পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অসম জনবণ্টনে যেসমস্ত প্রাকৃতিক কারণ বা উপাদানগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে সেগুলি নিম্নরূপ一
[1] অবস্থান : দেশ, মহাদেশ বা কোনাে অঞ্চলের অবস্থান ওই অঞ্চলের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায় উদ্ভিদহীন উপমেরু বা মেরু অঞ্চলে অবস্থিত স্থানসমূহ প্রচণ্ড ঠান্ডার জন্য কৃষিকাজের অনুপযােগী। তাই এই অঞ্চলে জনবসতি খুবই কম। মধ্য অক্ষাংশে অবস্থিত দেশগুলির জলবায়ু নাতিশীতােয় প্রকৃতির হওয়ায় পশুপালন, চাষবাস ও ব্যাবসাবাণিজ্যে যথেষ্ট উন্নত। ফলে, জনঘনত্বও বেশ বেশি।
[2] ভূপ্রকৃতি : জনসংখ্যা বণ্টনে ভূপ্রকৃতির প্রভাব সবেচেয়ে বেশি। কৃষিকাজের উপযােগী উর্বর সমতলভূমির অভাব, ব্যয়সাপেক্ষ রাস্তাঘাট নির্মাণ, ভারী শিল্প গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা, ভূমিধস ইত্যাদি পার্বত্য অঞ্চলের চিরকালীন সমস্যা। এইসব কারণে জীবনধারণের উপযােগী পরিবেশ গড়ে না ওঠায় এই অঞ্চলে জনবসতি খুবই কম। তবে পার্বত্য অঞ্চল অপেক্ষা মালভূমি অঞ্চলের জনঘনত্ব সামান্য বেশি। অন্যদিকে, সমভূমি অঞ্চলের বিস্তীর্ণ উর্বর সমতলক্ষেত্র, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদি কৃষিকাজ এবং শিল্প গড়ে ওঠার পক্ষে অনুকূল। তাই, এই অঞ্চলে জনঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। ভূপ্রকৃতির পার্থক্যের জন্যই দাক্ষিণাত্যের মালভূমি ও হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল অপেক্ষা গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে জনঘনত্ব বেশি।
[3] জলবায়ু : জনবণ্টনে জলবায়ুর গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাস, পােশাক-পরিচ্ছদ, বাড়িঘর নির্মাণ, শস্য উৎপাদন, শিল্পের বিকাশ প্রভৃতিকে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে। তাই দেখা যায় পৃথিবীর যেসব অঞ্চলের জলবায়ু কৃষিজ দ্রব্য উৎপাদনের উপযােগী, সেইসব অঞ্চলে জনবসতি বেশি। নিরক্ষীয় অঞ্চলের অস্বাস্থ্যকর উয়-আর্দ্র জলবায়ুর জন্য দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন ও আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকায়, উয় ও শীতল মরু অঞ্চলের শুষ্ক জলবায়ুর জন্য আফ্রিকার সাহারা, দক্ষিণ আমেরিকার আটাকামা, ভারতের থর মরুভূমি অঞ্চলে জনবসতি খুব কম। চিরতুষারাবৃত মেরু অঞ্চল বা উচ্চ অক্ষাংশে অবস্থিত হিমশীতল দেশসমূহে এবং উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে অসহনীয় জলবায়ুর কারণে জনবসতি খুবই কম। অপরদিকে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনুকূল জলবায়ু (পর্যাপ্ত উয়তা ও বৃষ্টিপাত) কৃষিকাজের উপযােগী হওয়ায় জনবসতি বেশি।
[5] শিলা ও মৃত্তিকার প্রকৃতি : ভূপৃষ্ঠে ও ভূ-অভ্যন্তরে জলের সহজলভ্যতা নির্ভর করে ভূপৃষ্ঠের শিলার প্রকৃতির ওপর। বেলেপাথর বা চুনাপাথর অঞ্চলে শিলার প্রবেশ্যতা বেশি হওয়ায় জল ভূ-অভ্যন্তরে চলে যায়। তাই জলের অভাবে চাষবাস তেমনভাবে গড়ে না ওঠায় জনবসতি খুবই কম। আবার, প্রবেশ্য শিলাস্তর ও অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের মাঝখানে ভৌমজলের সঞ্চয় ঘটে। এইসব অঞ্চলে জলের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে বেশি জনবসতি গড়ে ওঠে।
পলিসমৃদ্ধ উর্বর সমভূমিতে কৃষিকাজ গড়ে ওঠে, আবার ল্যটেরাইট মৃত্তিকা কৃষিকাজের উপযােগী নয়। এই কারণে, পলিসমৃদ্ধ গাঙ্গেয় সমভূমিতে কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করে ঘনজনবসতি গড়ে উঠেছে। কিন্তু, ল্যাটেরাইট সমৃদ্ধ। দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চলে কৃষিকাজ তেমনভাবে গড়ে না। ওঠায়, জনবসতির প্রসারও তেমন ঘটেনি।
[6] জলের প্রাপ্যতা : জলের প্রাপ্যতা জনবণ্টনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কৃষির উন্নতির সঙ্গে জনবসতির বিন্যাস ও বিস্তার জলের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভরশীল। জলের অভাব ও আধিক্য কোনােটাই জনবসতি বিস্তারের অনুকূল নয়। জলের অভাবে মরু অঞ্চলে যেমন জনবসতি গড়ে ওঠে না, তেমনি বন্যা কবলিত প্লাবনভূমিতে জলের আধিক্যের কারণে জনবসতি গড়ে ওঠে না। আবার, প্লাবনমুক্ত নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে অধিক সংখ্যায় জনবসতি গড়ে ওঠে।
[7] উদ্ভিদের বন্টন : বনভূমির উপস্থিতি ও প্রকৃতি জনবণ্টনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কানাডা ও ইউরােপের সরলবর্গীয় বনভূমি থেকে কাঠ সংগ্রহ ও সরবরাহ করার জন্য কিংবা ভারতের বনাঞ্চল থেকে প্রয়ােজনীয় দ্রব্য সংগ্রহের জন্য বনভূমির প্রান্তভাগে জনবসতি গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে, আমাজন ও কঙ্গো অববাহিকার সেলভা অরণ্যে বনজ সম্পদ সংগ্রহের বিশেষ সুবিধা না থাকায় জনবসতি খুব কম।
[8] খনিজ সম্পদের উপস্থিতি : খনিজ দ্রব্যের প্রাপ্যতা জনসংখ্যার বণ্টনকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বন্ধুর মালভূমি ও শুষ্ক মরুভূমি অঞ্চল ঘন জনবসতি গড়ে ওঠার পক্ষে অনুকূল না হলেও এইরূপ প্রতিকূল পরিবেশে খনিজ দ্রব্যের প্রাচুর্যের জন্য কোথাও কোথাও ঘন জনবসতি গড়ে ওঠে। ভারতে ঝাড়খণ্ডের দক্ষিণ প্রান্তে ও ওডিশার কেওনঝড় জেলার উত্তর প্রান্তে অরণ্যে ঢাকা মালভূমিতে লােহা খনিগুলিকে কেন্দ্র করে কিরিবুরু, মেঘাতুলুরু ও বােলানিতে ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যের মরুপ্রায় অঞ্চলগুলিতে খনিজ তেলের উপস্থিতির জন্যই ঘন জনবসতি লক্ষ করা যায়।
এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের জনবসতির বণ্টন কেবলমাত্র একটি নিয়ন্ত্রকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। বরং জনবসতির বণ্টনে সমস্ত নিয়ন্ত্রকগুলি যৌথভাবে ক্রিয়াশীল।