ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জীবনধারণের উপযোগী প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের পার্থক্যের কারণে জনঘনত্বের বিন্যাস অসম প্রকৃতির।
[1] প্রাকৃতিক কারণ: ভূপ্রকৃতি, নদনদী, জলবায়ু, মাটি, ভূপৃষ্ঠের জল ও ভৌমজল, বনভূমি প্রভৃতি জনবন্টনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
-
ভূপ্রকৃতি : ভারতে জনবণ্টনে ভূমিরূপের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সিঙুগঙ্গা নদীবিধৌত সমভূমি উর্বর পলিরাশি দ্বারা আবৃত হওয়ায় কৃষিজ ফসল উৎপাদনে উদ্ভিদের পুষ্টিমৌলের কোনাে অভাব ঘটে না। এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ সমভূমিতে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় জনঘনত্ব অনেক বেশি। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল বন্ধুর প্রকৃতির হওয়ায় পরিবহণ ব্যবস্থা, শিল্প প্রভৃতি গড়ে তােলার পক্ষে প্রতিকূল। কৃষিকাজও কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। তাই জনসংখ্যার ঘনত্বও খুব কম।
-
নদনদী : জনবণ্টনে ভারতের নদনদী প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, কৃয়া, কাবেরী, গােদাবরী প্রভৃতি নদী অববাহিকা উর্বের হওয়ায় জনঘনত্ব বেশ বেশি।
-
জলবায়ু : জনবিন্যাসের ওপর জলবায়ুর প্রভাব অপরিসীম। বায়ুর উয়তা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, আর্দ্রতা প্রভৃতি জনবণ্টনে প্রভাব বিস্তার করে। উপকূল অঞ্চলের জলবায়ু সমভাবাপন্ন, তাই এই অঞ্চলে জনঘনত্ব খুব বেশি। হিমালয়ের উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে প্রচণ্ড ঠান্ডার জন্য এবং মরুভূমি অঞ্চলে খুব বেশি উন্নতার জন্য জনঘনত্ব খুবই কম। আবার, ভারতের উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি রাজ্যগুলিতে সঁতসেঁতে জলবায়ুর জন্য বসতি কম।
-
মাটি : মাটির গুণাগুণের ওপরও জনঘনত্ব নির্ভর করে। গঙ্গা সমভূমি ও উপকূলের সমভূমি উর্বর পলিমৃত্তিকায় আবৃত হওয়ায় জনঘনত্ব খুব বেশি। মালভূমি হওয়া সত্ত্বেও উর্বর রেগুর মৃত্তিকার জলধারণ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করে জনবসতি গড়ে উঠেছে। হিমালয় অঞ্চলের পডসল, ছােটোনাগপুর মালভূমির ল্যাটেরাইট এবং দক্ষিণ ভারতের লাল মাটি অনুর্বর হওয়ায় এই অঞ্চলে জনঘনত্ব কম।
-
ভূপৃষ্ঠের জল ও ভৌমজল : ভৌমজল ও ভূপৃষ্ঠের জলের প্রাপ্যতা অনুযায়ী জনসংখ্যা বণ্টিত হয়। থর মরুভূমি অঞ্চলে জনসংখ্যার বণ্টন জলাভূমির অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। সমভূমির যে-সমস্ত অঞ্চলে ভৌমজলের গভীরতা কম, সেইসব অঞ্চলে ভৌমজল চাষের কাজে লাগিয়ে ফসল উৎপাদন করা হয় বলে জনঘনত্ব বেশি।
-
খনিজ সম্পদ : খনিজ সম্পদ উত্তোলক অঞ্চলগুলিতে কাজের সুযােগ বেশি থাকায়, এই অঞ্চলে জনবসতি ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। ছােটোনাগপুর মালভূমি ভারতের খনিজ ভাণ্ডার হিসেবে পরিগণিত হওয়ায় জনঘনত্ব বেশি। একই কারণে বাইলাডিলা, বােলানি, সালেম প্রভৃতি খনিজ অঞ্চল ঘন বসতিপূর্ণ।
[2] অর্থনৈতিক কারণ: প্রাকৃতিক কারণগুলির মতাে অর্থনৈতিক কারণও জনবণ্টনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
-
কৃষি ও পশুপালন : ভারতের গ্রামীণ জনসংখ্যার বেশিরভাগই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। উর্বর মৃত্তিকা ও বিস্তৃত সমভূমি শস্য উৎপাদনে বেশ উপযােগী। ফলে গাঙ্গেয় সমভূমি ও উপকূলের সমভূমি অঞ্চলে জনঘনত্ব বেশি। গুজরাতের উত্তর অংশ কৃষিকাজে উপযােগী না হলেও, পশুচারণ ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে ওঠায় জনঘনত্ব বেশি।
-
শিল্প : শিল্পোন্নত অঞ্চলগুলিতে কাজের সুযােগ বেশি। তাই ভারতের যেসব অঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, সেইসব অঞ্চলে ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছে। হুগলি নদীর উভয় তীরে, হলদিয়া, দুর্গাপুর, আসানসােল, মুম্বাই, পুণে, আমেদাবাদ প্রভৃতি স্থানে এই কারণে জনঘনত্ব বেশি।
[3] সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ
-
নগরায়ণ : নগরায়ণ হলে জনঘনত্ব ক্রমশ বাড়ে। নগর বা শহরে জনঘনত্ব বেশি। ভারতের মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি নগরে জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে 6,000 জনের বেশি।
-
যােগাযােগ ব্যবস্থা : উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থাযুক্ত অঞ্চলে জনঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। সমভূমি অঞ্চলে সড়কপথ, রেলপথ প্রভৃতি জালের ন্যায় বিস্তৃত বলে এই অঞ্চলে জনঘনত্ব বেশি। আবার হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থা তত উন্নত নয় বলে জনঘনত্বও খুব কম।
-
শিক্ষাকেন্দ্র : দেশবিদেশ থেকে শিক্ষা অর্জনের জন্য বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে লােকজন এসে বসবাস করে। म তাই শান্তিনিকেতনে শিক্ষায়তনকে কেন্দ্র করে জনবসতি গড়ে ওঠে।
-
ধর্মীয় স্থান : ভারতে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানকে কেন্দ্র করে জনবসতি গড়ে ওঠে। এই কারণে পুরী, হরিদ্বার, বারাণসী, তিরুপতি, কাশী, মথুরা প্রভৃতি স্থানকে কেন্দ্র করে জনবসতি গড়ে উঠেছে।
[4] রাজনৈতিক কারণ: জনসংখ্যার বণ্টন ও পুনর্বন্টন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। 1947 সালের 15 আগস্ট দেশভাগের সময় ও পরবর্তীকালে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দলে দলে বহু শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করায় ভারতের জনসংখ্যা বহুগুণে বেড়েছে।