ভূমিকা: ইতিহাস বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতাে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটি স্বতন্ত্র বা পৃথক শাস্ত্র বা পাঠ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করা যায় কি না, তাই নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। কেউ কেউ মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রাষ্ট্রবিজ্ঞান এরই অংশ আবার কেউ কেউ বলেন যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল সমাজবিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা। একটি পৃথক শাস্ত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮ খ্রি.) পর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা ও ধ্বংসস্তূপ পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তােলে তাই ভাবীকালের পৃথিবীকে যাতে যুদ্ধের করালগ্রাস থেকে মুক্ত করা যায় এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তার জন্যই আন্তর্জাতিক বিষয়টির উদ্ভব।
এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যেসকল বিষয় নিয়ে আলােচনা করা হয়, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গভীর সম্পর্ক বর্তমান। রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। ইতিহাস পাঠ করার সময়েও বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক নীতি আলােচনা প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয় উত্থাপিত হয়।
থিয়ােডাের কৌলম্বিস-কে অনুসরণ করে বলা যায় যে, সুদীর্ঘকাল ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শাখা হিসেবে পরিচিত বহু বিষয় পৃথক বা স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এ কথা সমানভাবে প্রযােজ্য। বিংশ শতাব্দীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র পাঠ্য বিষয় হিসেবে গণ্য হয়। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শাখা বিষয় হিসেবে প্রতিপন্ন করা অসংগত।
অধ্যাপক বার্টন যুক্তি: অধ্যাপক বার্টন মনে করেন যে, আধুনিককালের আলােচনাধারার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে স্বীকার করে নিতে অসুবিধা নেই। তার মতে, একটি অপেক্ষাকৃত নবীন শাস্ত্র বলেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট সাধারণ বিধি, অনুমান সম্যকভাবে তৈরি হয়নি। যদিও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমবায়েই সৃষ্টি হয়েছে তবুও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটা নিজস্ব সত্তা আছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে নানা ধরনের সম্পর্কের ফলে আন্তর্জাতিক সমাজ গড়ে উঠেছে। সেই সমাজকে বুঝতে হলে তাকে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করেই বুঝতে হয়। কোনাে একটিমাত্র দেশের অভ্যন্তরীণ বা বিদেশনীতি পর্যালােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।
প্রত্যেক দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি আজ আন্তর্জাতিক পরিবেশ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। সেই আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্যকভাবে বুঝতে এবং বিচার করতে হলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি পৃথক শাস্ত্রের বা স্বতন্ত্র পাঠ্য বিষয়ের মর্যাদা দেওয়া উচিত।
অধ্যাপক জোসেফ ফ্রাঙ্কেল যুক্তি: অধ্যাপক জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেল স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দাবিকে সমর্থন করেছেন। তিনি মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালােচনা, বিজ্ঞানসম্মত কলাকৌশল প্রবর্তনে স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনায় উদারনীতিবাদী, বাস্তববাদী, সিদ্ধান্ত গ্রহণ মূলক তত্ত্ব, ভারসাম্য তত্ত্ব প্রভৃতি তত্ত্ব গড়ে উঠেছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্ট্যানলি হফম্যানও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পৃথক শাস্ত্রের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে কয়েকটি যুক্তি দিয়েছেন, সেগুলি হল一
- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বৌদ্ধিক অনুশীলনের বিষয় হিসেবে স্বতন্ত্র ও স্বাধিকারসম্পন্ন।
- আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি ও জাতীয় ঘটনাবলির মধ্যে সম্পর্কের প্রকৃতি জটিল। এর সমাধানে অ্যারিস্টটলের গ্রিক নগররাষ্ট্র সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ বা ধারণা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা যায়।
- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলােচনায় বিশ্লেষণাত্মক উদ্দেশ্য সাধিত হয়, এই কারণে এই শাস্ত্রকে পৃথক শাস্ত্রের মর্যাদা দান করা যায়।
- রাষ্ট্রীয় সমাজের তুলনায় আন্তর্জাতিক সমাজের সংগঠন-কার্যধারা স্বতন্ত্র প্রকৃতির, তাই এই প্রকৃতির আলােচ্য শাস্ত্রে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমাজ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
ভিন্ন মত: তবে অনেক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে স্বতন্ত্র বা পৃথক সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকার করে নিতে সম্মত নন। যেমন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী পামার ও পারকিন্স আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞানের স্বীকৃতির ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণ ও প্রয়ােগের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক বিন্যাসের অভাব এবং এই শাস্ত্রের বিষয়বস্তুর কোনাে সুস্পষ্ট কাঠামাে নেই। সমাজবিজ্ঞানী ক্লাব মনে করেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনার গভীরতা নির্ভর করে অন্য শাস্ত্র থেকে সংগৃহীত অভিজ্ঞতার গভীরতার উপর।
উপসংহার: পরিশেষে উল্লেখ্য যে, বর্তমান সমাজবিজ্ঞানের কোনাে শাখাই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্র নয়- এ কথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযােজ্য। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটি স্বকীয়তাধর্মী বা গতিশীল শাস্ত্র হিসেবে অভিহিত করা যায়। কারণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আন্তর্জাতিক সমাজকে নিয়ে আলােচনা করে আর আন্তর্জাতিক সমাজ যেহেতু বহুকেন্দ্রিক, তাই সেই পরিপ্রেক্ষিতেও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্বতন্ত্র পাঠ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করা যায়।