ভূমিকা: রাষ্ট্রনৈতিক দর্শন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলােচনায় উদারনীতিবাদ হল একটি জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। সুদীর্ঘ তিন শতক (সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতক) ধরে নানান অর্থ ও ব্যঞ্জনায় উদারনীতিবাদ রাজনৈতিক চিন্তার জগতে উপস্থিত হয়েছে। সব ধরনের কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে যে মতবাদ ব্যক্তিগত জীবনে স্বাধীন চিন্তা, বিশ্বাস ও মতপ্রকাশের উপর গুরুত্ব আরােপ করে এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রধান উপায় বলে মনে করে এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীন মৌলিক নীতি প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়, তাকে বলা হয় উদারনীতিবাদ।
মূল কথা: উদারনীতিবাদের মূল কথা হল স্বাধীনতা।
মূল উদ্দেশ্য: এই মতবাদ সব ধরনের কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তির দ্বারা সব কিছুকে বিচার করতে চায়। সামাজিক ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও হস্তক্ষেপের বিরােধিতা করা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উৎপাদন বণ্টন ও বিনিময় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের অবসান ও অবাধ প্রতিযােগিতাই হল উদারনীতিবাদের মূল উদ্দেশ্য।
সমাজ বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে প্রগতিশীল মতবাদ হিসেবে উদারনীতিবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও রাষ্ট্রের কার্যাবলি ও প্রকৃতি সম্পর্কিত উদারনীতিবাদী মতাদর্শ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালােচনার সম্মুখীন হয়েছে। সেগুলি হল一
(১) উদারনীতিবাদ অস্পষ্টতা দোষে দুষ্ট: উদারনীতিবাদ কোনাে একজন দার্শনিকের চিন্তাধারায় পুষ্ট নয়, উদারনীতিবাদ অত্যন্ত নমনীয় মতবাদ। রুশো থেকে শুরু করে লক, মিল, ল্যাস্কি, গ্রিন এবং আধুনিক আচরণবাদী চিন্তাবিদ-সহ বহু পণ্ডিতবর্গের চিন্তাধারায় পুষ্ট হওয়ার ফলে উদারনীতিবাদের সুস্পষ্ট কোনো অভিমুখ খুঁজে বের করা মুশকিল। তাই অনেকে উদারনীতিবাদকে অস্পষ্টতা দোষে দুষ্ট বলে মনে করেন।
(২) অর্থনৈতিক সাম্য উপেক্ষিত: উদারনীতিবাদ বিশ্বাস করে একদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং অপরদিকে রাজনৈতিক সাম্য দুটোই এক ও অভিন্ন। এই মতবাদ বিশ্বাস করে ব্যক্তির দক্ষতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে দেওয়াই হল স্বাধীনতা। কেবলমাত্র রাজনৈতিক সাম্যকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে অর্থনৈতিক সাম্যকে একেবারে উপেক্ষা করা উদারনীতিবাদের সবচেয়ে বড়াে দুর্বলতা। বলা যায়, অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত রাজনৈতিক সাম্য কখনােই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কির মন্তব্য হল, অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া রাজনৈতিক সাম্য অর্থহীন।
(৩) উদারনীতিবাদ পুঁজিবাদের সমর্থক: সমালোচকদের মতে, উদারনীতিবাদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রাজনৈতিক স্বরূপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এরা মূলত পুঁজিবাদের সমর্থক। উদারনীতি পন্থীরা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে একধরনের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। এই ধরনের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার কথা আসলে বলা হয়েছিল উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থরক্ষার খাতিরে। সাধারণ দিনমজুর শ্রেণির মানুষের দুঃখ দুর্দশা, মানুষের প্রতি মানুষের শোষণ-নির্যাতন, মানুষে মানুষে মানসিক বৈষম্য— এসব বিষয় নিয়ে উদারনীতিবাদ কোনােরকম ভাবনাচিন্তা বা আলােচনা করেনি। বলাবাহুল্য, এই বিষয় সংক্রান্ত কোনােরকম আগ্রহ উদারনীতিবাদীদের নেই। আধুনিক জনকল্যাণমূলক তত্ত্বের মােড়কে উদারনীতিবাদ নতুনভাবে পুঁজিবাদের জন্ম দিয়েছে, মার্কসবাদীরা তাই একে নয়া সাম্রাজ্যবাদ নামে আখ্যায়িত করেছেন।
(৪) সামাজিক দর্শন হিসেবে নেতিবাচক ভূমিকা: স্যাবাইনের মতে, সামাজিক দর্শন হিসেবে উদারনীতিবাদ সমাজকল্যাণের জন্য কোনাে ইতিবাচক ধারণা এবং কর্মসূচিকেও সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেনি। এই মতবাদ ব্যক্তির স্বাতন্ত্রের উপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ সমাজকল্যাণ সম্পর্কে এই মতবাদের সদিচ্ছা সম্পর্কে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
(৫) রাজনৈতিক দিক থেকেও নেতিবাচক: উদারনীতিবাদ সরকারের ইতিবাচক কাজকর্মকে তুলে ধরতে পারেনি, কিন্তু জনকল্যাণের দিক থেকে সরকারের ইতিবাচক কর্মসূচি অপরিহার্য। সুতরাং উদারনীতিবাদকে জনকল্যাণের দার্শনিক তত্ত্ব হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না।
