বিংশ শতকের সত্তরের দশক পর্যন্ত সময়কালকে সংশোধনমূলক বা আধুনিক উদারনীতিবাদ বলা হয়। এই সময় ম্যাকাইভার, ল্যাস্কি, হবহাউস, বার্কার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইতিবাচক ধারণা নিয়ে উদারনীতিবাদের নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে সামনে রেখে উদারনীতির মধ্যে জনকল্যাণকামী যে নতুন রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শের জন্ম হয়, তাকে আধুনিক বা সংশােধনমূলক উদারনীতিবাদ নামে অভিহিত করা হয়।
সংশােধনমূলক বা আধুনিক উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য বা নীতিসমূহ
(১) রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা: সংশােধনমূলক বা আধুনিক উদারনীতিবাদ মনে করে রাজনৈতিক সাম্য অর্থাৎ One man, One vote প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই গণতন্ত্র সফল হতে পারে। এর পাশাপাশি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা হল আধুনিক উদারনীতিবাদের আরও একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য বা নীতি। বেন্থাম মনে করেন, ব্যক্তির স্বার্থই হল প্রকৃত স্বার্থ। আধুনিক উদারনৈতিক মতবাদ রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তির পূর্ণস্বাধীনতার সম্প্রসারণ চায়। এই মতবাদ মূলত জনগণের শাসন বা গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলে।
(২) পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি: আধুনিক উদারনীতিবাদীরা মনে করেন, আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সুস্থ সবল জনমত গঠনের জন্য পৌর অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার প্রয়ােজন। সংশােধনপন্থী উদারনীতিবাদীদের এই দাবি হল স্বৈরাচার শাসনমুক্ত পৌর স্বাধীনতার দাবি। সংশােধনমূলক মতবাদের রাজনৈতিক ও পৌর অধিকারগুলি হল জীবনের অধিকার, চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার, ধর্মের অধিকার, নির্বাচন করা ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার প্রভৃতি।
(৩) একদলীয় ব্যবস্থার বিরােধিতা: বার্কার, ল্যাস্কি প্রমুখ সংশােধনমূলক উদারনীতিবাদী একদলীয় ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের হন্তারক ব্যবস্থা বলে মনে করেন। তাদের মতে, একাধিক রাজনৈতিক দল না থাকলে জনগণের বিভিন্ন প্রকার আশা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হতে পারে না। সমাজে একাধিক বা বহুদল থাকলে সুস্থ গণতান্ত্রিক মত প্রতিফলিত হতে পারে।
(৪) প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার: এই মতবাদের অন্যতম মৌলিক নীতি হল সার্বিক প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকার প্রবর্তন। গণসার্বভৌমিকতার বাস্তবায়নের জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের সমানভাবে ভোটদানের অধিকার স্বীকৃত হয়। সকলের ভােটাধিকার প্রয়ােগের সুযােগ থাকলে গণতন্ত্রে সুস্থ জনমতের প্রকাশ সম্ভব হয়।
(৫) ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার: সংশােধনমূলক উদারনীতিবাদী দার্শনিকরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেন। আধুনিক উদারনীতিবাদীরা কতকগুলি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা বাধানিষেধ-সহ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার চান। কারণ ব্যক্তিগত সুখ ও সম্পদ অর্জনের নিশ্চয়তা না থাকলে নাগরিকগণ কাজকর্মে উৎসাহ পাবে না, ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। তাই সংশােধনবাদীরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার বলে মনে করেন।
(৬) ন্যায় প্রতিষ্ঠা: ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপর আধুনিক উদারনীতিবাদ বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে কারণ, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনাে শাসনব্যবস্থাই সফল হতে পারে না। নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান এবং আইন সকলকে সমানভাবে সংরক্ষণ করে। এই দুই নীতি ছাড়া সমাজে কখনােই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
