ভারত কার্পাস-বয়ন শিল্পে পৃথিবীতে প্রথম। বয়ন শিল্পের কেন্দ্রগুলি ভারতের চারটি অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত। এ সম্বন্ধে নীচে আলােচনা করা হল一
(১) পশ্চিমাঞ্চল : ভারতের কার্পাস বয়ন কেন্দ্রগুলি সবচেয়ে বেশি গড়ে উঠেছে পশ্চিমাঞ্চলে অর্থাৎ মহারাষ্ট্রের মুম্বাই, পুনে, নাগপুর, শােলাপুর, আকোলা, জলগাঁও, চন্দ্রপুর; গুজরাতের আমেদাবাদ, ভাদোদরা, সুরাট, ভারুচ, ভাবনগর, জামনগর এবং মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী, জবলপুর, ইন্দোর, গােয়ালিয়র ইত্যাদি অঞ্চলে। ভারতের পশ্চিমাংশে এই শিল্প গড়ে ওঠার প্রধান কারণগুলি হল一
-
কাঁচামালের সহজলভ্যতা : মহারাষ্ট্রের ডেকান ট্র্যাপ, গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশের রেগুর বা কৃয়মৃত্তিকায় উৎপাদিত কার্পাস সহজেই শিল্পকেন্দ্রগুলিতে পাওয়ার সুবিধা এই অঞ্চলে এই শিল্প বিকাশের অন্যতম কারণ।
-
আর্দ্র জলবায়ু : মহারাষ্ট্র ও গুজরাত (খাম্বাত ও কচ্ছ। উপসাগর) উপকূলের আর্দ্র জলবায়ুতে সুতাে ছিড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকায় ভারতের পশ্চিমাংশ বস্ত্র। শিল্পের আদর্শ অঞ্চল রূপে পরিগণিত হয়েছে।
-
শক্তির সহজলভ্যতা : মহারাষ্ট্রের ভিবপুরী, ভিরা, খােপালি এবং গুজরাতের উকাই এর জলবিদ্যুৎ; ধুবরানের তাপ- বিদ্যুৎ এবং কাকরাপারের পারমাণবিক বিদ্যুৎ পশ্চিমাঞ্চলে কার্পাস-বয়ন শিল্পের কেন্দ্রীভবনের সহায়ক হয়েছে।
-
সুলভ ও দক্ষ শ্রমিক : কঙ্কণ, শােলাপুর, সাতারা কৃষিতে অনুন্নত হওয়ায় সুলভে প্রচুর শ্রমিক পাওয়া যায়। অন্যদিকে সুরাট, কালােল, ভূপাল প্রভৃতি স্থানের প্রান্তিক কৃষিজীবীরা কার্পাস-বয়ন শিল্পে কাজ করে।
-
বন্দর ও উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা : মুম্বাই, নভসেবা বা জহরলাল নেহরু, কাণ্ডালা (করমুক্ত), পােরবন্দ, সুরাট, ওখা প্রভৃতি বন্দর গড়ে ওঠায় উন্নত মানের তুলাে, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি আমদানি এবং শিল্পজাত দ্রব্য রপ্তানির সুবিধা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। এ ছাড়া, এই অঞ্চল পশ্চিম রেলপথ এবং জাতীয় সড়ক 3, 4, 6, 7, 8 দ্বারা দেশের অন্যান্য অংশের। সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় কাঁচামাল ও উৎপাদিত দ্রব্যের পরিবহণ সহজেই করা যায়।
-
মূলধন : ভারতে বড়াে বড়াে অর্থলগ্নী সংস্থার দপ্তর (LIC. UTI, IDBI, ICICI ইত্যাদি) যেমন রয়েছে তেমনি স্থানীয় পারসি, ভাটিয়া ও গুজরাতি শিল্পপতিও রয়েছে। ফলে মূলধন প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
(২) দক্ষিণাঞ্চল : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে বস্ত্র শিল্পের অগ্রগতি শুরু হয়। এই অঞ্চলে বস্ত্র শিল্পের প্রধান কেন্দ্রগুলি হল一
-
তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটোর (দক্ষিণ ভারতের ম্যাঞ্চেস্টার বলা হয়), চেন্নাই, মাদুরাই, তুতিকোরিন, সালেম, তিরুনেলভেলি প্রভৃতি।
-
কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু, মাইসাের, রায়চুর, হুবলি প্রভৃতি।