(৬) প্রকৃত গণতন্ত্র নয়: উদারনীতিবাদ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র এবং গনসার্বভৌমত্বের ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা করলেও বাস্তবে এই গণতন্ত্র আসলে প্রকৃত গণতন্ত্র না হয়েও আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র হয়ে উঠেছে। এই মতবাদে জনমত প্রকাশের সুযােগ আছে কিন্তু তা প্রকাশের মাধ্যমগুলি ক্ষমতাশীল ও বিত্তবানদের কুক্ষিগত থাকায় সুস্থ জনমত গড়ে উঠতে পারে না। এর ফলস্বরূপ অবাধে নির্বাচন হওয়াও সম্ভব নয়। অতএব বৈষম্যপূর্ণ সমাজে সর্বজনীন ভােটাধিকার ও স্বাধীন নির্বাচন ভারত ছাড়া আর কিছুই নয়।
(৭) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অক্ষম: বৈষম্যপূর্ণ তথা সাম্যহীন সমাজে ন্যায়বিচার একটি অর্থহীন শব্দ, কেননা একইসঙ্গে ধনী ও দরিদ্রের প্রতি সমানভাবে ন্যায়বিচার প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সর্বজনীন ভােটাধিকার প্রভৃতি নীতিগুলি পুঁজিবাদের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে এগুলি বিস্তৃত নয়। অতএব ধনী ও দরিদ্র শ্রেণিতে বিভক্ত সমাজে ন্যায়বিচারের ধারণা প্রবঞ্চনা মাত্র।
(৮) রক্ষণশীলতা দোষে দুষ্ট: উদারনৈতিক মতবাদের সমর্থকগণ সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে রক্ষা করার লক্ষ্যে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তার ফলে কালােত্তীর্ণ বা যুগােপযােগী হয়ে এই মতবাদ গড়ে উঠতে পারেনি। তাই সমালােচকরা মনে করেন উদারনীতিবাদ রক্ষণশীলতা দোষে দুষ্ট।
(৯) সামঞ্জস্যহীন মতবাদ: উদারনীতিবাদের প্রবক্তাগণ অনেক পরস্পরবিরােধী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও ব্যক্তিস্বাধীনতা এর সঙ্গে স্বীকার করা হয়েছে, তাই এই মতবাদকে সামঞ্জস্যহীন মতবাদ রূপে চিহ্নিত করা হয়।
(১০) সাংবিধানিক উপায়ে সমাজ পরিবর্তন অসম্ভব: সাংবিধানিক উপায়ে সমাজ পরিবর্তনের কথা উদারনীতিবাদে বলা হয় এবং এই মতবাদ বৈপ্লবিক পরিবর্তনেরও বিরােধী। কিন্তু সমাজ চরিত্র মৌলিক পরিবর্তন সাংবিধানিক উপায়ে করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সমালােচকগণ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
(১১) উদারনীতিবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রবন্তা: উদারনীতিবাদের বাস্তব রূপ হল এটি একটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থার শােষণ পদ্ধতিকে টিকিয়ে রাখাই উদারনীতিবাদের মূল উপজীব্য। সমালােচকদের মতে, উদারনীতিবাদ এর মূল উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিস্বাধীনতার এক ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম রাখা।
(১২) উদারনীতিবাদ একটি সুসংবদ্ধ তত্ত্ব নয়: উদারনীতিবাদের প্রবক্তাদের চিন্তা ও দর্শন ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। সমালােচকদের মতে, এই মতবাদ নমনীয় ও পরিবর্তনশীল, তাই এই মতবাদের একটি সুসংবদ্ধ তাত্ত্বিক দিক খুঁজে বার করা কষ্টসাধ্য। উদারনীতিবাদ হল চরম রক্ষণশীল মতবাদ। এই মতবাদ প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে বিশ্বাসী নয়। আবার উদারনীতিবাদ সমাজে অসাম্য-বৈষম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী সমাজকে অতিক্রম করে যেতে পারে না।
মূল্যায়ন: উদারনীতিবাদ কে নানা ভাবে সমালোচনা করা হলেও এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে কোনােভাবেই অস্বীকার করা যায় না। কারণ一
- সামন্ততন্ত্রের পতনের যুগে এই মতবাদ যথেষ্ট প্রগতিশীল ও বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেছিল।
- সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ললিতবাণী নিয়ে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, অবাধ বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ, আধুনিক শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি হল উদারনীতিবাদের ইতিবাচক ফসল।
- সর্বজনীন ভোটাধিকার, নারীমুক্তি, রাজনৈতিক সাম্য, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, মানবাধিকার ইত্যাদিও উদারনীতিবাদের উল্লেখযােগ্য মূল্যবান অবদান।
- উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানুষের মানবিক মর্যাদা ও মূল্যবােধকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনকি মার্কসবাদীরাও উদারনীতিবাদের এই সদর্থক দিককে সমর্থন করেছেন।
- উদারনীতিবাদ দীর্ঘদিনের মধ্যযুগীয় রক্ষণশীলতা দূর করে সর্বত্র পরিবর্তনের বিশুদ্ধ বাতাস বয়ে নিয়ে এসেছে। মধ্যযুগীয় কুসংস্কার ও বদ্ধ ধ্যানধারণাকে বিদায় জানিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল মননশীলতা চর্চার বা বলা যায় নতুন ধরনের রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে। এখানেই এই মতবাদের গুরুত্ব।