ভূমিকা : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাজবিজ্ঞান বা শাস্ত্র বলা হয়। কোনাে বিষয়ের সুনির্দিষ্ট তাত্ত্বিক কাঠামাে বিন্যাস ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সুসংবদ্ধ আলােচনা সম্ভব নয়, তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ধারার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। পঠনপাঠন ও গবেষণা এবং পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জ্ঞান আহরণ ও প্রয়ােগযােগ্য নীতি নির্ধারণে কী ধরনের ভূমিকা পালন করছে, তার উপর ভিত্তি করেই নিম্নলিখিত তত্ত্বগুলি গড়ে উঠেছে, যা সংক্ষেপে আলােচনা করা যেতে পারে।
[1] আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে আদর্শবাদ :
মতবাদের উদ্ভব : রাষ্ট্রচিন্তাবিদ উড্রো উইলসনের চিন্তাভাবনাকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আদর্শবাদের উদ্ভব ঘটে। আদর্শবাদ মূলত ১৯১৯-১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের সময়ের মধ্যে বিস্তার লাভ করে।
প্রবক্তা : আদর্শবাদের প্রবক্তা দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—নর্মান অ্যাঞ্জেল, নিকোলাস ম্যুরে বাটলার, জেমস টি শার্ট ওয়েল, নােয়েল বার্কার ফিলিপ এবং আলফ্রেড জিমার্ন, উইলসন প্রমুখ।
মূল বক্তব্য : আদর্শবাদী তাত্ত্বিক ধারার মূল বক্তব্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনায় কতকগুলি আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি গড়ে তােলার উপর বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয় এবং একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তােলার চেষ্টা করা হয়। আদর্শবাদীরা মনে করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির সকল স্তরের নৈতিক সমস্যা হল একটি মৌলিক সমস্যা। এই নৈতিক সমস্যাকে বাদ দিয়ে আদর্শ আন্তর্জাতিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় বলে আদর্শবাদ মনে করে। তারা আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের মতাে প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচ্য বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। আদর্শবাদের লক্ষ্য হল এক উন্নততর বিশ্বসমাজ গঠন। শিক্ষা, সচেতনতা ও আন্তর্জাতিক সংগঠন সমূহের সক্রিয় সদর্থক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে এই বিশ্বসমাজ গঠিত হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষমতার রাজনীতিকে পরিহার করার কথা বলে।
[2] আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে বাস্তববাদ :
উদ্ভব : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রি.) পর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষণমূলক বাস্তববাদী তত্ত্বের (Realist Theory) উদ্ভব হয়।
মুখ্য প্রবক্তা : হ্যান্স জে মরগেনথাউ হলেন বাস্তববাদের মুখ্য প্রবক্তা।
মতবাদের সমর্থক : রেম আঁরাে এবং কেনেথ টমসন হলেন এই মতবাদের উল্লেখযােগ্য সমর্থক।
মূল বক্তব্য : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী তত্ত্ব মনে করে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল কথা হল ক্ষমতা। অধ্যাপক হ্যান্স জে মরগেনথাউ তাঁর রচিত ‘Politics Among Nations’ গ্রন্থে এই মতবাদের বিষয়বস্তু এবং লক্ষ্য উপস্থাপন করেছেন। অধ্যাপক হ্যান্স জে মরগেনথাউ-এর ভাষায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল ক্ষমতার লড়াইয়ের রাজনীতি (“International politics, like all politics is a struggle for power”)। আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুশীলবরা ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক স্বার্থপূরণের জন্য কাজ করতে পারে কিন্তু ক্ষমতা ছাড়া এই উদ্দেশ্যপূরণ সম্ভব নয়। হ্যান্স জে মরগ্যানথাউ বলেছেন, রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি কাজ রাজনৈতিক নয়, তবে রাষ্ট্র উদ্দেশ্য হল রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি। এই উদ্দেশ্যপূরণের জন্য তিনি বাস্তববাদী তত্ত্বে ৬টি মূলনীতির কথা বলেছেন। যাইহােক, মর্গেন্থাও এর বাস্তববাদী তত্ত্বের আলােচনার মাধ্যমে একটি অভিজ্ঞতাবাদী তাত্ত্বিক কাঠামাে গড়ে তুলতে চেয়েছেন।
মরগেনথাউ-এর মতে, অন্যান্য রাজনীতির মত আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। তিনি ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিরােধকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তু হিসেবে চিহ্নিত করেন। তার মতে, ক্ষমতা, সাম্রাজ্যবাদ, কূটনীতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ, শক্তিসাম্য, বিশ্ব জনমত, আন্তর্জাতিক আইন, রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা, আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রভৃতি হল আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলােচ্য বিষয়।