-
কেরলার কোচি, কোঝিকোড়, কুইলন, তিরুবন্তপুরম প্রভৃতি। অবিভক্ত অপ্রদেশের হায়দ্রাবাদ, সেকেন্দ্রাবাদ, গুন্টুর, ওয়ারাঙ্গল প্রভৃতি।
এই অঞ্চলে বস্ত্রশিল্প কেন্দ্রগুলির অবস্থানের কারণগুলি হল-
-
কাঁচামাল : অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর কৃয়মৃত্তিকা অঞ্চল থেকে কাঁচা তুলাে পাওয়ার সুবিধা।
-
শক্তি : শিবসমুদ্রম, নাগার্জুন সাগর, মেততুর, পল্লিভাসাল, প্রভৃতি কেন্দ্র থেকে সুলভ জলবিদ্যুৎ পাওয়ার সুবিধা।
-
পরিবহণ : দক্ষিণ-মধ্য ও দক্ষিণ রেলপথ এবং 4, 7, 13, 47 ও 48 নং জাতীয় সড়কপথের মাধ্যমে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থার সুবিধা।
-
বন্দর : চেন্নাই, বিশাখাপত্তনম, কোচিন, কাকিনাড়া, তুতিকোরিন, নিউ ম্যাঙ্গালাের প্রভৃতি বন্দর মারফত তুলাে ও যন্ত্রপাতি আনার এবং বস্ত্র রপ্তানির সুবিধা।
(৩) উত্তরাঞ্চল : ভারতের উত্তরাঞ্চলের প্রধান কার্পাস-বয়ন শিল্পকেন্দ্রগুলি উত্তরপ্রদেশের কানপুর, আগ্রা, বেরিলি, এলাহাবাদ, মােদিনগর, লক্ষ্ণৌ, আলিগড়, মিরাট; রাজস্থানের জয়পুর, যােধপুর, কোটা; পাঞ্জাবের অমৃতসর, জলন্ধর, লুধিয়ানা এবং হরিয়ানার হিসার, ভিওয়ানি প্রভৃতি স্থানে অবস্থিত। এই অঞ্চলে বস্ত্র শিল্পের উন্নতির কারণগলি হল一
-
কাঁচামাল : পাঞ্জাব, রাজস্থান ও হরিয়ানায় সেচের মাধ্যমে উৎপন্ন কাঁচা তুলাের প্রাচুর্য।
-
বিদ্যুৎশক্তি : ভাকরা-নাঙ্গাল, ভাতিন্দা, গুরুনানক, বদরপুর, ইন্দ্রপ্রস্থ প্রভৃতি কেন্দ্র থেকে তাপবিদ্যুৎ ও জলবিদ্যুৎ পাওয়ার সুবিধা।
-
যােগাযােগ ব্যবস্থা : মধ্য ও উত্তর রেলপথ এবং 1, 2, 8, 10 ও 15 নং জাতীয় সড়কপথের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে উন্নত যােগাযােগ রক্ষার সুবিধা।
(৪) পূর্বাঅঞ্চল : ভারতের প্রথম বস্ত্র শিল্পের কারখানা 1818 খ্রিস্টাব্দে ঘুসুড়িতে গড়ে উঠলেও এই শিল্পের প্রকৃত বিকাশ ও একদেশীভবন শুরু হয় তারও অনেক পরে। এই অঞ্চলের বস্ত্রকলগুলি প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর দু’তীরে হাওড়া, সােদপুর, হুগলি, শ্রীরামপুর, রিষড়া, পানিহাটি, ফুলেশ্বর, শ্যামনগর প্রভৃতি স্থানে; বিহারের গয়া, পাটনা, ভাগলপুর এবং ওডিশার ভুবনেশ্বর, কটকে গড়ে ওঠেছে। এই অঞ্চলে বস্ত্র শিল্পের উন্নতির কারণগুলি হল一
-
বিদ্যুৎশক্তি : ময়ূরাক্ষী ও দামােদর পরিকল্পনার জলবিদ্যুৎ এবং ব্যান্ডেল, টিটাগড়, কাশীপুর, প্রভৃতি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে শিল্পের প্রয়ােজনীয় বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।
-
চাহিদা : কলকাতা, কানপুর, ভুবনেশ্বর, কটক প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলে ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সূতিবস্ত্রের বিপুল চাহিদা রয়েছে।
-
বন্দরের সান্নিধ্য : কলকাতা, হলদিয়া ও পারাদ্বীপ বন্দরের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি ও রপ্তানির সুবিধা। এ ছাড়া ঋণদানের সুবিধা, মূলধনের প্রাচুর্য ইত্যাদির সুবিধা থাকায় পূর্বাঞ্চলে বস্ত্রবয়ন শিল্পের বিকাশ হয়েছে।