উদারনীতিবাদের দুটি ধারা সাবেকি এবং আধুনিক উদারনীতিবাদ। সাবেকি উদারনীতিবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী, তাদের মতে রাষ্ট্রের কাজ হল সীমিত। রাষ্ট্রের কাজকে সীমিত করে ব্যক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করাই হল এই নীতির মূল উদ্দেশ্য। যদিও এর ফলে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সংকট নেমে আসে, সাধারণ মানুষের জীবনে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থা মােকাবিলা করার জন্যই উদারনীতিবাদকে সংশােধন করা হয়, যার নতুন নাম দেওয়া হয় আধুনিক উদারনীতিবাদ। এই আধুনিক উদারনীতিবাদের মূল বক্তব্য হল সমাজের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কাম্য, কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখা যায় যে, রাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে এই পরিস্থিতিতে আবার উদারনীতিবাদের পরিমার্জন প্রয়ােজন হয়ে পড়ে— এই পরিমার্জিত উদারনীতিবাদের নাম হল নয়া উদারনীতিবাদ। অন্যভাবে বলা যায় যে, ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি নবােত্ভূত উদবেগ ও মুক্ত বাজারের লক্ষ্যকে সামনে রেখে উদারনীতিবাদের যে পুনরুজ্জীবন ঘটানাে হয়, তাকে নয়া উদারনীতিবাদ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। একে সাবেকি উদারনীতিবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতির আধুনিক বা নবতম সংস্করণ বলা যেতে পারে। অ্যান্ড্র হেইড বলেছেন, নয়া উদারনীতি হল আদি রাজনৈতিক অর্থনীতির সাম্প্রতিক সংস্করণ (“Neo-Liberalism is an updated version of classical political economy…”)।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে নয়া উদারনীতিবাদী তত্ত্ব
[1] রাষ্ট্র সম্পর্কে নয়া উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল নেতিবাচক। এই তত্ত্বে রাষ্ট্রের ভূমিকা ও কর্মক্ষেত্রের পরিধিকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সদর্থক বা আধুনিক উদারনীতিবাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে নয়া উদারনীতিবাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য রয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবস্থানগত দিক থেকে নয়া উদারনীতিবাদ সাবেকি উদারনীতিবাদেরই পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে।
[2] নয়া উদারনীতিবাদীরা মূল ন্যূনতম রাষ্ট্র বা সীমিত রাষ্ট্রের কথা বলেন, যার একমাত্র কাজ হবে নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান এবং ন্যায়সংগতভাবে অর্জিত নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করা।
[3] এই রাষ্ট্রদর্শন বিশ্বাস করে যে, যদি রাষ্ট্রপতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে ব্যক্তি তার বিরােধিতা করতে পারবে।
[4] নয়া উদারনীতিবাদীরা মনে করেন, রাষ্ট্র প্রধানত তিনটি কার্য সম্পাদন করে থাকে, যথা一
- প্রতিরক্ষা (Defence),
- নিরাপত্তা রক্ষা (Protection),
- ন্যায়বিচার (Justice)।
রাষ্ট্রের এই অবস্থাকে বলা হয়- roll back the frontiers of the state।
[5] নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তা জন রল মনে করেন, রাষ্ট্রের নির্দেশক নীতি হল ব্যক্তিস্বাধীনতার সুরক্ষা, জনগণের মঙ্গল ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ।
উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য
প্রথমত: নয়া উদারনীতিবাদ সাবেকি উদারনীতিবাদের ধারাকে বহন করে চলেছে।
দ্বিতীয়ত: নয়া উদারনীতিবাদের সঙ্গে ইতিবাচক সংস্কারমূলক উদারনীতিবাদের চিন্তা দর্শনের পরিবর্তে সাবেকি বা নেতিবাচক উদারনীতিবাদের ঘনিষ্ঠতর সংযােগ বর্তমান। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র তত্ত্বের যৌক্তিকতা নয়া উদারনীতিবাদ স্বীকার করে না।
তৃতীয়ত: নয়া উদারনীতিবাদ মুক্ত সমাজের প্রয়োজনীয়তা উপর গুরুত্ব আরােপ করে, কেননা এর দ্বারা ব্যাপক হারে দক্ষতা ও সমৃদ্ধি ঘটানাে সম্ভব।
চতুর্থত: নয়া উদারনীতিবাদ সামগ্রিকতাবাদ এবং সমষ্টিবাদের বিরােধী। কারণ এই দুই মতবাদের কাছে ব্যক্তিস্বার্থ ও স্বাধীনতা বিসর্জিত হয়।
পঞ্চমত: নয়া উদারনীতিবাদ ভালাে প্রতিষ্ঠানের উপর জোর দেয়। কার্ল পটারের মতে, What we need is not so much good men as good institution. এই কারণে অশূভ হলেও রাষ্ট্র একটি প্রয়ােজনীয় প্রতিষ্ঠান।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি সংক্রান্ত নয়া উদারনীতিবাদ ও বিভিন্ন দিক থেকে সমালােচিত হয়েছে। যেমন ডেভিড হেল্ড-এর ভাষায় এই মতবাদ একদিকে বাজার অর্থনীতির উপর জোর দিয়েছে, অন্যদিকে সরকারের উপর এর দায়িত্ব চাপিয়েছে। একদিকে নয়া উদারনীতিবাদীরা নাগরিক অধিকারের কথা বলেছেন, অন্যদিকে শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছেন এটা কী করে সম্ভব?
উপসংহার: তবে সমালােচিত হলেও এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের নিরিখে উদারনীতিবাদের ঝোক কিন্তু ব্যক্তির সপক্ষেই। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানসমূহকে টিকিয়ে রেখেই নয়া উদারনীতিবাদ সংস্কারসাধনের পক্ষপাতী। নয়া উদারনীতিবাদীরা মূলত রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী ভূমিকাকে বিলুপ্ত করতে চেয়েছেন। নয়া উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্রের ভূমিকাকে সীমিত করতে চেয়েছেন, রাষ্ট্রকে কখনােই তারা অস্বীকার করতে চাননি।