প্যাট্রিক গেডেসের তত্ত্বের সংশােধন করে কেবলমাত্র শহরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে লুই মামফোর্ড শহরের ধারাবাহিক পরিবর্তনকে ছয়টি পর্ব বা পর্যায়ে ভাগ করেছেন। এই পর্যায়গুলির মধ্যে প্রথম তিনটি গঠনাত্মক বা বিকাশ পর্যায়কে এবং পরের তিনটি পর্যায় বিলুপ্তির ক্রমপর্যায়কে বিশ্লেষণ করে।
[1] ইয়োপলিস্ : শহর বা নগর গঠনের এটি আদি পর্ব। এই পর্যায়ে বসতির জনসংখ্যা খুবই কম থাকে। কৃষিজ, বনজ, খনিজ, মৎস্য সম্পদ প্রভৃতি আহরণের ওপর নির্ভর করে এবং গ্রাম্য জীবনধারণের সুস্পষ্ট ধারণার ওপর ভিত্তি করেই ছােটো শহর গড়ে ওঠে। চিলকা উপহ্রদের তীরে মৎস্য সংগ্রহের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা বালুগাঁও অনেকদিন ধরে মৎস্যগ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিল। 1981 খ্রিস্টাব্দে এই গ্রাম মৎস্য সংগ্রহকারী শহরে উন্নীত হয়েছে।
[2] নগর বা পলিস্ : এটি একটি বাজারকেন্দ্রিক শহর। এই পর্যায়ের প্রথম ভাগে শহরটি পাইকারি ও খুচরাে বাজার রূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং আশপাশের অঞ্চলকে পরিসেবা দান করে। এই সময়ে কিছু শিল্পের সমাবেশ ঘটে, লােকসংখ্যা বাড়ে এবং বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক কাজকর্মের সুযােগ সৃষ্টি হয়, ধর্মীয় কার্যকলাপ ও প্রতিরক্ষার বিভিন্ন কেন্দ্র তৈরি হয়। মিশরের প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া, গ্রিসের অ্যাথেন্সের অ্যাক্রোপলিস প্রভৃতি পলিস্-এর উদাহরণ।
[3] মহানগর বা মেট্রোপলিস্ : গ্রিক শব্দ Metropolis-এর অর্থ হল মূল নগরী বা Mother City। এই ধরনের মহানগরগুলির জনসংখ্যা 10 লক্ষের বেশি হয়। উন্নত পরিবহণ ও নানারকম কাজকর্মের জন্য এই পর্যায়ে নগরগুলি মহানগরে পরিণত হয়। এই পর্যায়ে অর্থনৈতিক কাজকর্ম বহুমুখী হয় এবং তার বিশেষায়ণও ঘটে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মগুলি পূর্ণতা পায়। প্রকৃতপক্ষে এই সময় শহরের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম এতটাই বৃদ্ধি পায় যে তার নিকটবর্তী ছােটো ছােটো শহর ও গ্রামগুলিকে প্রভাবিত করে। 2011 খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতের মােট মহানগরের সংখ্যা 53টি। দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই ও কলকাতা—ভারতের এই চারটি মহানগরের প্রতিটির জনসংখ্যা 1 কোটির বেশি।
[4] মহানগরপুঞ্জ বা মেগালোপলিস্ : মহানগরের বিস্ফোরিত রূপই হল মহানগরপুঞ্জ। যে মহানগর বাড়তে বাড়তে পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চল এবং ছােটো বড়াে শহর ও শিল্পাঞ্চলকে গ্রাস করে কয়েক শত বর্গকিলােমিটার অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, তাকে মহানগরপুঞ্জ বলে। জাপানের টোকিও ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক প্রভৃতি মহানগরপুঞ্জের উদাহরণ। এই পর্যায়ে ব্যাবসাবাণিজ্য ও শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়। শিক্ষা, শিল্পকলা ও স্থাপত্য হয় অনেক উঁচুমানের। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লােকেরা বসবাসের জন্য নগরের বাইরের দিকে চলে যায়। কারণ এই পর্যায়ে নগরটি পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে। জাপানের টোকিও, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক মহানগরপুঞ্জের উদাহরণ।
[5] টাইর্যানােপলিস্ : যখন কোনাে দেশের প্রায় সমগ্র অংশ নগরায়ণের কবলে পড়ে, তখন তাকে টাইর্যানােপলিসে্ বলে। এই পর্যায়ে শহরে চরম অর্থনৈতিক শােষণ ঘটে। মানুষ ভীষণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামীণ এলাকায় চলে যায়। নগরটি ক্রমশ জনশূন্য হতে শুরু করে। সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের প্রায় 90% মানুষ ইতিমধ্যেই শহর এলাকায় বসবাস করে সুতরাং অনেক সমাজবিজ্ঞানীর মতে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টাইর্যানােপলিস্ পরিণত হবে।
[6] নেক্রোপলিস্ : এই পর্যায়ে পৌর বসতিটি মৃতের নগরী নামে পরিচিত হয়। যুদ্ধ বা মহামারির ফলে শহরের নাগরিক পরিসেবা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি অবক্ষয় ও দৈন্যদশার মধ্য দিয়ে যে পর্যায়ে পৌঁছােয় সেই পর্যায়কে নেক্রোপলিস বলে। প্রাচীন নগরের মতাে এই পর্যায়ে নগর বসতিটি অতীতের সাক্ষ্য বহন করে। এই পর্যায়ে নগর সভ্যতার পরিসমাপ্তি ঘটে। মিশরের গিজা একটি নেক্রোপিলিসের আদর্শ উদাহরণ।
নগরের পরবর্তী পর্যায় হল মহানগর। 10 লক্ষ কিংবা এর বেশি জনসংখ্যাপূর্ণ নগরকে মহানগর বলে। নগরের সীমানায় নগরমালারূপে অবস্থিত অনেক শহর বা পৌর বসতি নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় মূল নগরের সঙ্গে মিশে গিয়ে মহানগর সৃষ্টি করে।
মহানগরের সর্বশেষ পর্যায় হল মহানগরপুঞ্জ। একাধিক মহানগর পরস্পর সংযুক্ত হয়ে মহানগরপুঞ্জ গঠন করে। এগুলি অতি বড় মাপের হয়। উন্নত দেশগুলিতে নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় মহানগরপুঞ্জ গড়ে ওঠে।