(৭) সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব: সংশােধনমূলক উদারনীতিবাদে সরকার গঠন করার উপর এবং সরকারের কোনাে বিভাগ যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হতে না পারে, তার জন্যই সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের নীতির উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, পেশাগত প্রতিনিধিত্ব, বহুমুখী ভোটাধিকার ইত্যাদির মাধ্যমে সংশােধনমূলক উদারনীতিবাদ সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠের স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করে।
(৮) ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদের বিরােধিতা: আধুনিক বা সংশােধনমূলক উদারনীতিবাদ যে-কোনাে ধরনের সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রের বিরােধী। উদারনীতিবাদের সংশােধনপন্থীরা পুঁজিবাদের সমর্থক হলেও ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র এবং সাম্যবাদী সর্বহারার একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার চরম বিরােধী। সংশােধনমূলক বা আধুনিক উদারনীতিবাদ স্বাধীনতা, মানবিকতা ও জনকল্যাণের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে গেছে এবং সাম্প্রতিককালের নতুন সমস্যাদির সমাধানের প্রতি গুরুত্ব আরােপ করেছে। এরূপ উদারনীতিবাদের প্রবক্তারা ব্যক্তিবর্গের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কাজকর্মে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণের উপর জোর দিয়েছেন।
রাষ্ট্র তত্ত্বের আলোচনা সনাতন উদারনীতিবাদের পুনরুত্থান হল নয়া উদারনীতিবাদ। এই মতবাদ অনেকক্ষেত্রে নয়া ক্লাসিক্যাল উদারনীতিবাদ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই মতবাদ মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং একটি সীমিত বা ন্যূনতম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরােপ করে। কারণ নয়া উদারনীতিবাদ মনে করে যে, মুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে হলে চাই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণহীন মুক্ত বাজার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা।
নয়া উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ
(১) সীমিত রাষ্ট্রের ধারণা পুনঃপ্রতিষ্ঠা: নয়া উদারনীতিবাদে সনাতন উদারনীতিবাদের মতাে রাষ্ট্রের ভূমিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলেও এই রাষ্ট্র কোনাে ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান বা স্বৈরাচারী প্রতিষ্ঠান নয়। নয়া উদানীতিবাদীরা ন্যূনতম রাষ্ট্র বা সীমিত রাষ্ট্রের কথা বলেন, যার একমাত্র কাজ হবে রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান এবং ন্যায়সম্মতভাবে অর্জিত নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পদের তত্ত্বাবধান করা। তাদের মতে, নিরাপত্তা রক্ষা, ন্যায়বিচার ও প্রতিরক্ষামূলক কাজ ছাড়া রাষ্ট্রের আর কোনাে কাজ থাকতে পারে না। এজন্য নয়া উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্রকে ‘Protective Agency’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
(২) অবাধ বাণিজ্য নীতি: নয়া উদারনীতিবাদীরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোনােরকম রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে স্বীকার করেননি। তারা সনাতন উদারনীতিবাদের অবাধ বাণিজ্য নীতির পুনরুত্থানের প্রতি আস্থাশীল। নয়া উদারনীতিবাদ এই নীতিতে বিশ্বাসী, যদি ব্যক্তির অর্থনৈতিক জীবন সকলপ্রকার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকে, তবেই তার পক্ষে প্রকৃত উন্নতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌছােনাে সম্ভব। নয়া উদারনীতিবাদ মুক্ত বাজার অর্থনীতি ব্যবস্থার নীতিতে বিশ্বাসী। এই মতবাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজির বিশ্বায়ন অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করে। তারা বিশ্বাস করেন মুক্ত বাজার অর্থনীতি প্রাচুর্য, দক্ষতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
