ভূমিকা: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হল বিশ্বায়ন। বিগত শতাব্দীর ১৯৮০-র দশকে যে মুক্ত বাজার অর্থনীতির সূচনা হয়, তারই ফলশ্রুতি হল বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের সামগ্রিক বিশ্লেষণ করলে কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায়। অনেকে বিশ্বায়নকে সীমারেখাহীন বিশ্ব’ বলে চিহ্নিত করেন।
বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্য আলােচনার পূর্বে বিশ্বায়নের বেড়াজালে বিশ্ব’ এই ছক বা চিত্রের সাহায্যে বিশ্বায়ন, বিশ্ববাজার এবং বিশ্বায়ন পৃথিবীর প্রকৃত অর্থকে পরিস্ফুট করে তােলা যেতে পারে।
(১) বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপন: বিশ্বায়ন বিভেদ ও বৈষম্যকে প্রাধান্য না দিয়ে আন্তর্জাতিক সংহতি তৈরির কথা বলে। বিশ্বায়ন এই সত্যকে তুলে ধরে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটি অভিন্ন যােগসূত্র গড়ে তুলতে চায়।
(২) বিশ্বায়ন হল একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া: বিশ্বায়নের সঙ্গে অর্থনীতি গভীরভাবে যুক্ত। বলা যায়, বিশ্বায়ন হল পুঁজির প্রকারান্তরে অর্থনীতির বিশ্বায়ন। বিশ্বব্যাপী পুঁজির গমনাগমন বা আর্থিক লেনদেনই হল বিশ্বায়ন। অন্যভাবে বলা যায়, বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী অর্থনীতির উন্মুক্তকরণ, যেখানে পণ্য উৎপাদন এবং বণ্টনে, বিপণনে অর্থনীতি দুনিয়া জুড়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে, সেটাই হল আর্থিক বিশ্বায়ন।
(৩) আর্থিক দিক থেকে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা: বিশ্বায়ন পৃথিবীর প্রতিটি দেশের আর্থিক দিক থেকে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল করে তুলেছে। এই নির্ভরশীলতা বিভিন্ন দেশের বিবদমান স্বার্থ, মতাদর্শ এবং ব্যাবসাবাণিজ্যের বাধাকে মুছে দিতে সক্ষম হয়েছে।
(৪) মুক্ত বাজার অর্থনীতি: মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়ােগকারীরা বিদেশের মাটিতে অবাধ বিনিয়োগ করবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অনুমােদন লাগবে না। অর্থাৎ বিশ্বায়ন সমগ্র বাজারকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে চায়।
(৫) উদারীকরণের সঙ্গে বিশ্বায়নের গভীর সম্পর্ক: বিশ্বায়নের উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। উদারনীতিবাদ আসলে পুঁজিবাদের ভিন্নতর রূপ (মূর্তি এক, খােলস বা বহিরাবরণ শুধু আলাদা)। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তার পরিমার্জন হলেও শােষণ করার চরিত্র পালটায়নি। একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের যুদ্ধে কয়েকটি পশ্চিমি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র শক্তি আর্থিক উদারীকরণ তত্ত্বকে ব্যবহার করে বিশ্বায়নের জামা পরিয়ে শােষণের কৌশলকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলি বিশ্বায়ন এবং উদারীকরণের ঢাকায় নিজ দেশে আর্থিক সংস্কারে বাধ্য হচ্ছে, তাই উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণ হল বিশ্বায়নের অন্যতম হাতিয়ার বা তাত্ত্বিক শক্তির ভিত্তি।
(৬) অতিরিক্ত মুনাফার লােভে অনুন্নত দেশে পুঁজি বিনিয়োগ: বিশ্বায়নের অন্যতম লক্ষ্য হল অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলিতে পুঁজি বিনিয়োগ। এর কারণ দরিদ্র দেশগুলির অর্থনীতি চাঙ্গা নয়, যেসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করলে গরিব দেশগুলি বেশি উপকৃত হবে সেইসব ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজি (FDI) বিনিয়োগ করা হয় না। কেবলমাত্র যেসব ক্ষেত্রে বেশি মুনাফা অর্জন সম্ভব হবে শুধুমাত্র সেইসব ক্ষেত্রেই বিদেশি কোম্পানিগুলি তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করে। যেমন—মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভারতে তাদের কারখানা গড়ে তুলেছে, কারণ ভারতে কাঁচামাল ও শ্রমিক কম খরচে পাওয়া যায় এবং উৎপাদিত পণ্য চড়া দামে বিক্রি করে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলা যায়। স্বাভাবিকভাবে এদেশের মাটি ও শ্রমিক ব্যবহার করে গড়ে ওঠা শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থার লাভের অঙ্ক ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
(৭) তথ্য প্রযুক্তির উল্লেখযােগ্য উন্নতি: তথ্য প্রযুক্তির সবিশেষ উন্নতির উপর ভর করে বিশ্বায়ন আজ সফল হয়েছে। বিশেষত এইসময় যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে গেছে, তা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। উল্লেখ্য যে, ইনটারনেট ব্যবস্থা দূরকে করেছে নিকট। ইনটারনেট-সহ সকল তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কৃত্রিম আইনি বেড়াজালকে ছিন্নভিন্ন করে গােটা বিশ্বকে এক ছাতার তলায় আনতে সক্ষম হয়েছে। ফলে আমরা নয়া বিশ্বব্যবস্থার সন্ধান পেয়েছি।
