জাতীয় শক্তি নির্ধারণে মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতা বা শক্তি হল একটি গরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ধারণা। ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আবর্তিত হয়। জাতীয় শক্তি বৃদ্ধিতে সমস্ত উপাদানের একত্র সমাবেশ ঘটলেও মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের অভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় শক্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। এই মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের তিনটি দিক রয়েছে। যথা一
- জাতীয় চরিত্র,
- জাতীয় আত্মবিশ্বাসের নৈতিক শক্তি এবং
- আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও ভাবমূর্তি।
[1] জাতীয় চরিত্র: মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে জাতীয় চরিত্র হল একটি জাতির ইতিহাস ও সামাজিক অভিজ্ঞতার যৌথ ফসল। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় চরিত্রও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। একটি দেশের জাতীয় চরিত্রকে সেই দেশের জলবায়ু, সুদীর্ঘ ইতিহাস, সামাজিক অভিজ্ঞতা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ফল বলে মনে করা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ ব্রিটিশদের বাস্তব জ্ঞান, জার্মানদের শৃঙ্খলাপরায়ণতা, অধ্যবসায়ী মনােভাব, জাপানিদের কর্মনিষ্ঠা প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। তবে কখনাে কখনাে অন্য দেশের জাতীয় চরিত্রকে নীচু করে দেখে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্রকে খেসারত দিতে হয়েছে। যেমন— ভিয়েতনামের মতাে একটি ক্ষুদ্র দেশের জনগণের স্বাধীনতাকামী জাতীয় চরিত্রকে উপেক্ষা করে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই দেশটিকে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু মুক্তিসংগ্রামে কৃতসংকল্প সেখানকার জনগণ দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করেছিল। এ প্রসঙ্গে হ্যান্স জে মরগ্যানথাউ বলেছেন যে, জাতীয় সংকট ও জরুরি অবস্থার মােকাবিলা করার মধ্য দিয়েই একটি দেশের জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়।
[2] জাতীয় আত্মবিশ্বাসের নৈতিক শক্তি: আত্মবিশ্বাসের নৈতিক শক্তি এমন একটি মানসিক অনুভূতি, যা জনসাধারণকে আত্মবিশ্বাসী ও নীতিনিষ্ঠ করে তােলে। তারা দেশের জন্য সংগ্রাম করতে, সর্বপ্রকার আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকতে, এমনকি প্রয়ােজনে মৃত্যুবরণ করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আত্মবিশ্বাসের শক্তি শান্তি ও যুদ্ধের সময় জাতীয় সরকারের পররাষ্ট্রনীতির প্রতি দৃঢ় সমর্থন জ্ঞাপনের জন্য অনুপ্রেরণা জোগায়। এই কারণে হ্যান্স জে মরগেনথাউ জাতীয় আত্মবিশ্বাসের নৈতিক শক্তিকে জাতীয় শক্তির আত্মা’ বলে বর্ণনা করেছেন। পামার ও পারকিন্স-এর মতে, এরূপ নৈতিক শক্তি জাতির আদর্শ ও ভাবধারার সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে যুক্ত থাকে। অনেকে মনে করেন যে, প্রচারের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে একটি জাতির মধ্যে জাতীয় আত্মবিশ্বাসের নৈতিক শক্তি গড়ে তােলা যায়। যে দেশের সরকারের গণভিত্তি অর্থাৎ জনসমর্থন অত্যন্ত ব্যাপক সেই দেশটিই জাতীয় শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে চিন যখন ভারত আক্রমণ করে অথবা ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ভারতের জনগণ যে দৃঢ় মনােবলের পরিচয় দেয়, তা তৎকালীন ভারত সরকারকে বিশেষভাবে সাহায্য করে। কিন্তু কোনাে জাতি দুর্বল আত্মবিশ্বাসী হলে, জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কে উদাসীন থাকলে জাতি স্থবিরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সাম্প্রদায়িকতা ও প্রাদেশিকতা যদি জাতীয় সংহতিকে ব্যাহত করে তােলে বা ভাষাগত, শ্রেণিগত অথবা জাতপাত গত বিদ্বেষ যদি জাতীয়তাবাদের অন্তরায়রূপে দেখা দেয় তবে সেই জাতির মনােবলের ভিত্তি শিথিল হতে বা ভেঙে পড়তে পারে।
