ভূমিকা : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বর্তমানে একটি সমাজবিজ্ঞান বা শাস্ত্র বলা হয়। কোনাে বিষয়ের সুনির্দিষ্ট তাত্ত্বিক কাঠামো বিন্যাস ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সুসংবদ্ধ আলােচনা সম্ভব নয়, তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে বিভিন্ন বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষণের এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলির মধ্যে আলােচনাধারার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
কাঠামােবাদ: নয়া বাস্তববাদের উপজাত হিসেবে বাস্তববাদের একটি ভিন্ন ধারার উদ্ভব হয়েছে, তাকে বলা হয় কাঠামোবাদ।
প্রবন্তা: কাঠামােগত মতবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে মুখ্য প্রবক্তা হলেন গুন্ডার ফ্রাঙ্ক, রাউল প্রেবিশ, ইমানুয়েল ওয়ালাস্টাইন, টি স্কোশপল প্রমুখ।
কাঠামোগত মতবাদের মূল বক্তব্য: মার্কসবাদের দ্বারা প্রভাবিত কাঠামােগত মতবাদের প্রবক্তা বাস্তববাদীদের মতাে বিশ্ব রাজনীতিতে রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ কারক (Actor) বা কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ককে কাঠামােগত মতবাদীরা শােষিত ও শােষক শ্রেণির রাষ্ট্রের মানদণ্ডে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন অর্থাৎ প্রভুত্বকারী শ্রেণিভিত্তিক রাষ্ট্র হল আন্তর্জাতিক বা বিশ্ব রাজনীতির মূল কর্মকর্তা। কাঠামােবাদীরা মনে করেন, আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে গুটিকয়েক শক্তিশালী ও প্রভাবশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং তার চারপাশে বিশ্বের অধিকাংশ অনুন্নত, উন্নয়নশীল ও পরনির্ভরশীল রাষ্ট্রসমূহ।
মার্কসবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা বাস্তববাদীদের মতাে রাষ্ট্রকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এঁদের মতে, তথাকথিত জাতীয় স্বার্থের নামে একটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মূলত রাষ্ট্রের প্রভুত্বকারী শ্রেণির স্বার্থরক্ষার উপযােগী নীতি অনুসরণ করে।
নয়া উদারনীতিবাদ: বিগত শতকের আটের দশকে বিশ্বের দুটি মহাশক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে ক্ষমতার লড়াই বা ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটলেও মতাদর্শগত, অর্থনৈতিক প্রতিযােগিতা কমবেশি চলতেই থাকে। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন আঞ্চলিক জোট গঠিত হয়। এর ফলে উইলসনীয় আদর্শবাদী তত্ত্ব তার গুরুত্ব হারায়- এই অবস্থায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে একদল সংস্কারপন্থী উদারনীতিবাদ নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে এগিয়ে আসেন, তাদের চিন্তা ভাবনার ফল বা চিন্তা দর্শন কে বলা হয় নয়া উদারনীতিবাদ।
মূল প্রবক্তা: নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জেমস রােজেনাউ, জোসেফ নাই, পিটার হাঁস এবং রবার্ট কেওহান প্রমুখ।
নয়া উদারনীতিবাদের মূল বক্তব্য: বিগত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় ক্ষমতার লড়াইয়ের অবসান ঘটলেও অর্থনৈতিক ও মতাদর্শগত ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে। তা সত্ত্বেও, ওই সময় প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে এবং ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আঞ্চলিক সংহতি গড়ে ওঠে। নয়া উদারনীতিবাদ সাবেকি উদারনীতিবাদী চিন্তার দর্শন অনুসরণ করেই পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করে এবং ন্যায়বিচার ও মানবকল্যাণের পথকে প্রশস্ত করে। এই তত্ত্বের প্রবক্তা সনাতনী উদারনীতিবাদের মূল নির্যাসগুলিকে যুগােপযােগী করে গড়ে তােলেন, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল মানবকল্যাণ।
নয়া বাস্তববাদ: বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশধারার নবতম সংযােজন বা রূপকে বলা হয় নয়া বাস্তববাদ। বিশ্বে বহুজাতিক সংস্থার প্রভাব বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ক্ষমতার সংকোচন-এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে কেনেথ ওয়াল্টজ-এর ‘Realist thought and Neo-Realist Theory’ নামক বিখ্যাত প্রবন্ধে নয়া বাস্তববাদী তত্ত্বের উদ্ভব বা আবির্ভাব ঘটে।
মূল প্রবক্তা: নয়া বাস্তববাদের প্রবক্তা হলেন, কেনেথ ওয়াল্টজ।
নয়া বাস্তববাদ মূল বক্তব্য: নয়া বাস্তববাদীগণ ধ্রুপদি বাস্তববাদের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক তাত্ত্বিক কাঠামাে নির্মাণে সচেষ্ট হন। ইতিমধ্যে বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তন ঘটার ফলে ক্ষমতার প্রতিযোগিতার পরিবর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপর রাষ্ট্রগুলি অনেক বেশি গুরুত্ব আরােপ করে। অরাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতিকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত করতে সমর্থ হওয়ায় রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা হ্রাস পায়। এমতাবস্থায় কেনেথ ওয়াজ পুরােনাে বাস্তববাদের পরিবর্তন ও পরিমার্জন ঘটিয়ে নয়া বাস্তববাদের আবির্ভাব ঘটান। একইসঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র গুলোর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা অনেক বেশি বাস্তবসম্মত হােক। এই তত্ত্বের প্রবক্তা মনে করতেন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্রের যুদ্ধ করার মানসিকতা হ্রাস পাবে ও রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সহযােগিতার বাতাবরণ গড়ে উঠবে।
উপসংহার: উপরোক্ত আলােচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার পিছনে এই তত্ত্বগুলির অবদান অনস্বীকার্য। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক যেহেতু একটি গতিশীল বিষয়, তাই সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি বদলেছে এবং নতুন নতুন তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছে এবং শীঘ্রই সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।