(৩) প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্ব: নয়া উদারনীতিবাদের অধিকার সংক্রান্ত বা নৈতিক নয়া উদারনীতিবাদী ধারার প্রধান প্রবক্তা হলেন রবার্ট নজিক। তিনি তার ‘Anarchy, State and Utopia’ গ্রন্থে যে তত্ত্বের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছেন তা হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লক-এর প্রাকৃতিক অধিকার (Natural rights) তত্ত্ব। তিনি ন্যায়ের হকদারিত্ব তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সর্বাপেক্ষা কম শক্তিশালী রাষ্ট্র তত্ত্বের উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। তার মতে, সৎ উপায়ে অর্জিত সম্পত্তির উপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ন্যায়সঙ্গত অধিকার থাকে। এমনকি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির উপরও তার অধিকার বর্তায়। নজিক সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠার সপক্ষে জোরালাে বক্তব্য পেশ করেছেন। তার মতে, নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন ও ভোগের অধিকার এবং চুক্তির স্বাধীনতা অলঙ্ঘনীয়। নয়া উদারনীতিবাদীদের মতে, যদি সব ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত রাখা যায় তাহলে সেই ব্যবস্থায় তাদের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটতে পারে।
(৪) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও আইনের শাসনের উপর গুরুত্ব: ‘The Constitution of Liberty’ গ্রন্থে নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তা এফ এ হায়েক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও আইনের শাসনের উপর গুরুত্ব দিয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে চান। এফ এ হায়েক মানুষের ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপকে কখনােই সমর্থন করেননি। তাই তিনি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসনকে বা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে কখনও সমর্থন করেননি। হায়েকের মতে, রাষ্ট্রের একমাত্র কাজ ব্যক্তিস্বাধীনতা কি সুরক্ষিত রাখা। তাই তিনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সমর্থন করে আইনের শাসন চাইলেও রাষ্ট্রের দমনপীড়নমূলক আইনকে কখনােই সমর্থন করেননি।
(৫) অর্থনৈতিক সংগঠন হল রাষ্ট্র: নয়া উদারনীতিবাদী তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা রবার্ট নজিকের মতে, রাষ্ট্র একটি অনৈতিক সংগঠন। তিনি এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছেন, একমাত্র রাষ্ট্রের হাতেই সম্পূর্ণভাবে বলপ্রয়ােগের একচেটিয়া অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে বসবাসকারী ব্যক্তিদের রক্ষা করার জন্য অনেকসময়ই রাষ্ট্র ব্যক্তির অধিকার ক্ষুন্ন করতে পারে কিন্তু নৈরাজ্যবাদীরা যেমন রাষ্ট্রব্যবস্থার পুরােপুরি অবসান চান, তিনি তা চাননি। রবার্টনজিক এমন ন্যূনতম রাষ্ট্র ধারণায় বিশ্বাস করেন, যা ব্যক্তির অধিকারকে কোনাে সময় ক্ষুন্ন করবে না।
(৬) মৌলিক স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি: নয়া উদারনীতিবাদ এর মৌলিক স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রলস ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘Political Liberalism’ গ্রন্থে বলেছেন যে, ন্যায় সম্পর্কিত ধারণার প্রথম নীতি হল সকলের জন্য সমান মৌলিক স্বাধীনতা। তাঁর মতে, ব্যাপক মৌলিক স্বাধীনতায় প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার থাকবে। মৌলিক স্বাধীনতাগুলি হল বাক ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, বিচার বুদ্ধি ও বিবেকের স্বাধীনতা, ভােটদানের স্বাধীনতা, সরকারি কাজে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভােগদখলের স্বাধীনতা ইত্যাদি। তার মতে, সামাজিক মূল্যবােধগুলি যেমন— স্বাধীনতা ও সুযােগ, আয় ও সম্পদ এবং আত্মমর্যাদার উপাদানগুলি সমানভাবে পরিবেশন করতে হবে। তবে নয়া উদারনীতিবাদ যেভাবে জনগণতন্ত্রের সঙ্গে সাযুজ্য সম্পাদন এবং যুক্তিবাদের সঙ্গে মানবতাবাদী ধর্মের সংযােগসাধন করেছে তা উল্লেখযােগ্য।