[3] আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও ভাবমূর্তি: একটি দেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও ভাবমূর্তি তার নিজের উপর নির্ভর করে না। তা নির্ভর করে অন্যান্য রাষ্ট্র ও বিশ্বজনমতের স্বীকৃতির উপর। কোনাে রাষ্ট্রের নীতি, আদর্শ ও লক্ষ্য, সামরিক শক্তি, সহযােগিতা করার ইচ্ছা ও সামর্থ্য, জাতীয় সংঘাত, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যাগত উৎকর্ষ, ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য, আন্তর্জাতিক বিরােধের মীমাংসা প্রভৃতি সম্মিলিতভাবে তার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি গড়ে তােলে। আবার, পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তির মর্যাদা লাভ করে। সাম্রাজ্যবাদের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি কলুষিত হচ্ছে আবার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সমর্থক হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্বে ইতিবাচক মর্যাদা অর্জন করছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার মর্যাদা ব্যাহত হয়েছে বর্ণবৈষম্যের কারণে। সর্বোপরি, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সঙ্গেই রাষ্ট্রের মানমর্যাদার প্রশ্ন সমানভাবে জড়িত রয়েছে।
নিম্নে আরও কয়েকটি মনস্তাত্ত্বিক উপাদান সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল一
[4] হ্যান্স জে মরগেনথাউ-এর মতে, কূটনীতি হল জাতীয় ক্ষমতার মস্তিষ্কের মতাে, আর জাতীয় আত্মবিশ্বাস হল তার আত্মা। তার মতে, যেসকল উপাদান নিয়ে কোনাে জাতির ক্ষমতা গড়ে ওঠে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হল কূটনীতির গুণগত দিক। শক্তির উপাদানসমূহকে কূটনীতি সঠিকভাবে প্রয়ােগ করে দেশের ক্ষমতা এবং প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করে।
[5] জাতীয় আত্মবিশ্বাস, নৈতিক শক্তি ও জাতির চরিত্রকে একই সরলরেখায় টেনে আলােচনা করা প্রয়ােজন। দেশের জনসাধারণের চারিত্রিক গঠন, মানসিক শক্তি, রাজনৈতিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর সেই দেশের জাতীয় ক্ষমতা নির্ভরশীল।
[6] কোনাে জাতির শক্তির অন্যতম উপাদান হল তার অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এবং অর্থনৈতিক বিকাশের ধারা। বর্তমানে শিল্পায়নের ধারা যে-কোনাে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাপকাঠিরূপে কাজ করে। অর্থনৈতিক বুনিয়াদের উপর সকল দেশের সামরিক শিল্পের উন্নতি, প্রতিরক্ষার আধুনিকীকরণ, প্রযুক্তিবিদ্যা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্রমােন্নতি নির্ভরশীল।
উপসংহার: উপরােক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জাতীয় ক্ষমতা বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে। কোনাে একটি বিশেষ উপাদান খুব বেশি পরিমাণে থাকলেই কোনাে দেশ শক্তিশালী হয় না। জাতীয় শক্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি উপাদানের কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামাে প্রভৃতি মনস্তাত্ত্বিক উপাদানকে সফল করতে সাহায্য করে। মনস্তাত্ত্বিক উপাদান হল জাতির মনােবল, কঠোর পরিশ্রম করার তীব্র বাসনা, দেশকে গড়ে তােলার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। একটি দেশের সরকারের দায়িত্ব হবে বস্তুগত ও মনােগত উভয়ের উপর গুরুত্ব আরােপ করে জাতীয় শক্তিবৃদ্ধির পরিকল্পনাকে বাস্তব সত্যে পরিণত করা।