[3] আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে বহুত্ববাদ :
উদ্ভব : ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের পরে বাস্তববাদের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে এই তাত্ত্বিক আন্দোলনের সূচনা হয়। বাস্তববাদী তত্ত্ব এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক তত্ত্বের বিরােধিতা করে যে গােষ্ঠী, তাদেরকে বলা হয় বহুত্ববাদী গােষ্ঠী এবং তাদের মতবাদকে বলা হয় বহুত্ববাদ।
প্রবন্তা : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণমূলক তত্ত্বের বহুত্ববাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন অধ্যাপক জোসেফ নাই, রবার্ট কিয়ােহেন, ডেভিড মিত্রানি প্রমুখ।
মূল বক্তব্য : বহুত্ববাদের সমর্থক ও প্রচারক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির একমাত্র কারক (Actor) রাষ্ট্র নয়। আন্তর্জাতিক সমাজে বহু অরাষ্ট্রীয় কারক (Non-State Actor) আছে যারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলির কার্যকলাপ, সম্পর্ক প্রভৃতি নিয়ে আলােচনা করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা যেমন সত্য তেমনই অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংঘের ভূমিকা কোনাে অংশে কম নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহুত্ববাদ তখনই সার্থকতায় পর্যবসিত হবে, যখন আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতিটি সদস্য হবে স্বাধীন এবং এইসকল সদস্য নিজের চিন্তা, প্রয়ােজন, স্বার্থ ইত্যাদি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে।
[4] আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে আচরণবাদ :
উদ্ভব : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে, বিশেষ করে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ডেভিড ইস্টনের The Political System’ নামক গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান সম্মতভাবে রাজনৈতিক আচরণ আলােচনার সাহায্যে নতুনভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের দাবি জানানাে হয়। এই মতবাদকে বলা হয় আচরণবাদ।
প্রবন্তা : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড ইস্টন, মর্টন ক্যাপলান, জন বার্টন, কার্ল ডয়েস, গ্রাহাম ওয়ালাস, আর্থার বেন্টলে প্রমুখ হলেন আচরণবাদের মুখ্য প্রবক্তা।
মূল বক্তব্য : আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত ভবিষ্যদ্বাণী করা এই দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম উদ্দেশ্য। আচরণবাদীরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতি-রাষ্ট্রের আচরণ বিশ্লেষণই হল আচরণবাদী আলােচনার মূল একক। আচরণবাদ তত্ত্ব কেন্দ্রিক। আচরণবাদ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ঘটনার বিচারবিশ্লেষণের পক্ষপাতী, আচরণবাদীরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনায় সনাতন বাস্তববাদী মতবাদকে উপেক্ষা করেছেন। তারা অর্থনীতি, মনস্তত্ত্ব, সমাজবিদ্যা, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি শাস্ত্রে অনুসৃত পদ্ধতি ও গবেষণার ফলাফলের নিরিখে মূল্যবােধবর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করার পক্ষপাতী। আচরণবাদীরা মনে করেন, জাতীয় রাজনীতির মতাে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূলেও আছে ক্ষমতা। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলােচনায় সমরবিদ্যা-সহ সেইসব নীতির আলােচনার কথা বলা হয়, যে নীতিগুলি অন্য রাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করে। কাজেই বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, আচরণগত সংবেদনশীলতা পরিবর্তনের দাবি, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া প্রভৃতি বিষয়ে আলােচনা করে।
উপসংহার : উপরোক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সমাজবিজ্ঞান বা শাস্ত্র হিসেবে পরিগণিত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিপূর্ণ বিকাশে আদর্শবাদী তাত্ত্বিকরা আইনগত ও নীতিগত ভিত্তির উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। আবার বাস্তববাদী তাত্ত্বিকরা ক্ষমতার লড়াইয়ের রাজনীতির উপর মনােনিবেশ করেছেন। এর পাশাপাশি আচরণবাদী তাত্ত্বিকরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার ক্ষেত্রে জাতি-রাষ্ট্রের আচরণের বিশ্লেষণকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। এ ছাড়াও বহুত্ববাদের সমর্থক এবং প্রচারকরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতিটি সদস্যের নিজস্ব চিন্তা ও স্বার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রতি মনােনিবেশ করেছেন। বলাবাহুল্য, বিভিন্ন পন্থী তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের মতবাদের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাঁধন দৃঢ়তর হয়েছে।