(৮) ভূখণ্ডকেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় সনাতনী সার্বভৌম ধারণার পরিবর্তন: বিশ্বায়নের যুগে কোনাে রাষ্ট্রই যেমন নিজস্ব ভূখণ্ডের মধ্যে অবাধ ক্ষমতা ভােগ করতে পারে না, তেমনই বাহ্যিক ক্ষেত্রেও তার চরম ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারে না। আধুনিক বিশ্বে প্রতিটি দেশই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। ফলে সাবেকি সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণা বিশ্বায়নের যুগে সার্বিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশই বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি ও নির্দেশ মেনে চলে। ফলে বর্তমান সময়ে চিরাচরিত সার্বভৌম ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে।
(৯) বিশ্বায়ন হল নয়া উপনিবেশবাদ: বিশ্বায়ন হল ছদ্মবেশী নয়া উপনিবেশবাদ। একে অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন ও বলা যায়। অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিশ্বায়ন হল পুঁজিবাদের নতুন পথে সাবেকি সাম্রাজ্যবাদী শােষণের পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। আজ আর উপনিবেশ তৈরি করা সম্ভব নয় তাই পুরনো সাম্রাজ্যবাদীরা শােষণের নতুন কৌশলের অবলম্বন হিসেবে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানাে যায় এমন ধারণা, যা বিশ্বায়ন নাম দিয়ে (Old Wine New Bottle) বাজার দখলে নেমেছে। নতুন ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ও কৌশল আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিভাষায় ‘বিশ্বায়ন’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
(১০) বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রাধান্য: বিশ্বায়নের পূর্বেও বিভিন্ন দেশে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রীয় আইনের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। এর ফলে বিশ্বায়নের যুগে বহুজাতিক সংস্থার কর্পোরেট মানসিকতা আর্থিক ক্ষেত্রে তাদের প্রাধান্যকে সুনিশ্চিত করেছে। পণ্ডিতগণ মনে করেন এই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলি রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমগ্র বিশ্বে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে চলেছে।
(১১) বিজ্ঞান-প্রযুক্তি শিল্প-সংস্কৃতির বিশ্বায়ন: অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে আজ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-শিল্প সংস্কৃতির মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে। বিশ্ব পরিচালন ব্যবস্থা (Global Management System) কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে অফিস-আদালতে কর্মচারী উদ্বৃত্ত ঘােষিত হচ্ছে। বর্তমান দুনিয়ায় কম্পিউটার, ইনটারনেট-স্মার্টফোন-স্যাটেলাইট, টিভি চ্যানেল-ডিজিটাল প্রযুক্তি, ক্যাশলেস ইকোনমি এসবই বিশ্বায়নের ফল। এর ফলে একদিকে যেমন অল্প সময়ে বেশি কাজ হচ্ছে, তেমনি চারিদিকে কাজ হারাচ্ছে মানুষ।
বিশ্বায়নের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য উল্লেখযােগ্য সেটি হল – উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে শ্রমিকের কাজ অনেক কমে গেছে। এই অবস্থায় কর্মহারা মানুষগুলি পেটের দায়ে কখনও অন্ধকার জগতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, আবার কখনও জড়িয়ে পড়ছে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের সঙ্গে, যুক্ত হয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে তাই এককথায় বলা যায় যে, বিশ্বায়ন মেহনতি গরিব মানুষ এবং শ্রমিকের স্বার্থবিরােধী।
অধ্যাপক জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মতে, বিশ্বায়নের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। যথা প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্বায়ন দূরকে করেছে নিকট, পরকে করেছে আপন, শিল্পোৎপাদনের সময়কে কমিয়েছে বহুগুণ। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, একটি কম্পিউটার এক নিমেষে বহু শ্রমিকের কাজ করে দিচ্ছে, ভিডিও কনফারেন্সে রাষ্ট্রনেতাদের আন্তর্জাতিক বৈঠক হচ্ছে প্রভৃতি।
উপসংহার: পরিশেষে, বিশ্ব অর্থনীতির পরিচালকদের উদ্দেশে যে কথা বলা দরকার তা হল, বিশ্বনেতাদের ভাবতে হবে শুধুমাত্র প্রযুক্তির সুফল ধনীকে আরও ধনী করার কৌশল হিসেবে প্রয়ােগ না করে সকলের মঙ্গলের জন্য প্রয়ােগ করতে হবে, তবেই বিশ্বায়নের সুফল ঘরে ঘরে পৌছােবে। এর জন্য একটি বিশ্বব্যাপী UNO-র মডেলের একটি গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গঠন করা দরকার, যে সংস্থা ক্ষমতার অর্থনীতির ভারসাম্য সমানভাবে বজায় রাখতে সারা বিশ্বে নজরদারি চালাবে। তবেই বিশ্বে শান্তি ও সুস্থিতি আসবে।