জন্মগত সূত্রে আমরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে যে গুণাবলি পাই সাধারণ অর্থে তাকেই বংশধারা বলে| ডগলাস এবং হল্যান্ডের মতে—পিতা-মাতা এবং পূর্বপুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতা হিসেবে যা আমরা জন্মসূত্রে পাই তাই বংশধারা।
উডওয়ার্থ এবং মার্কুইস বলেন—জীবনের শুরুতে মানুষের মধ্যে যা কিছু উপাদান থাকে, তাই বংশধারা| বংশধারার অর্থকে আরও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে হলে এর কৌশল সম্পর্কে কিছু আলােচনা করা প্রয়ােজন। DNA হল বংশধারার প্রধান উপাদান যা জিন এর মাধ্যমে পুরুষানুক্রমে সঞ্চালিত হয়। এইভাবে জিনের মধ্যে দিয়ে পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য যা আমরা পাই তাকেই বংশধারা বলে।
অন্যভাবে বললে, ক্রোমােজোমের মধ্যে অবস্থিত জিনের মাধ্যমে যেসব গুণাবলি এবং বৈশিষ্ট্যাবলি বাবা-মা এবং পূর্বপুরুষদের কাছে থেকে শিশুর প্রাপ্ত হয় তাই হল বংশধারা।
আমাদের চারপাশে যেসব উপাদান আছে সেগুলির সমষ্টিকেই সাধারণভাবে পরিবেশ বলা হয়। মনােবিজ্ঞানীদের কাছে পরিবেশ শব্দটি কিছুটা ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। তাদের মতে, পরিবেশ হল সেই সব বাহ্যিক উপাদানের সমষ্টি, যা আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
পরিবেশের সংজ্ঞা বিষয়ে বহু বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরােধ লক্ষ করা যায়। বােরিং, লংফিল্ড এবং ওয়েন্ডের মতে—জিন ছাড়া শিশুর ওপর সমস্ত প্রভাবই পরিবেশের উড়ওয়ার্থ ও মার্কুইসের মতে, জীবন শুরু হওয়ার পর শিশুর ওপর সমস্ত বাহ্যিক উপাদানের প্রভাবকেই পরিবেশ বলে। এই পরিবেশকে দুভাগে ভাগ করা হয়—প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সামাজিক পরিবেশ।
প্রাকৃতিক পরিবেশ বলতে বােঝায়, চারপাশে অবস্থিত বিভিন্ন উপাদান এবং শক্তি, যা শিশুর ওপর প্রভাব ফেলে যেমন জলবায়ু, গাছপালা, আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি। সামাজিক পরিবেশ হল মানবসমাজ, মানুষের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
ব্যক্তিজীবনে বংশধারা এবং পরিবেশের প্রভাব একটি বিতর্কিত বিষয়। কয়েকজন মনােবিদ, যেমন—গ্যান্টন, টারম্যান প্রমুখ বংশধারাবাদী (যারা বংশধারার সমর্থক) মনে করেন, ব্যক্তিজীবনে বংশধারাই সব। ব্যক্তি তার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে বংশধারা সূত্রে যা পেয়েছেন, তা কোনাে প্রকার শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ দ্বারা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। অপরদিকে, ওয়াটসন, ক্যাটেন প্রমুখ পরিবেশবাদীগণ (যারা পরিবেশের সমর্থক) বলেন, ব্যক্তির বৃদ্ধি ও বিকাশের ওপর বংশধারা কোনাে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না। মানুষ সম্পূর্ণভাবে পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। পরিবেশ যেভাবে তাকে তৈরি করবে, সে সেইভাবেই তৈরি হবে। একজন ব্যক্তি যা করতে পারে, পরিবেশগত সুযােগসুবিধা পেলে অন্য ব্যক্তিও তা করতে পারে।
বংশধারাবাদী এবং পরিবেশবাদীদের এই বিতর্কের ফলে তৃতীয় একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। যাঁরা এই বিতর্ককে অহেতুক বলে মনে করেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের বক্তব্য নীচে উল্লেখ করা হল—
বংশধারাবাদী এবং পরিবেশবাদীগণ তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে যেসব সমীক্ষা করেন সে প্রসঙ্গে ড. পরিশ্চা বলেন, ব্যক্তি বা শিক্ষার্থী হল বংশধারা সূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যাবলির পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার যৌথ ফল। অনুকূল পরিবেশে বংশধারা সূত্রে প্রাপ্ত গুণাবলির সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের সুযােগ ঘটে এবং পরিবেশ যথাযথ না হলে বিকাশ ব্যাহত হয়। অপরদিকে, পরিবেশ এককভাবে কিছু করতে পারে না বংশধারা ব্যতীত পরিবেশ অর্থহীন।
ম্যাকাইভার এবং পেজের (Maclver and Page) মতে, জীবনের প্রতিটি বিষয়ই উভয়ের (বংশধারা এবং পরিবেশ) গুণফল। কোনােটিকেই বাতিল করা যায় না এবং কোনােটিকেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। বংশধারা এবং পরিবেশ উভয়েই সমগুরুত্বসম্পন্ন এবং অপরিহার্য, একে অপরের বিপরীত নয়। পরস্পরের পরিপূরক এরা। এই প্রসঙ্গে গ্যারেটের (Garett) উক্তি প্রণিধানযােগ্য। তিনি বলেন, বংশধারা এবং পরিবেশ পরস্পরের সহায়ক—এর থেকে অধিক নিশ্চয় কিছু হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, বংশধারা ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক বিচারে ‘বংশধারা বা পরিবেশ’ এইভাবে উল্লেখ করা ঠিক নয়। এই দুইয়ের মধ্যে অথবা বা নতুবার সম্পর্ক নেই।বলা উচিত বংশধারা এবং পরিবেশ।
এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষার্থী বংশধারা এবং পরিবেশের সমষ্টি কি না। মনােবিদদের মতে, শিক্ষার্থী বংশধারা ও পরিবেশের পুণফল। উড্ওয়ার্থ এবং মারকুইস বলেন, বংশধারা এবং পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক সমষ্টির নয় বরং গুণফলের। ব্যক্তি বংশধারা + পরিবেশ নয়, বংশধারা x পরিবেশ।
ওপরের ব্যাখ্যা এবং যুক্তির ভিত্তিতে বলা যায় যে, শিক্ষার্থী হল, মনােসামাজিক সত্তা যাকে বংশধারা এবং পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ার গুণফল হিসেবে গণ্য করা যায়।