ্জিত হয়ে নদীখাতকে ভরাট করে তােলে। নদীর দুকূল বরাবর বালি সঞ্চিত হয়ে বাঁধের আকারে যে দীর্ঘ ভূমিরূপ গড়ে ওঠে তাকে স্বাভাবিক বাঁধ বলে। বন্যার সময় নদীতে জলের পরিমাণ বেড়ে গেলে অগভীর নদীখাত দিয়ে ওই জল প্রবাহিত হতে পারে না। অতিরিক্ত জল দু-কূল ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে। জলের সঙ্গে বাহিত পদার্থ সঞ্চিত হয়ে প্লাবনভূমি গড়ে ওঠে।
[2] নদীচর ও নদীদ্বীপ : নদীবাহিত পদার্থসমূহ নদীখাতে ক্রমাগত সঞ্চিত হয়ে চর বা চড়ার সৃষ্টি হয়। চড়াগুলিতে বারবার পলি সঞ্চিত হয়ে উঁচু হয়ে দ্বীপে পরিণত হয়।
[3] নদীবাক : নদী চলার পথে বাধা পেলে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। জলস্রোত নদীবাঁকের যে অংশে আঘাত করে সেখানে ক্ষয় হয় এবং বিপরীত অংশে পলি সঞ্চিত হয়ে বিন্দুবার সৃষ্টি করে। ধারাবাহিকভাবে নদীতে ক্ষয় ও সঞ্চয়ের ফলে নদীতে অসংখ্য নদীবাক সৃষ্টি হয়।
[4] অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ : নদী খুব এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হলে পরপর দুটি নদীবাঁকের মধ্যবর্তী অংশ সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে নদীবাক সংযুক্ত হলে নদী বাঁকা পথে ছেড়ে সােজাপথে চলে। ফলে পরিত্যক্ত নদীবকটি হ্রদের আকার ধারণ করে। একে অশ্বক্ষুরাকৃতির হ্রদ বলে।
[5] পেনিপ্লেন ও মােনাড়নক : ক্ষয়চক্রের অন্তিম পর্যায়ে নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ক্ষয়ের শেষ সীমায় বা তার কাছাকাছি অবস্থান করলে বৈচিত্র্যহীন সমপ্রায় ভূমি সৃষ্টি হয়। একে পেনিপ্লেন বলে। এই সময় ভূমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু ক্ষয়প্রতিরােধী শিলায় গঠিত স্বল্প উঁচু টিলা বা পাহাড় দেখা যায়। এই পাহাড় বা টিলাকে মােনাড়নক বলে।