বহুকাল ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনক শিলার পরিবর্তনের ফলে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে জৈব ও অজৈব পদার্থসমৃদ্ধ যে পাতলা ভঙ্গুর স্তর সৃষ্টি হয়, যা উদ্ভিদ জন্মানাের অনুকূল, তাকে মাটি বলা হয়। যেমন চারনােজেম, পডসল, চেস্টনাট ইত্যাদি।
পরিপূর্ণ মৃত্তিকা গঠনে চারটি প্রধান উপাদান লক্ষ করা যায়। এগুলি হল- খনিজ পদার্থ (45%), জৈব পদার্থ (5%), মৃত্তিকার জল (25%) ও মৃত্তিকার মধ্যে বাতাস (25% )।
(১) মৃত্তিকার খনিজ পদার্থ : মৃত্তিকা গঠনকারী খনিজগুলি প্রধানত অ্যালুমিনােসিলিকেট জাতীয়। মৃত্তিকায় উপস্থিত বিভিন্ন খনিজ উপাদানগুলি হল—ফেলসপার, অ্যাম্ফিবােল ও পাইরক্সিন, কোয়ার্টজ, অভ্র, লােহাজাতীয় ম্যাগনেশিয়াম প্রভৃতি।
(২) মৃত্তিকার জৈব উপাদান : গাছ ও অন্যান্য জীবের অবশিষ্টাংশ, জীর্ণ দেহ ও তাদের দেহাবশেষের মিশ্রণে উদ্ভূত জটিল পদার্থই মৃত্তিকার জৈব উপাদান। এই পদার্থগুলি সর্বদাই মৃত্তিকাতে বসবাসকারী জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। এর ফলে জৈব উপাদানগুলি অনবরত ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কণায় পরিণত হয়। মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ এবং জীবাণুর দেহকোশ মৃত্তিকার জৈব পদার্থের প্রধান উৎস। জৈব পদার্থ মৃত্তিকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অজৈব পদার্থকে দানাবদ্ধ করতে সাহায্য করে। এই জৈব পদার্থই ফসফরাস ও সালফারের প্রধান উৎস। জৈব পদার্থ মৃত্তিকার জীবাণু শক্তির মূল উৎস। জৈব পদার্থ না থাকলে মৃত্তিকাতে অনেক জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া সংঘটিত হত না। মৃত্তিকার জৈব পদার্থকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়-
প্রথম ভাগটি উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহাবশেষের আংশিক বিশ্লিষ্ট ও সংশ্লেষিত জটিল উপাদান। উদ্ভিদ ও জীবাণুকুল তাদের খাদ্য, শক্তি ও বৃদ্ধির জন্য এই উপাদানের ওপর নির্ভরশীল। উত্তমরূপে বিশ্লিষ্ট ও সংশ্লেষিত জটিল জৈব উপাদানকে হিউমাস বলে।
মাটির কাদাকণা ও হিউমাস—উভয় উপাদানই কলয়েড অবস্থায় থাকে। কাদাকণা ও হিউমাস মৃত্তিকার ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মকে প্রভাবিত করে এবং এদের মাধ্যমে মৃত্তিকার অধিকাংশ বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। খাদ্য মৌলগুলি ভূপৃষ্ঠের ওপরে থাকায় নীচে ধুয়ে চলে যায় না। উদ্ভিদ পুষ্টি হিসেবে এইসব মৌল সংগ্রহে সক্ষম হয়।
(৩) মৃত্তিকার জল : মৃত্তিকার আর একটি প্রধান উপাদান হল—জল। জল মৃত্তিকাকে দ্রবীভূত করে। উদ্ভিদ মৃত্তিকা থেকে জলের সাহায্যেই পুষ্টি মৌল সংগ্রহ করে। জল মৃত্তিকার ভৌত রাসায়নিক এবং জৈবিক প্রক্রিয়াগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মৃত্তিকাস্থিত জলে মৃত্তিকার লবণকণা দ্রবীভূত হয়। এই দ্রবণ ক্রিয়ার ফলেই উদ্ভিদ মৃত্তিকা থেকে শিকড়ের সাহায্যে পুষ্টিমৌল সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
(৪) মৃত্তিকার বায়ু : মৃত্তিকার বায়ু প্রকৃতিগতভাবে আবহাওয়ার বায়ুর থেকে ভিন্ন। মৃত্তিকার বায়ু মৃত্তিকার মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে অবস্থান করে। মৃত্তিকার বায়ু স্থানীয় অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। এই বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে। মৃত্তিকায় যখন জলের পরিমাণ স্বাভাবিক থাকে, তখন এর আপেক্ষিক আদ্রর্তা প্রায় 100 শতাংশ হয়। এই আবদ্ধ বায়ুতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেশি, অক্সিজেনের পরিমাণ কম। বৃষ্টির জলে মৃত্তিকা রন্্রগুলি ভর্তি হয়ে যায়। উদ্ভিদ মৃত্তিকা থেকে জল ব্যবহার করতে শুরু করলে এবং বাষ্পীভবনের ফলে জল কমতে শুরু করলে মৃত্তিকার মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রগুলি আবার বায়ুতে পূর্ণ হয়ে যায়। বায়ুর এই গতিময়তা বন্ধ হলে কেবলমাত্র উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না, জীবাণুকুলের অস্তিত্বকেও বিপন্ন করে। মৃত্তিকার বায়ু উদ্ভিদ ও জীবাণুকুলের জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য।